Last updated on July 4th, 2023 at 12:50 am
আজকে আমার পাঠকগনদের জন্য রইল একটি Sad Love Story in Bengali Language গল্পের নাম “রাইকমল” গল্পের প্রধান চরিত্রে কমলিনী ও রঞ্জন, গল্পের বিষয় – ভালোবাসা মানে কষ্ট, আরও Romantic Bangla love story এবং Bangla Funny Jokes পড়ার জন্য আমাদের ব্লগ টিকে সাবস্ক্রাইব করে আমাদের সাথে থাকুন, গল্পটি পড়িয়া যদি আপনার ভালো লাগিয়া থাকে তাহলে অবশ্যই কমেন্ট এবং শেয়ার করিতে ভুলিবেন না।
Heart Touching Bangla Sad Love Story
আজকের গল্প – রাইকমল
ছােট্ট আখড়াটি রাংচিতের বেড়া দিয়ে ঘেরা,—ফাঁকে ফাঁকে কয়টি আম, পেয়ারা, নিম, সজিনার গাছ; পিছন পানে কয় ঝাড় বাঁশ,—দূর হইতে মনে হয় বাগিচা একটি। তারই মাঝে দু-পাশে দু-খানি ঘর, আর রাঙা মাটি দিয়া নিকাননা তকতকে ছােট আঙিনা একটি—লােকে বলে সিঁদুর পড়িলেও তােলা যায়; মাঝ আঙিনায় একটি চারায় জড়াজড়ি করিয়া মালতি ও মাধবীর লতা দুটি শক্ত বাঁশের মাচার পরে লতাইয়া বেড়ায়, আর পালাপালি করিয়া ফুল ফোটায় প্রায় গােটা বছর। আখড়ায় থাকে মা ও মেয়ে,-কামিনী ও কমলিনী; লােকে কয় ‘মা বিটিয়া। মা কামিনী, খঞ্জনী বাজাইয়া গান গাহিয়া ভিক্ষা করে, রাঁধে বাড়ে; আর মেয়ে কমলিনী গান শেখে, মালতী-মাধবীর জোড়া লতায় জল দেয়, রাঙা মাটি দিয়া ঘরদুয়ার নিকায়, আর হাসিয়াই সারা হয়।
আধ-বুড়া বাউল রসিক দাস—বকের মতাে লম্বা গলা, অমনি লম্বা হাত, পা। দেহখানাও বকের মতাে নড়বড়ে। লম্বা দাড়িতে বিনুনি পাকায়। বড় বড় চুলে চূড়া বাঁধে, সে কমলিনীকে গান শেখায়। তার আখড়া পাশেই তবে সে এই আখড়ার পাশে-পাশেই ঘুরিয়া বেড়ায়।
সে কমলিনীকে ডাকে,—“রাই-কমল!”
কমলিনী তাহাকে কয়—“বগ-বাবাজী!”
রসিক দাস হাসে, মা কমলিনীকে গালি দেয়, “মর মুখপুড়ী, চোদ্দ বছরের ধাড়ী—” রসিক হাসিয়া বাধা দিয়া কয়,-“না, না, বকো না, ও আনন্দময়ী,রাই-কমল।” কমলিনী সায় পাইয়া সঙ্গে সঙ্গে জোর দিয়া বলে,-“বলত বগ-বাবাজী”, বলিয়া মুখে কাপড় দিয়া হাসে। মা ঝাট দিতে দিতে বঁটাগাছটা উঁচাইয়া কহে, “ফের? দেখবি-” ওপাশ হইতে মােড়লদের রঞ্জন ডাকে—“কমলি!”
কমলি অমনি পলাইবার ভঙ্গীতে ছুটিতে শুরু করিয়া বলে,-“নিজের মুখে মার; থাকল তাের গান শেখা, চল্লাম আমি কুল খেতে” মা বলে, “বেরােবেরাে, একেবারে বেরাে,-”
মেয়ে কথা আমলেই আনে না, চলিয়া যায়, মা পিছন পিছন বাহির দরজা পর্যন্ত আসিয়া হাঁকিয়া কয়, “বলি ও কুলখাগী, কুল খাস না, আর কুল খাসনা, ফিরে আয় বলচি! বলি, ললাকে বলবে কি, সে জ্ঞান করিস!”
