Last updated on July 4th, 2023 at 12:50 am
আজকের Premer গল্প টির নাম – “কেষ্ট নগরের পুতুল” গল্পের বিষয় – Valobasha Mane Kosto আরও Golpo পাওয়ার জন্য আমাদের ব্লগ টিকে সাবস্ক্রাইব করে আমাদের সাথে থাকুন, গল্পটি পড়িয়া যদি আপনার ভালো লাগিয়া থাকে তাহলে অবশ্যই কমেন্ট এবং শেয়ার করিতে ভুলিবেন না।
Bhalobasha Mane Kosto – ভালোবাসা মানে কষ্ট
আজকের গল্প – কেষ্ট নগরের পুতুল
ওর সঙ্গে প্রথম দেখা লাল্টুদের পুকুর পাড়ের জামতলায়। সময়টা দুপুর। আকাশ মেঘে মেঘে কালাে হয়ে আছে। থম থম করছে চারদিক। যেন এখনি ঝড় উঠবে। ঝড় এবং সঙ্গে বৃষ্টি হওয়া অসম্ভব না। সেটাই সম্ভব। তাই আশা করছিলাম। ওপরের দিকে মুখ করে সবুজ লাল এবং কালাে জামের ছড়াগুলাে দেখতে দেখতে নিজের মনে বললাম, ‘জল হওয়া ভালাে, যত বেশি জল হবে তত তাড়াতাড়ি জাম পাকবে। কাচা আধকাঁচা লালচে জামগুলাে রাতারাতি কালাে হয়ে গিয়ে গাছটাও মেঘলা আকাশের মতন থমথম করবে কল্পনা করছিলাম। তাহলেও ওপরের ডালগুলােতে কালাে ছড়ার কিছু অভাব ছিল না। কিন্তু গাছে উঠব কেমন করে! বস্তুত লালটুদের সেই গাছটার মত অত বড় জাম গাছ সারা টালিগঞ্জে সেদিন ছিল কিনা আমাদের জানা ছিল না। কিন্তু তাহলে হবে কি। গাছের অর্ধেকটা কাণ্ড ঘিরে কাটা লতার জঙ্গল। কার সাধ্য গাছে ওঠে। কাজেই গাছের সব জাম পাকলেও আমাদের কাছে সেগুলাে ‘আঙুর ফল টক’ হয়ে ঝুলত। মুখের ভিতর আঙুল ঢুকিয়ে ওপরের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছু করার থাকত না। তবে এটা সত্য, পাখিরা ঠুকরে ঠুকরে কিছু কিছু জাম নীচে ফেলত। পাকা টুকটুকে ফলগুলাে মাটিতে পড়ে থেতলে যেত ফেটে যেত। তাই কুড়িয়ে খাওয়ার আনন্দ কম ছিল কি।
হ্যা, সেদিন দুপুরটা বড় বেশি থম থম করছিল। গাছের পাতাটা পর্যন্ত নড়ছে না। একটু আগে কোথায় যেন একটা ডাহুক খুব খানিকটা ডেকে চুপ করে গেছে। চারদিক চুপচাপ। অতবড় গাছের তলায় দাঁড়িয়ে একলা আমার কেমন ভয় ভয় করছিল। সঙ্গীদের ইচ্ছা করে ডাকিনি। কেননা তাহলে কুড়ানাে জামে ওরা ভাগ বসাবে। তাই চুপটি করে একটা গাছ তলায় চলে গিয়েছি।
কিন্তু বরাত খারাপ ছিল আমার। ওপরের গাছের ডালে না ছিল একটা কাক না একটা বুলবুলি। যেন ঝড় উঠবে ভয় পেয়ে সব বাসায় উড়ে গিয়ে বাচ্চা আগলে বসে আছে। নীচে আঁতিপাতি করে খোঁজা হল। ঘাস উলটে পালটে দেখা হল। একটা ফাটা কি থেতলানাে জাম চোখে পড়ল না। বুঝলাম আগে এসে কেউ সব কুড়িয়ে নিয়ে গেছে। আমার জন্য একটা আধ-পাকা কি আধ-খাওয়া জাম কেউ রেখে যায়নি। এখন ভরসা, ওপরের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, যদি ঝড়টড় ওঠে, হাওয়ার দাপাদাপিতে ডালপালা নড়ে চড়ে উঠলে দু-চারটে জাম টুপটাপ মাটিতে পড়বে। কিন্তু তার নিশ্চয়তা কি। ঝড়ের পর কতদিন গাছ তলায় এসে দেখেছি, সবুজ লালচে সব জামের ছড়া নিয়ে কিছু ডালপালা ভেঙ্গে মাটিতে পড়ে আছে। কালাে জামগুলাে আগের মত আকাশে ঝুলছে আর আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে যেন মিট মিট করে হাসছে। যেন ঝড়ের ছিটেফোটা ওদের গায়ে লাগেনি বা লাগলেও ওদের খসাতে পারেনি, তাই দামাল বাতাস রাগ করে কাঁচা কচি সবুজ সব ছড়াগুলােকে দুমড়ে মুচড়ে মাটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলে রেখে গেছে।
দাঁড়িয়ে ভাবছি, শেষ অস্ত্র ঢিল। কিন্তু অত উঁচুতে কালাে ছড়াগুলাে ঝুলছিল যে ঢিল ছুঁড়ে তাদের ঘায়েল করা শক্ত হবে, হয়েছে, ঢিল ছোঁড়ার বিদ্যায় আমি লালটু বা মতিদের মতন মােটেই দক্ষ ছিলাম না। কি করব, কি করা যায় ভাবতে ভাবতে মাথার ওপর এক জোড়া কালাে ফড়িং-এর নাচানাচি দেখছিলাম। এক সঙ্গে দুটো নাচছে। একটা আর একটার ঘাড় কামড়ে পিঠে চেপেছে আর সেই অবস্থায় উড়ে উড়ে খেলছে। বেশ লাগছিল দেখতে। অত মিশমিশে কালাে রঙের ফড়িং এর আগে আমার চোখে পড়েনি। আমাদের ওদিকটায় ছিল লাল আর হলদে ফড়িং-এর রাজত্ব। খয়েরি রঙের একটা দুটো দেখা যেত। কিন্তু এমন চমৎকার কুচকুচে কালাে ফড়িং! হাঁ করে তাকিয়ে ওদের সুখের নাচন দেখছিলাম আর ভাবছিলাম কোন দেশ থেকে দুটিতে উড়ে এলাে কে জানে। আদর করে যে একটা আর একটার মাথা কামড়াচ্ছে এবং কামড় খেয়ে সুখ পাচ্ছে বুঝে ফেলে আমি ভারি আমােদ পাচ্ছিলাম। ভিতরে এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করছিলাম। কপালটা ঘামছিল, কান দুটো গরম হয়ে উঠেছে মনে হচ্ছিল। অবশ্য জায়গাটা অত নির্জন ছিল বলে আর দিনটা এমন মেঘ মেঘে থম থম করছিল বলে জোড়া ফড়িং দেখে আমার এই অবস্থা হয়েছিল। তার আগে খেলার মাঠে কি স্কুলে যাবার রাস্তায় লালটু মতিদের সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে একশ জোড়া ফড়িং চোখে পড়লেও অত মনােযােগ দিয়ে কোনােটাকে দেখিনি। তারপর মনে হয়েছে কেবল নির্জন জায়গা বা মেঘলা বিষগ্ন দুপুর বলে না, কালাে ফড়িং দুটোর গায়ের গড়ন আমাকে এমন উত্তেজিত মুগ্ধ করে তুলেছিল। লাল বা হলদে ফড়িং-এর মত পেট মােটা বেঁটে নয়; লম্বা, বেশ লম্বা পাখার তুলনায় শরীরটা ও ল্যাজের দিকটা কত সরু ছিমছাম, চামেলী ফুলের উঁটের মতন চিকন সুন্দর। পুরুষ বা নারীর শরীরের গড়ন কেমন হলে দেখতে ভালাে লাগে বুঝতে পারার বয়স আমার হয়েছিল। তা সেই শরীর পােকা-মাকড়ের হােক কি পাখির হােক কি মানুষের। শরীরের দিকে তাকিয়ে থাকা আর মনে মনে তার সমালােচনা করা। পনেরাে বছরের ছেলের অতটা করা উচিত নয় যদিও, কিন্তু আমি করতাম, দেখতাম। তাই অত মনােযােগ দিয়ে সুন্দর শরীরের পতঙ্গ দুটোকে দেখছিলাম। এমন সময় হঠাৎ খেয়াল হল, পিছনে এসে কে দাঁড়িয়েছে। দাঁড়িয়ে আমার মতন অবাক হয়ে কালাে ফড়িং দুটোকে দেখছে। ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনের দিকে তাকিয়ে আমি দ্বিতীয় বার অবাক হলাম। কেবল অবাক অস্ফুট গলায় ‘ও’ করে উঠলাম। অবাক হয়তাে বটেই, ভয় পেয়ে মানুষ তা করে আবার খুশী হলেও করে। হ্যা, চৌদ্দ পনেরাে বছর বয়েস হবে। সাদা ধবধবে একটা সাটিনের ফ্রক গায়ে, খালি পা মাথার পিছনে বেণীটা দু-ভাগ করে এমন ভাবে ঘুরিয়ে বাঁধা হয়েছে যে দেখে মনে হচ্ছিল ওর ফরসা ছােট্ট দু’কানের পিছনে আরও দুটো কান আছে। কালাে রঙের বেশ বড়াে মােটা দুটো কান। কিন্তু আমি সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছিলাম ওর চোখের পালক দেখে। অত লম্বা পালকের চোখের মেয়ে আমি আর দেখিনি।
‘তুমি কোথায় থাক? প্রশ্ন করলাম।
ও উত্তর দিলাে না। চোখের পাতা নামিয়ে মাটির দিকে তাকাল। তারপর লক্ষ্য করলাম, ও আমার হাঁটু অবধি ধুলাে ভর্তি পা দুটো দেখছে, ময়লা, হাফ প্যান্ট দেখছে, বােতাম খসা হাফ শার্টটার দিকেও এক নজর তাকাতে ইতস্তত করল না। দেখলাম ফরসা নাকের ডগা কুঁচকে পরে মুখ ঘুরিয়ে ও অন্যদিকে তাকিয়েছে। অপমান নয় কি? আমার কথারই উত্তর দিতে গ্রাহ্য নেই। তারপর আমার ময়লা বেশভূষা হাত পা দেখে নাক কুঁচকানাে!