রসিক দাস হাসে, তাহার হাসি দেখিয়া কামিনীর অঙ্গ জুলিয়া যায়, সে কহে,—“কি যে হাস মহন্ত,—বলি হাসি আসচে তো?”
রসিক দাস উত্তর করে না, কামিনী আপন মনে বকিয়াই যায়, আর ঘর ঝাঁট দেয়। গান শিখাইবার লােকের অভাবে মহন্ত নিজের মনেই গুনগুন করিয়া গান গাহিতে গাহিতে আপন আখড়া পানে পথ ধরে
“ফুটল রাই-কমলিনী, বসল কৃয় ভ্রমর এসে,
বলি, -কথায় তাদের কি যায় আসে।
কুল ত কমল চায় না বৃন্দে, মাঝ জলেই সে হাসে-ভাসে।” রঞ্জন, হরি মােড়লের ছেলে। কমলিনীর চেয়ে বছর দু-তিনের বড়,কমলিনীর সে খেলাঘরের বর,—সে কমলিনীর কিল মারিবার গোঁসাই।
ছেলেবেলার বটতলার খেলাঘরের খেলায় রঞ্জন পথের ধুলা গায়ে পায়ে মাখিয়া, বটগাছের উঁচু শিকড় সেটা খেলাঘরের তক্তপােশ,—তাহারই পরে বসিয়া বিজ্ঞ চাষীর মতাে বলিত,-“আঃ যে রােদ, ঘামে যেন সারা গায়ে বান ডাকছে। বৌ,—ও বৌ, একবার তামুক সাজ তাে আর খানিক বাতাস—”
ওপাশ হইতে চপলা কমলি প্রবলা বন্ধুর মতাে ঝঙ্কার দিয়া কহিত, “আ- মরে যাই,—বলি গরজ দেখাও কেনে, আমার বলে কত কাজ বাকি, সে সব ফেলে আমি এখন তামুক সাজি, বাতাস করি। বলবার নাকি তুমি, তামুক সেজে খাও।” রঞ্জন হুঙ্কার দিয়া কহিত, “এই দেখ রােদে পােড়া চাষা, আর আগুনে তপ্ত ফাল এ দুই সমান। বুঝে কথা বলিস, দোব ধুমসাে গতর ভেঙে।” কমলি আগাইয়া আসিয়া রঞ্জনের নাকের কাছে পিঠ উচাইয়া দিয়া বলিত,-“কই—দে, -দে দেখি একবার! ওঃ গতর ভেঙে দেবেন, ওরে আমার কে রে!” রঞ্জন অমনি কমলির মােটা বিঁড়ে ছােট হাতের মুঠায় পাকাইয়া গদগদ কিল বসাইয়া দিত।
কমলি টান মারিয়া রঞ্জনের হাতে গােছা কয়েক চুল রাখিয়া দিয়ে চুলের গােছা মুক্ত করিয়া লইয়া রঞ্জনের চোখে মুখে ধূলা ছিটাইয়া দিয়া কাঁদিতে কাদিতে কহিত, “কেন, কেন মারবি, কেন, আমাকে মারবার তুই কে?”
রঞ্জন চুপ করিয়া থাকিত, ইচ্ছা করিত কমলিকে হাত ধরিয়া নামাইয়া লয়, কিন্তু কেমন লজ্জা করিত।
ও পাড়ার ভােলা কমলিকে ভালােবাসিত, কহিত, “খেলতে এলে মারবি কেন রে রঞ্জন?”
রঞ্জনের আর সহ্য হইত না, সে হুঙ্কার দিয়া কহিত,-“নাঃ—মারবে না, পরিবারের মুখঝামটা খেতে হবে নাকি সােয়ামী হয়ে কমলি ফুলিতে ফুলিতে গর্জিয়া উঠিত,—“ওরে আমার সােয়ামী রে বলে যে সেই ভাত দেবার সােয়ামী লয়কো কিল মারবার গোঁসাই। যাঃ যাঃ আমি তাের বউ হব না, তাের সঙ্গে আড়ি, আড়ি আড়ি।”
এমনি করিয়া সেদিন খেলা ভাঙিত; পরদিন প্রথমেই ভােলা কমলির হাত ধরিয়া কহিত—“আজ ভাই তােতে আমাতে—”
কমলি ওপাশে তাকাইয়া দেখিত রঞ্জন ম্লানমুখে দাঁড়াইয়া; বেনেদের মেয়ে পরিতােষ রঞ্জনকে কহিত, “তােতে, আমাতে এ্যা।”
সে সম্মতির জন্য রঞ্জনের মুখপানে তাকাইত, কিন্তু রঞ্জন মাথা নাড়িয়া কহিত, “না ভাই বিয়েই আমি করব না।”
ভােলা হাসিয়া ব্যঙ্গ করিয়া কহিত—“গোঁসাই ঠাকুর গাে-।” কমলি হাতখানা টানিয়া লইয়া আগাইত, ভােলা তাহার ভাব বুঝিয়া কহিত—“আবার মার খাবি কমলি”
কমলি কহিত—“তা ভাই মারুক, ধরুক, বর যখন ওকে বলেছি তখন ঘর ওর করতেই হবে, তা বলে তাে আর দুবার বিয়ে হয় না মেয়ের—এ্যা” বলিয়া সে রঞ্জনের খেলাঘরে উঠিয়া একেবারে আসন জাঁকাইয়া বসিয়া ফরমাস করিত—“আর—আমার কপাল, মরদ আর তুমি নও; নুন নাই, তেল নাই,—বলি সেসব কি আমি রােজগার করে আনব?” বলিয়া রঞ্জনের মুখের কাছে সে হাত মুখ নাড়িয়া দিত; রঞ্জন কথা কহিত না, উদাসভাবে বসিয়া থাকিত। কমলি ভােলাকে ডাকিয়া কহিত, “সত্যি ভােলা, কর্তা আমার গোঁসাই-ই হয়েছেন, -তারপর ফিসফিস করিয়া রঞ্জনের কানের কাছে কহিত,—কোন্ গোঁসাই গাে,আমাকে কিল মারবার গোঁসাই নাকি?” বলিয়া খিলখিল হাসি।
রঞ্জন অমনি ফিক্ করিয়া হাসিয়া ফেলিত।
খেলার ফাঁকে সকলকে এড়াইয়া রঞ্জনও ফিসফিস্ করিয়া কহিত—“আর মারব না বৌ- কালীর দিব্যি!”
কমলি আবার হাসিত।
সেই রঞ্জন আজ তরুণ কিশাের, নয়নের শুভ্রক্ষেত্রের কোণে কোণে আজ শীতান্তের কিশলয়ের লালিমাভার রেশ ফুটিয়াছে; আর সেই কমলি আজ চৌদ্দ বছরের কমলিনী; দেহে তার ফুল আজও ফুটে নাই কিন্তু মুকুলের বার্তা—তাহার চঞ্চল চলনের ঈষৎ চাপা গতিতে, রং-এর চিক্কণতায়, নয়নের ঈষৎ নত ভঙ্গিমায়, গালের ফিকা লালিমায়, ঘঘাষিয়াছে; তবুও চাপল্যের তাহার অন্ত নাই, বয়সের ধর্ম তাহার সকল মর্মকে জয় করিতে পারে নাই; এখন ঈষৎ-চাপা-চপল সে।
তাই মায়ের কুলের ভয় দেখানাে সত্ত্বেও সে রঞ্জনের সাথে কুল খাইতে যায়; রঞ্জন গাছে চড়িয়া কুল ঝরায়, তলায় চপল গতিতে কমলিনী কুল কুড়ায়। একটা পাকা কুল টুপ করিয়া ঝরিয়া পড়ে, কমলি সেটায় কামড় মারিয়া চিবাইতে চিবাইতে কহে, “আহা, কি মিষ্টি-রে!”
আরও পড়ুন গল্পঃ ভালোবাসায় বলিদান
উপর হইতে রঞ্জন ঝপ করিয়া লাফ দিয়া মাটিতে পড়িয়া কহে।–“দে, দে ভাই—আমাকে আধখানা।”
কমলিনী আধখানা খাওয়া কুলটা রঞ্জনের মুখে পুরিয়া দেয়; রঞ্জনের অম্বলের টাক্রায় টোকার মারিতে মারিতে কহে—“বাবাঃ!”