আরও পড়ুনঃ গল্পঃ আমরা তিন প্রেমিক ও ভুবন
এটা আপনারা সবাই জানেন চৌদ্দ পনেরাে বছর বয়েসের একটি ছেলের চেয়ে একটি মেয়ে অনেক বেশি ফিটফাট মাজাঘষা থাকে। আমার আঙুলের প্রত্যেকটি নখ বড় ও ময়লায় ভর্তি। ওর নখ বড় হবে কি এমন পাতলা এমন পালিশ এমন ঝকঝকে হয়ে প্রত্যেক আঙুলের মাথায় বসে আছে যে মনে হচ্ছিল সেগুলাের আলাদা কোনাে অস্তিত্ব নেই। যদি থাকেও সেগুলাে নখ বা দামী কোনাে পাথর। বাঁ হাতের একটা নখ রং করা শুধু।
হ্যা, হাতের আঙুল, হাঁটু, পা, পায়ের পাতা, গােড়ালি সবই ওর পরিচ্ছন্ন। ভাবলাম দামী পাথর না হলেও সেগুলাে দামী চামড়ায় মােড়া অনেক বেশি আদুরে মাংস। তেমনি ওর সাটিনের ফ্রক। যেন এই মাত্র বাক্স থেকে বার করে গায়ে চড়িয়ে এসেছে। অথচ, ভাবলাম, খোঁজ নিলে দেখা যাবে ফ্রকটা এক নাগাড়ে তিনদিন পরে ও ঘুরছে। আরও সাতদিন পরলে ওটা ময়লা হবে না। আর আমার, আমার মতির লালটুর এবেলার জামা প্যান্ট ওবেলায়, যা চেহারা ধরে, তাকানাে যায় না। কিন্তু ওর হাত পা জামা চুল যেমন সব সময় নতুন হয়ে আছে, বাড়িতে গিয়ে দেখুন, পড়ার বই খাতা পেন্সিল, (স্কুলে নিশ্চয় পড়ে অনুমান করলাম) রবার ইন্সট্রুমেন্ট বাক্সটা পর্যন্ত নতুন চেহারা নিয়ে সেই জানুয়ারি থেকে আজ জুলাই পর্যন্ত চলছে। একরকম আছে। না এক ফোটা কালির দাগ, না একটু আঁচড়, না কিছু ভাঙাচোরা, ফাটাফুটি। মেয়েগুলাে এমন সাংঘাতিক সাবধান এমন আশ্চর্য রকম হুঁশিয়ার হয়ে আছে সব সময়। কিন্তু আমাকে দেখে ওর এভাবে নাক সিটকানাে সহ্য হচ্ছিল না। কি, একটু দূরেই সরে গেল। সরে গিয়ে থুতনিটা আকাশের দিকে তুলে দিয়ে পাকা জামের ছড়াগুলাে দেখছে। মনে মনে বললাম, “সে গুড়ে বালি। আমি এমন ডানপিটে একটা পুরুষ ছেলে গাছে উঠতে পারছি না তাে তুমি কোন ছার। অত নরম তুলতুলে হাত দিয়ে ঢিল ছোঁড়ারও আশা করাে না। পাখি, পাখি এসে ঠুকরে নীচে ফেলবে আর তুমি কুড়াবে! দ্যাখাে না, থমথমে আকাশ দেখে সব পাখি পালিয়েছে। ফড়িং জোড়াটা তখন নাচতে নাচতে কোনদিকে সরে গেছে। ডাহুকটা সেই যে চুপ করেছে আর ডাকবার নাম নেই। আকাশ আরও কালাে হয়ে গেল। গাছের পাতাগুলাে যেন আরাে বেশি ভয় পেয়ে চুপ করে আছে। আমি সরে গিয়ে ঠিক ওর পিছনে দাঁড়ালাম। চুলের মিষ্টি গন্ধটা এবার নাকে ঢুকছিল। ‘তুমি কোথায় থাক? প্রশ্ন করলাম। উত্তর নেই। এমন কি ঘাড়টা একটু ফেরাবে তা ও না। থুতনি নামিয়ে পায়ের নীচের ঘাস দেখল। তারপর দামী চামড়ায় মােড়া আদুরে নরম মাংস জমানাে পা দুটো দিয়ে আস্তে আস্তে ঘাস মাড়িয়ে আর একটু দূরে সরে গেল এবং আমার দিকে সম্পূর্ণ পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে কালাে জাম দেখতে লাগল। ‘বটে, তােমার এত অহঙ্কার। মনে মনে বললাম, আর দাঁতে দাঁত ঘষলাম। ইচ্ছা করছিল কালাে কানের মত বেণীর বাঁধন দুটো একটা হেঁচকা টান মেরে খুলে ফেলি। কিন্তু কিছুই করা হল না। চিন্তা করছিলাম কোথা থেকে ও এলাে, কাদের বাড়িতে এলাে। সামারের ছুটিতে অবশ্য রাজ্যের মেয়ে টালিগঞ্জে মাসির বাড়ি পিসির বাড়ি কাকুর বাড়ি বেড়াতে আসে। কেউ এবেলা এসে ওবেলা চলে গেছে, কেউ তিন চার পাঁচ হয়ত পনেরাে দিনই কাটিয়ে যাচ্ছে। মতিদের বাড়িতে মতির তিন খুড়তুতাে বােন এসেছে; মীনা বীণা ঝর্ণা। আমার শুধু দেখা না রীতিমত আলাপ করা হয়ে গেছে ওদের সঙ্গে। লালটুর এক মামাতাে বােন এসেছে, কাজল। কী মিশুকে কী মিষ্টি কথা বলে লােকের সঙ্গে। গুর্খাদের বাড়িতে সেদিন ওর রাঙা মাসির মেয়ে চমচম এসে চারদিন থেকে গেল। কাজলের সঙ্গে কথা হাসিখুশি মেলামেশা। বরং চমচম ওর চেয়ে দেখতে ভালাে, এই মেয়ে একটু বেশি লম্বা। চমচম কিছুটা খাটো, কিন্তু তাহলেও অহঙ্কারের ছিটেফোঁটা ততা ছিল না গুর্খার বার্ণপুরের রাঙা মাসির মেয়ের। যাবার সময় ওর পড়া একটা ডিটেকটিভ বই পর্যন্ত আমাকে দিয়ে গেল। একেবারে দান করে গেল। হােক পুরােনাে বই। তবু তাে একটা উপহার। আমি ওকে দিয়ে বইয়ের টাইটেল পেজে আমার নাম লিখিয়ে রেখেছি। আর কে, আর কোন্ মেয়ে এবার সামারের ছুটিতে আমাদের পাড়ায় বেড়াতে এল, ভাবতে ভাবতে সন্তোষের মেজদি ডায়না, পিন্টুর কাকীমার ছােট বােন রেখা, গােবিন্দর কাকার দু-মেয়ে রুন্টি ঝুন্টির মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠল। কিন্তু এই মেয়ে কে, কোথাকার, কি নাম? যত ভাবছি তত রাগ বাড়ছে আমার আর মাথা গরম হচ্ছে। মেয়েটা বােবা নাকি। কিন্তু বােবা মেয়ের চোখ এমন করে চকচক করে না আর অত ঘৃণা ঝরে না সে চোখ থেকে। বরং বােকা বােকা চোখ মেলে ওরা চেয়ে থাকে। আমি আবার ওর পিছনে গিয়ে দাঁড়াই। চুলের মিষ্টি গন্ধ নাকে লাগে। চৌকোণ গলার ফ্রকটার দিকে চেয়ে থাকি। যেমন ফ্রক থেকেও একটা মিষ্টি গন্ধ নাকে উঠে আসছিল। তােমার নাম কি? উত্তর নেই। থুতনি নামিয়ে ও কেবল দেখে!আমার রাগের ডিগ্রী কতটা চড়েছিল কল্পনা করতে পারেন। ‘এই মেয়ে! নিরুত্তর। যেন সরে যেতে আবার ও পা বাড়িয়েছে। ইচ্ছা করছিল এবার একটা ধাক্কা দিয়ে জলে ফেলে দিই। কেননা সরে যেতে যেতে আমরা প্রায় দীঘির ধারে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। লম্বা ঘাস শেষ হয়ে কালাে জল টলটল করছে! কিন্তু ধাক্কা দেবার আগেই সর সর একটা শব্দ হল। একটু সময়। গাছের পাতাগুলাে নড়েচড়ে উঠল। ঘাসের শিষগুলাে দুলে উঠল। তার পর যে কে সে। বুঝলাম আর ঝড় উঠবে না। ঐ পর্যন্ত। হাওয়ায় কালাে মেঘগুলােকে আকাশের এ মাথা থেকে ও মাথায় ভাসিয়ে নিয়ে চলল এবং অত ওপরের হাওয়ায় যে আর পাকা জাম গাছ থেকে খসে পড়ছে না আমার মত সে-ও বুঝতে পারল। বুঝে এবার আর জাম গাছে নয় জলের দিকে চেয়ে রইল। আর আমি হাঁ করে তাকিয়ে দেখছিলাম ওর পা পিঠ ঘাড় গলা চুল। আশ্চর্য, ঝড় উঠল না, আর সেই সঙ্গে যেন আমারও রাগটা পড়ে গেল। কেননা আশা ছিল ঝড়ের বাড়িতে যদি কিছু জামটাম মাটিতে পড়ে আমি সব কুড়িয়ে নেব। নিশ্চয় তখন মেয়েটাও হাত বাড়াবে। আর তখন মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম, হয় ওর হাত কামড়ে দেব নয়তাে বেণী টেনে খুলে ফেলে গায়ের ঝাল মেটাব। কিন্তু সে সব কিছুই হল না। ঝড় এল না দেখে রাগটা যেমন পড়ে গেল তেমনি বুকের ভিতর কিরকম যেন একটা যন্ত্রণা অনুভব করতে লাগলাম। কেমন যেন কান্না পাচ্ছিল। মনে হল পা দুটো অবশ হয়ে আসছে। হাতে জোর নেই। ‘এই তুমি কি কথা বলবে না?’ বললাম, কিন্তু গলার স্বরে তেমন জোর ছিল না। এই শােন! ফের ডাকলাম। এবার ও কথা বলল, বলার ইচ্ছা নেই এমন ভাব দেখিয়ে আস্তে আস্তে পা ফেলে ঘাস মাড়িয়ে একেবারে জলের ধারে গিয়ে দাঁড়াল।
আরও পড়ুনঃ গল্পঃ জতুগৃহ
লালটুদের দুটো রাজহাঁস ছিল। সারাদিন দীঘির জলে ভেসে বেড়াত। মাঝে মাঝে জল ছেড়ে তীরে উঠে চুপচাপ বসে দুটিতে বিশ্রাম করত। এখনও করছিল। একটা আর একটার পিঠ ঠোকরাচ্ছে, যেটারপিঠ ঠোকরাচ্ছে সেটা চোখ তুলে চুপ করে আরাম অনুভব করছে। কিন্তু মেয়েটা সেখানে গিয়ে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে হাঁস দুটো ভয় পেয়ে গাঁক গাঁক শব্দ তুলে ঝাপিয়ে পড়ল। ‘এই, এই মেয়ে!’ আমি চিৎকার করে উঠলাম। তারপর ছুটে জলের ধারে গিয়ে ওর সামনে দাঁড়ালাম। এত জোরে আমি চেঁচিয়ে উঠেছিলাম যে চমকে উঠে ও ঘুরে তাকিয়েছিল। আমি দু চোখ পাকিয়ে ওর মুখের দিকে তাকাতে ও যেন আর একটু ঘাবড়ে গেল। ধমক দেবার সমুচিত শিক্ষা দেবার একটা সুযােগ পেয়েছি ভেবে উল্লাসে উত্তেজনায় আমার বুকের ভেতর তখন নাচানাচি শুরু হয়েছে এবং ও ভয় পেয়েছে দেখে আমার সাহস চতুষগুন বেড়ে গেল। দুর্বলের ওপর সবল চিরকাল অত্যাচার করেছে জানেন আপনারা। না, ও যদি তখন মুখিয়ে উঠত কি লম্বা পালকের চোখ দুটো দিয়ে মাটি না দেখে কটমট করে আমার চোখের দিকে তাকাত অমনি খপ করে আমি ওর হাত ধরে দেখতে পারতাম না। দামী চামড়ায় মােড়া আদুরে নরম মাংস যত জোরে চেপে ধরা যায় আমি ধরলাম। ভাবছি এবার ও থরথর করে কাপবে, কি ভয়ে কেঁদেই ফেলবে। কিন্তু তা করছে না দেখে আমি চড়া গলায় বললাম, “হাঁস দুটোকে তাড়ালে কেন, জান, লালটুদের হাঁস, আমার বন্ধু লালটু ? অবাক হয়ে গেলাম ওর চেহারা দেখে। পাতলা ঠোট দুটো বেঁকিয়ে হাসছে নাকের ডগাটা কুঁচকোতে আরম্ভ করেছে। কি বলব, কি বলা যায় এ-মেয়েকে। এত সাহস! চিন্তা করছি এবং এর পর আমার কি করবার আছে ভাবছি। আমার ভাবনা শেষ হতে দিয়ে ও বলল, ‘হাঁস তাড়িয়েছি বলে রাগারাগি করছ? ‘হ্যা। মাথা ঝাকিয়ে বললাম, “লালটুদের হাঁস। ও মাথা নাড়ল। কানের মতন বেণীর প্যাচ দুটো নড়ে উঠল। লম্বা পালক ঘেরা চোখ দুটো ঘুরিয়ে আর একবার জলের হাঁস দুটো দেখল তারপর আমার মুখের দিকে তাকাল। ‘আমার সঙ্গে ভাব করতে পারনি বলে তুমি রাগ করছ?শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। আমার হাতের মুঠো শিথিল হয়ে গেছে টের পেয়ে ও ফস্ করে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিলে। মাথার ভিতর যেন আগুন জ্বলে উঠল। চোখে অন্ধকার দেখছিলাম। কথাটা ও বলে শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে আমি বললাম, “হ্যা, তা তো তুমি বুঝতে পারছ, এতক্ষণ বােঝনি বলেই তাে রাগ হচ্ছিল। আবার ও ঘাড় নেড়ে নাক কুঁচকালাে। তারপর আকাশের দিকে জাম গাছের দিকে থুতনিটা তুলে ধরল, ‘বিশ্বাস করি না। তাহলে কি এত দেরী করতে, আমাকে গাছতলায় এসে দাঁড়াতে দেখেই তুমি গিয়ে গাছে উঠতে। “কি করে এ গাছে চড়ব?’ গলায় ঝুঁজ ফুটিয়ে বললাম, ‘কাটায় লতায় ভর্তি দেখছ । এ গাছে কেউ উঠতে পারে না। ‘কাল ও কাটার ওপর দিয়েই গাছে উঠেছিল। বুকটা এতখানি চিরে গিয়েছিল। তাহলেও এই এতবড় একটা ছড়া আমার জন্যে পেড়ে এনেছিল। ফ্যাল ফ্যাল করে ওর মুখের দিকে দেখছিলাম। একটু পরে ঢােক গিলে বললাম, “কে, কে তােমাকে জাম পেড়ে দিয়েছিল?কথার উত্তর দিল না। চোখ দুটো নামিয়ে ঘাসের জঙ্গল পার হয়ে আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছিল। দেখছিলাম, কিন্তু এক পা নড়বার শক্তি রইল না আমার। ফরসা সুন্দর পা দুটো উঠছে পড়ছে বেণীটা কাপছে ফ্রকটা নড়ছে। বেশ একটু দূরে সরে গেছে ও। আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না। ছুটে গিয়ে ওর হাত চেপে ধরলাম। ও ঘুরে দাঁড়াল। আমি বললাম, “তুমি মিথ্যেবাদী, মিছে কথা বলে এখান থেকে কেটে পড়ছ।” এবার এত জোরে ওর হাত চেপে ধরলাম যে মনে হচ্ছিল আমার আঙুলগুলাে ওর নরম মাংসের মধ্যে ঢুকে পড়বে। যন্ত্রণায় ও এই প্রথম ‘উঃ করে উঠল। শব্দটা আমার কানে এমন ভালাে লাগল আর সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথা এত গরম হয়ে উঠল যে আমি আরাে জোরে, শক্তি যতটা কুলােয়, প্রায় দম বন্ধ করে ওর বাঁ হাতের কনুইর কাছটা চেপে ধরলাম। কিন্তু তখন ও উঃ করল না, দেখা গেল এবার শক্তি প্রয়ােগ করতে আরম্ভ করেছে, হাতটা ছিনিয়ে নিতে চাইছে। কিছুতেই ছাড়ব না’, বললাম এই গাছে আজ পর্যন্ত কেউ উঠতে পারল না আর তুমি বলছ কিনা বাজে চাল দিতে শিখেছ, কেমন? ‘বেশ’, আমায় অবাক করে দিয়ে ও খুক করে হাসল, ‘তুমি ওঠ, হ্যা, আমি মিছে কথা বলেছিলাম, তুমি না হয় চেষ্টা করে দেখ আমায় কিছু কালাে জাম পেড়ে দিতে পার কিনা।