কমলি খিলখিল করিয়া হাসিয়া কহে—“কেমন?”
রঞ্জন টোকা মারিতে মারিতে কহে—“খুব মিষ্টি, তাের এঁটো যে—” কমলি হাততালি দিয়া কহে—“বােল হরিবােল, আমার মুখে কি চিনি আছে নাকি!” রঞ্জন কহে -“তুই আমার চিনি।”
কমলি হাসিয়া এলাইয়া পড়ে, হাসিতে হাসিতে কহে—“তাের এঁটো আমার কেমন লাগে জানিস?”
“কেমন?”
“ঝাল, তুই আমার লঙ্কা।”
রঞ্জন কহে,-“যার যেমন ভালােবাসা- কমলি বাধা দিয়া কহে—“তা তাে হল, আমার এঁটো খেলি, তাের যে জাত গেল”। রঞ্জন খপ করিয়া কমলির হাত দুটো চাপিয়া ধরিয়া কহে—“আমাকে বিয়ে করিস তো আমি জাত দি—।”
কমলি কহে—“দূর–ছাড়—ছাড়।”
রঞ্জন কহে—“বল নইলে ছাড়বাে না—” বলিয়া আরও জোরে চাপিয়া ধরে। কমলি বলিয়া উঠে—“উঃ, উঃ-মা, মা।”
রঞ্জন শশব্যস্তে ছাড়িয়া দেয়, কমলি হাসিতে হাসিতে ছুটিয়া পালায়, আর কহে“চাষার বুদ্ধির ধার কেমন, না—ভোতা লাঙলের ধার যেমন।”
রঞ্জন দাঁড়াইয়া পলায়নপরা কিশােরীর হিল্লোলিত গতির পানে চাহিয়া থাকে। কমলি ততক্ষণে বাড়ির আঙিনায় জোড়া-লতার কুঞ্জছায়ায় বসিয়া কুল বাছে। রঞ্জনের মা কমলিকে কহিত হাস্যময়ী; রঞ্জনকে দিতে গিয়া আধখানা মণ্ড ভাঙিয়া কমলিকে দিত; কিন্তু যেদিন রঞ্জন কমলির এঁটো কুল খাইয়া ঘরে ফিরিল, সেদিন সে কহিল—“রাক্ষুসী, রাক্ষুসী!” আর “মুড়াে ঝাঁটা’ তাহার আহারের ব্যবস্থা করিল। কুল খাওয়ার ব্যাপারটা নজরে পড়িয়াছিল—খােদ হরি মােড়লের,রঞ্জনের বাপের। রঞ্জনের মা কথাটা শুনিয়া গালে হাত দিয়া বিষম বিস্ময়ে লম্বা টানা সুরে কহিল-“ওমা— কোথা যাব গাে,-জাতকুল দুই গেল যে! রাক্ষুসী-হারামজাদী! কি মেয়ে গাে! মুড়াে ঝাটা মার মুখে। আর সে হারামজাদা গেল কোথা?” হরি মােড়ল বাধা দিয়া কহিল, “চুপ, মাগী চুপ, গাঁ গােল করিস না চেঁচিয়ে; জ্ঞাতে শুনলে টেনে ছাড়ানাে দায় হবে, পতিত করবে।”
ধমক খাইয়া রঞ্জনের মা তখনকার মতাে চুপ করিল, কিন্তু রঞ্জনের দেখা পাইতেই নথ নাড়িয়া, ঘন ঘন ভুরু তুলিয়া কহিল—“বলি,—ওরে ও মুখপােড়া, বলি তাের রকম কি বল দেখি?
রঞ্জনও সমানে তাল দিয়া কহিল, “খেতে দাও বলচি, গাল খেতে আসি নাই আমি মা কহিল-“দোব খেতে-দোব, ছাই দোব মুখে—; কমলির এঁটো কুল খেয়ে পেট ভরে নাই, সরম নাশা, জাত খেগাে!”
সাপের মাথায় যেন ঈশের মূল পড়িল, রঞ্জনের রক্ত-আঁখি নত হইয়া মাটির পরে নিবদ্ধ হইয়া গেল।
আড়াল হইতে বাপ আসিয়া কহিল,-“হয়ে মরলি না কেন তুই? মুখ হাসালি আমার!” রঞ্জন চুপ করিয়া থাকে, তাহার নীরবতায় মােড়লের রাগ অকারণে বাড়িয়া যায়, সে কহিল—“চুপ করে আছি যে, কথার জবাব দে।”
তবু কথার জবাব দেয় না;- “আচ্ছা, আমিও তেমন লােক নই,—ত্যাজ্য বেটা করব তােকে আমি, দূর করে দোব বাড়ি থেকে। খবরদার আর যাবে না বলচি, মা-বিটিদের তি-সীমায় দাঁড়াবে না—হ্যা।”
আস্ফালন করিয়া মােড়ল চলিয়া গেল, রঞ্জন গুম হইয়া বসিয়া রহিল। এবার মা আসিয়া সান্ত্বনা দিয়া কহিল-“মাঘ মাসেই বিয়ে দোব তাের, এমন বৌ। আনব দেখবি কমলি কোথা লাগে!”
রঞ্জন মাথা নাড়িয়া কহিল—“না!”
প্রবল বিস্ময়ে মা কহিল,-“কি না?”
“বিয়ে আমি করব না”
প্রবলতর বিস্ময়ে মা কহিল-“কি করবি তবে?”
রঞ্জন উঠিয়া চলিতে চলিতে কহিল-“বােষ্টম হব আমি।” রঞ্জনের মা সরম-ভরম ভুলিয়া উচ্চকণ্ঠে ডাকিল-“মােড়ল, মােড়ল—ও মােড়ল।” রঞ্জন আসিয়া উঠিল ‘রসকুঞ্জে’-রসিক দাসের আখড়ার ওই নাম; ছেলেদের সেথা তামাক মিলিত, বুড়াদের গাঁজা মিলিত, আরও মিলিত কাহারও-বা ‘ঢ’-এর আকারের বাঁশের খুঁকো, সাপের মতাে এঁকা-বেঁকা নল। দুইটা সাপে জড়াজড়ি করার মতােলতার জোড়া ডালের ছড়ি আরও কত কি উদ্ভট সুন্দর সামগ্রী। রসিক দাষ বরাত মতে বানাইয়া দিত।
রসিক দাস তখন স্নানের পরে আঙুল চালাইয়া ফাস ভাঙিয়া লম্বা দাড়িতে বিনুনি। পাকাইতে ছিল; রঞ্জন আসিয়া কহিল—“মহন্ত!”
রসিক কহিল, “রাই-কমল-রঞ্জন যে হে!” রঞ্জনকে সে ওই নামে ডাকিত। রঞ্জন অনেক কথা মনে মনে ফাদিয়া আসিয়াছিল; কিন্তু সব কেমন গােল হইয়া গেল, সে চুপ করিয়া রহিল।
রসিক কহিল—“কি তামুক খেতে হবে নাকি? ভাত খেয়েচ!” রঞ্জন যেন একটা সুযােগ পাইল, কথাটা ধরিয়া সে কহিল— “না—খাই নাই, হেথায় খাব!”
মহন্ত রসিকতা করিয়া কহিল—“জাত যাবে হে !”
রঞ্জন ফস্ করিয়া কহিল—“বােষ্টম হব আমি মহন্ত!” মহন্ত কিছু বলে না, শুধু উপভােগের ভঙ্গিতে ঘাড় নাড়ে আর গুনগুন্ করে। গুনগুনানির মাঝেও রঞ্জনের কানে গানটা ধরা পড়ে—“জাতি-কুল-মান সবই ঘুচাইয়া চরণে হইনু দাসী।”
সে লজ্জায় রাঙা হইয়া কহে—“ধেৎ; ধান ভানতে শিবের গীত। তােমার হল কি মহন্ত।”
রসিক ঘাড় নাড়িয়া নীরব হাসিতে মুখ ভরিয়া কহে—“রসিকের রস এসেছেবিরক্ত হইয়া রঞ্জন কহে—“তা তুমি কি বলচ বল, আমাকে ভেক্ দেবে তুমি?” রসিক নির্বিকারভাবে কহে—“রাই-কমল বলে তাে দোব।” রঞ্জন রাগিয়া কহে—“কেন, কমলি কি তােমার হাকিম নাকি,—যে সে না বললে হবে না?”