হাত ছেড়ে দিলাম। বেশ একটু ধস্তাধস্তি হয়েছে বলে ও হাঁপাচ্ছিল, আমি হাঁপাচ্ছিলাম। ‘তুমি কোথায় থাক? ‘ওদিকে, ওই বাড়ি। আঙুল দিয়ে মাঠের ওধারে একটা সাদা বাড়ি দেখাল ও। অন্য সব বাড়ি থেকে ও বাড়িটা একটু আলাদা, আশে পাশে কিছু পড়াে জমি নিয়ে কেমন যেন একলা দাঁড়িয়ে আছে। তাছাড়া বাড়িটা চিরকালই চুপচাপ, আমি মাথা নাড়লাম। ‘ও বাড়িতে কোনাে মেয়ে আছে বলে তাে জানা নেই। আমরা তাে রােজ দেখে আসছি। ও মাথা নাড়ল। ‘আমি ওখানে থাকি না। সামারের ছুটি তাই দিদির কাছে এসেছি। ‘ক’দিন থাকবে? ‘আজ সকালে এসেছি, বিকেলে সম্ভবত চলে যাব। ছােট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললাম। ‘একদিনের জন্য বেড়াতে আসা। ঠোট বেঁকিয়ে বললাম, আবার কোথায় ফিরে যাওয়া হচ্ছে? “কেষ্টনগর। “ও! কেষ্টনগরের পুতুল। ঠাট্টার সুরে বললাম বটে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনে হয়, পুতুলের চোখের মণি দুটো কি এমন ঝম করে, চোখের পালক হাওয়ায় কাপে? থুতনির নিচে গলার কাছে একটা ছােট নীল শিরা ধুক ধুক করছে। এক দৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, নাম কি? ঘাড় নাড়ল ও। ‘বলব না। ‘এমনি। আবার আমার মাথা গরম হয়ে উঠতে লাগল। কেননা, আবার হাঁটু ধুলাে পরনের ময়লা হাফ প্যান্টের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ও নাক কুঁচকাতে আরম্ভ করেছে, ঠোট কামড়াচ্ছে। ‘তুমি কোন ক্লাসে পড়?’ হাতটা আর একবার চেপে ধরব কিনা ভাবতে ভাবতে প্রশ্ন করলাম। ‘ক্লাস এইট। ‘আমি নাইনে পড়ি। গম্ভীর হয়ে বললাম, ‘তা নাম বলতে দোষটা কি? মাথা নাড়ল ও। ‘আগে তুমি গাছে উঠতে পার কিনা দেখি, তারপর তাে নাম, আগে আমায় জাম পেড়ে দাও, তবে তাে বুঝব। বটে! কেষ্টনগরের মেয়ে এসেছে টালিগঞ্জের ছেলের সঙ্গে চাল মারতে। খ করে হাতটা ধরে ফেললাম। বােধ করি, সেই আগে থেকে তৈরি হয়ে ছিল। ধরার সঙ্গে সঙ্গে হাতটা ফস্ করে ছিনিয়ে নিয়ে ও ছুটতে আরম্ভ করল। ভুল করল সেখানেই। ডানদিকে গেলে মাঠে চলে যেতে পারত, ছুটল বাঁদিকে, অর্থাৎ একটু যেতেই সামনে দীঘি। লালটুদের দীঘিটা যে চৌ-কোণ না চাঁদের মত, কাস্তের মত ওদিক থেকে বেঁকে এদিকে চলে এসেছে ওর বােধ হয় জানা ছিল না। মনে মনে খুশী হয়ে আমি ওর পিছনে ছুটলাম। আর একটু ভুল করল ও। ঘনকাশের জঙ্গলে ঢাকা ঢালু পাড়টাকে শক্ত সমান জমি ভেবে চোখ বুজে ও পা বাড়াতে গিয়ে পড়বি তাে পড় একবারে দীঘির জলে। ঝুপ করে শব্দ হল। রাজহাঁস দুটো ভাসতে ভাসতে এখান অবধি চলে এসেছিল। জল নড়ে চড়ে উঠতে ভয় পেয়ে হাঁস দুটো গাঁক গাঁক আওয়াজ তুলে আবার দূরে সরে গেল। আমার ভয় হচ্ছিল যদি এদিকটায় বড় গর্ত টর্ত থাকে তবে ও ডুবে যাবে। হয়তাে সাঁতার জানে না কাজেই দুশ্চিন্তা দূর হল জলের মধ্যে ও দাঁড়াতে পারল দেখে। ছিটকে পড়ার দরুন গলা বুক ভিজে গেছে। তখন কোমর সমান জলে ও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে। ছুটে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলাম। আমার হাত ধরে ও পাড়ে উঠল। পাতলা সাটিন জলে ভিজে একাকার। কিন্তু জল ছেড়ে তীরে ওঠা মাত্র ওর দিকে তাকিয়ে আমার মনে হল ও বড়, এইমাত্র যেন বড় হয়ে গেল, যেন অন্তত দশ বছর বয়স এগিয়ে গেছে। আর আমি ছােট। ছােট হয়ে গেছি ওর সামনে। যেন আমি আর ওর দিকে তাকাতে পারছি না, অথবা তাকাতে গিয়ে চোখ অন্যদিকে সরাতে পারছি না। কপালটা ঘেমে উঠল। “কি বলছ, কিসের কথা বলছ?” যখন খেয়াল হল ওর চোখের দিকে আমার বিহ্বল বিস্মিত চোখ জোড়া তুলে ধরলাম। কি হয়েছে? আর কিছু বলছে না। হাতের আঙুল দিয়ে আমায় কি দেখা চাইছে ভীত আতঙ্কিত চাউনি। আঙুলটা কাপছে। অন্য কোথাও না, অন্য কিছু না, ওর শরীরের দিকে ওর সুন্দর সমর্থ আঁটো সাটো ফরসা ঝকমকে পায়ের দিকে আঙুল বাড়িয়ে দিয়ে আমায় কি দেখতে বলছে। ওর পায়ের দিকে চোখ পড়তে আমি চমকে উঠলাম, যেন আরাে বেশি আড়ষ্ট হয়ে গেলাম। কাঁচ, কানাস্তারা অথবা অন্য কিছু ধারালাে জিনিসে লেগে পা-টা কেটেছে বুঝলাম। জলে ছিটকে পড়ার সময় এটা হয়েছে বােঝা গেল। না, পায়ের দিকে চোখ পড়া মাত্র আমি যে এতটা চমকে উঠলাম তা পায়ের ক্ষত দেখে নয়, একটুখানি কেটেছে, আধ ইঞ্চিরও কম একটুখানি জায়গার চামড়া ছড়ে গেছে বলে মনে হল। তা না, আমি স্তব্দ আড়ষ্ট বিমূঢ় হয়ে গেলাম রক্ত দেখে, রক্ত না, রক্তের আশ্চর্য কোমল সুন্দর নিবিড় রং দেখে। দামী চামড়া দেখে ঈর্ষা হয়েছিল। কিন্তু চামড়ার নীচের রক্ত দেখে মনটা অন্য রকম হয়ে গেল। মনে হল, এত সুন্দর রক্ত আমি কোথাও দেখিনি। মতিদের একদিন অন্তর বাড়িতে মুর্গি কাটা হয়। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটতে দেখেছি। আমার ছােট বােন একদিন ব্লেড দিয়ে পেন্সিল কাটতে গিয়ে আঙুল কেটেছিল সেই রক্ত দেখেছি। বল ক্রিকেট খেলতে খেলতে এটা ওটায় হোঁচট খেয়ে বাড়ি খেয়ে আমাদের হামেশা নখ উলটাচ্ছে, কনুই হাঁটু ছড়ে যাচ্ছে, আঙুল কাটছে কিন্তু কিন্তু; নিবিড় কোমল রক্তের রং আমাকে মুগ্ধ করল, আর, হ্যা, ঐটুকুন সময়ের মধ্যে আমি চিন্তা করতে পারলাম, এই রক্তের স্বাদ অন্য রক্তের মতন নয়, নােন্তা না, কেন জানি মনে হল মিষ্টি হবে, দামী দুর্লভ কোনাে ফলের রসের মতন মধুর। আপনা থেকে গলাটা নরম হয়ে গেল, আদর করে বললাম, এসাে বেঁধে দিচ্ছি না হলে- ‘কি দিয়ে বাঁধবো, ব্যান্ডেজ করার কিছু নেই তাে। ক্ষীণ গলায় ও বলল। আমার সঙ্গে রুমাল আছে। প্যান্টের পকেট থেকে রুমাল বার করলাম; জাম বেঁধে নেব বলে মেজদার রুমাল চুরি করে এনেছিলাম, তাই রুমালটা ফরসা ছিল। কথা বলল না ও, আমার কথা শুনে শুধু ঘাড়টা কাত করল। এই জন্য আরাে ভাল লাগল। হাত ধরে দীঘির ঢালু থেকে ওকে ওপরে তুলে আনলাম। ‘এইখানে বােস। আঙুল দিয়ে নরম ঘাসদেখিয়ে দিলাম। আমিও পা ছড়িয়ে বসলাম। পকেট থেকে রুমাল বার করে সেটাকে দু’টুকরাে করে ছিড়ে ব্যান্ডেজ তৈরি করতে লেগে গেলাম। “কেমন ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে, শীত করছে। বলল ও, আমি ওর গায়ের ভিজে জামার দিকে তাকালাম। খুলে ফেলবে ওটা?’ বলেই হঠাৎ চুপ করে গেলাম। মাটির দিকে চোখ রেখে ও মাথা নাড়ল। কিন্তু সেই সঙ্গে ওর কান দুটো এমন লাল হয়ে উঠল যে, আমি ভয়ঙ্কর বিব্রত বােধ করতে লাগলাম। আবার শরীরের সুস্পষ্ট গােলাপী নিটোল রেখাগুলাের দিকে চোখ পড়তে আমি অসহায় বােধ করতে লাগলাম। নিজেকে ওর চেয়ে অনেক বেশি ছােট ও কিঞ্চিৎকর মনে হতে লাগল। ভাগ্যিস ওর পা কেটে গিয়েছিল। সেটাই আমার মনের অবস্থার ভারসাম্য করল। না হলে ওকে আদর দেখাবার করুণা করার সাধ্য ছিল কি সেই মুহূর্তে। বললাম, “দরকার নেই জামা খুলে, পা-টা দাও।” ও পা বাড়িয়ে দিল। ‘এমনি সুবিধা হবে না, এখানে আমার কোলের ওপর রাখ, কিছু ভয় নেই, তােমার কিছু হবে না। একটু পিছনের দিকে হেলে ঘাসের ওপর দু’হাতের ভর রেখে কাটা পা-টা ও আমার নােংরা উরুর ওপর তুলে দিল। সত্যি বলতে কি তখন আর ওকে নাক কুঁচকোতে দেখলাম না, বরং কেমন করুণ ক্লিষ্ট দেখাচ্ছিল, মুখখানা তাই আরও সুন্দর লাগছিল। বেণী খুলে গেছে, জলের ঝাপটা লেগে অথবা কাশের জঙ্গলের ঘষা খেয়ে চুলের এ অবস্থা হয়েছে বুঝতে কষ্ট হল না। ব্যান্ডেজ করা হয়ে গেল। কিন্তু রুমালের টুকরাে দুটোর মাথা একত্র করে বাঁধতে পারছি না, পায়ে জড়াতে গিয়ে সব শেষ হয়ে গেল। দাঁড়াও, এটা দিয়ে পারবে কিনা দেখ। বলে ও টান মেরে ভিজে চুলের ফিতেটা খুলে ফেলল। এবার ও সােজা হয়ে বসল। আর পিছনে হেলে নেই। ওর নিঃশ্বাস আমার কপালে লাগছিল, চিবুকে লাগছিল। গরম মিষ্টি একটা গন্ধ। চুলের গন্ধ ফিতের গন্ধের চেয়েও ওর নিঃশ্বাসের গন্ধটা ভালাে লাগছিল। কি করছ, এখনাে বাঁধতে পারলে না?’ বলল ও; আমি মুখ নীচু করে ফিতেটা ব্যান্ডেজের ওপর জড়িয়ে বাঁধছি, খুলছি, আবার জড়াচ্ছি। যেন তখনই বাঁধা শেষ করে দিতে আমার ইচ্ছা করছিল না। সুবিধে হচ্ছে না, বললাম, ‘পা-টা আর একটু ছড়িয়ে দাও। ও তাই করল। এভাবে দুজনে কিছুক্ষণ বসে রইলাম। আর ও বাঁধা শেষ করতে তাড়া দিচ্ছে না। যেন এভাবে চুপচাপ বসে থাকতে ওর ভালাে লাগছিল। বাতাসটা তখন বেশ জোরে বইছে। টুপটাপ করে পাকা জাম পড়ছে গাছতলায় শুনলাম।
আরও পড়ুনঃ Latest Bengali Jokes for Whatsapp
কিন্তু আশ্চর্য, দুজনের একজনেরও ইচ্ছা হচ্ছিল না উঠে গিয়ে জাম কুড়াই। একবার ঘাড় তুলে ও এদিক ওদিক তাকাল, আমিও তাকালাম। তারপর ঘাড় গুঁজে আবার পায়ের ব্যান্ডেজের দিকে মনােযােগ দিই। এক সময় দুহাতে জড়িয়ে পা-টা উরুর ওপর থেকে আমার বুকের কাছে তুলে ধরলাম। আর এমন সময় ও খিল খিল করে হেসে উঠল। ও হাসল বলে আমি ঘাবড়ে গেলাম। পা-টা আবার নীচে নামিয়ে রাখলাম। যদি হাসত ও, যদি মুখখানা তেমনি করুণ বিষগ্ন করে রাখত, তবে বুঝি পা-টা আমি আমার ঠোটের কাছে তুলে নিতাম। যেন হেসে ভালােই করেছে, তখন মনে হল, আর সঙ্গে সঙ্গে ব্যান্ডেজ বাঁধা শেষ করে আমি পা-টা কোল থেকে নামিয়ে দিলাম। ও উঠে দাঁড়াল। আমিও। বললাম, “এখন হেঁটে দেখ লাগছে কি না। একটু হাঁটল ও। নাঃ লাগছে না। ‘এখন কি বাড়ি চলে যাবে? ও ঘাড় নাড়ল। “তবে তাই যাও। বললাম, আস্তে আস্তে হেঁটে চলে যাও। চলে যাচ্ছিল, হঠাৎ ও আবার দাঁড়াল। “কি ? ‘বিচ্ছিরি লাগছে, কি রকম খারাপ দেখাচ্ছে বাঁধা পা। এবার নিজের পায়ের দিকে চোখ রেখে ও নাক কুঁচকালাে। “তাতে কি, ব্যস্ত হয়ে বললাম, ওটা খুলাে না, খুললে রক্ত বেরুবে। “আর বেরুবে না। মাথা নাড়ল ও। যা বেরােবার বেরিয়ে গেছে, বাকিটুকু তােমার রুমালে শুষে নিয়েছে, একটুখানি তাে কেটেছে।বললাম, “তবে খুলে ফেল, আমি খুলে দিই? “না আমি পারব। ফিতের বাঁধন খুলে দিল ও, রুমালের ফালি দুটো খসে ঘাসের ওপর পড়ল, ফিতেটাও হাতের মুঠোর মধ্যে রাখল। আর নেই, এক ফোটাও রক্ত বেরােচ্ছে না।নেই, আমিও দেখলাম, শুধু একটুখানি লাল আঁচড়। বললাম, “ও কিছু হবে না, শুকিয়ে যাবে। ‘চলি। ‘যাও।’ ও আস্তে আস্তে হেঁটে চলে গেল। দীঘিপাড়ের উঁচু শক্ত জমি পার হয়ে মাঠে নেমে গেল। আমি এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম। তারপর এক সময় ওকে দেখা গেল না। সেই চুপচাপ সাদা বাড়ির ভিতর অদৃশ্য হল। আমি কতক্ষণ জাম গাছ তলায় চুপ করে বসেছিলাম খেয়াল নেই। যখন খেয়াল হল ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখি, আকাশে আর মেঘ নেই। যেমন মেঘ তেমনি ওদিকে সূর্যও ডুবুডুবু, কেবল সেখানটায় একদল মেঘ জমে আছে, নীচের দিকটা আবীরের মত লাল হয়ে গেছে। যেন তখনও সামান্য বেলা আছে টের পেয়ে এক ঝাঁক পাখি জাম গাছটায় এসে আবার কিচির মিচির শুরু করেছে। টুপটাপ জাম পড়ছে দেখতে পেলাম। কিন্তু উঠবার ইচ্ছা নেই। হঠাৎ পায়ের কাছে ঘাসের ওপর চোখ পড়ল। রুমালের টুকরাে দুটো পড়ে আছে। রক্তের রং আর চেনা যায় না, শুকিয়ে কেমন কালচে হয়ে আছে। আর কোথা থেকে এতগুলাে মাছি এসে জুটেছে ওটার ওপর। কেমন তিরতির করে উঠল বুকের ভিতরটা, কেমন যেন কান্না পাচ্ছিল। হাত বাড়িয়ে রুমালের টুকরাে দুটো এনে চোখের সামনে তুলে ধরে নাড়াচাড়া করি, আর যেন অনেকটা ভয়ে ভয়ে, এদিক ওদিক তাকাই; আমার মাথার কাছে, নাকের কাছে মাছিগুলাে বন্ বন্ করে ক্রমাগত ঘুরছিল। তখন কিন্তু কেন জানি না, সেই কালাে রঙের সুন্দর শরীরের জোট বাঁধা ফড়িং দুটোকে সেখানে আর দেখতে পাইনি।
(সমাপ্ত)
Golpo ta onk valo laglo. R porar somoy ta ami akdom nithor hoey giesilam kokhon jani na. Kano jano amar prio manush ta k onk mone porsilo. R mone hossilo ay golper chele meya tar moto amader o boyesh ta kome gasy. Onk valo laglo.
Thank You Very Much For Reading Our Story, If You Like The Story Then Share Please and Don't Forget To Subscribe Our Blog