মহন্ত হাসিয়া পাঁচ-ছয়বার ঘাড় নাড়িয়া একটি মাত্র কথা শেষকালে কয়—“হু!” রঞ্জন উঠিয়া কহে—“তবু যদি না বক-বাবাজী বলত সে! মহন্ত শুধু হাসে, কথা কয় না।
রঞ্জন কহে-“বেশ—চললাম আমি—তারই কাছে!”
রসিক বসিয়া বসিয়া দাড়িই বিনায় আর গুনগুন করে। কমলি তখনও একা বসে বাকি কুলগুলাে বাছিতেছিল, আর মাঝে মাঝে সেই ‘খা-খা’ বলিয়া রঞ্জনের হাত ছাড়ানাের কথা ভাবিয়া আপন মনে হাসিতেছিল।
ও পাড়ার ভােলা আসিয়া এদিক-ওদিক চাহিয়া কমলির সম্মুখে বসিয়া কহিল, “কমলি।”
‘কমলি’ সুরে হিল্লোলিত করিয়া কহিল, “কি?”
ভােলা টানিয়া টানিয়া কহিল-“এই এলাম একবার।”
কমলি ভেঙাইয়া কহিল—“বেশ—যাও এইবার।”
বলিয়া সেই খিলখিল হাসি।
ভােলার সকল কথার খেই হারাইয়া গেল—সে হাঁটুতে হাত রাখিয়া নীরবে বসিয়া রহিল!
কমলি কুল বাছা ফেলিয়া হাঁটুতে হাত রাখিয়া একই ভঙ্গীতে বসিয়া কহিল—“বলি যে; তার চেয়ে তুই ভাই আমার কুল বেছে দে, আমি একটু বসি!” ভােলা হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচে, সে তাড়াতাড়ি কুল বাছিতে শুরু করিল। কুল বাছিতে বাছিতে ভােলা খ করিয়া এ পাশে অলসভাবে পড়িয়া থাকা কমলির হাত খানা ধরিয়া কহিল-
“কমলি।”
কমলি হাতখানা টানিয়া লইতে চাহিয়া কহিল—“ছাড়, ভােলা ছাড় বলচি!” ভােলা কহিল, “না!”
কমলি চট্ করিয়া মুক্ত ডানহাতে—একমুঠো কুল লইয়া ঘুড়িয়া ভােলার মুখে মারিল। কাচা কুল ঠক্ করিয়া বাজে, পাকা কুল ছিত্রাইয়া চটচটে শাঁসে চোখ-মুখ ভরিয়া যায়; ভােলা থুথু করিতে কলির হাত ছাড়িয়া আপনি মুখ মুছিতে লাগিল। বাহির হইতে চাপা ডাক আসিল—“চিনি!”
ভােলা চমকাইয়া বাহিরের পানে ছুটিল, কমলি হাসিয়া লুটোপুটি খাইতে খাইতে কহিল—“যাস না, ভােলা, যাস না ভয় কিসের রে?”
বলিতে বলিতে বাহিরে আসিয়া দেখিল, এ মুখে ভােলা পলাইতেছে, ও মুখে দ্রুতগমনে চলিয়াছে রঞ্জন!
কমলি ডাকিল—“লঙ্কা হে, লঙ্কা।”
রঞ্জন উত্তর দিল না, একবার ফিরিয়া তাকাইল না পর্যন্ত। কমলি উচ্চকণ্ঠে হাঁকিল, “আচ্ছা আচ্ছা, এই হল— মনে থাকে যেন!” বলিয়া – ভিতরে দু-পা ফিরিয়া আবার দরজায় আসিয়া উচ্চকণ্ঠে কহিল, “আমিও কারও কেনা বাঁদি নই—”
বলিয়া ওপাশে মুখ ফিরিয়া হাঁকিল—“ভােলা ও ভােলা—” ভােলার পলায়নের বেগ বাড়িয়া গেল!
কমলি ফিরিয়া কুঞ্জছায়াতলে বসিয়া আবার কুল বাছা শুরু করিয়া একটা কুল হাতে লইয়া আপন মনে বকিয়াই গেল— ‘ওরে চলে গেলি-গেলি, আমার তাতে বয়েই গেল! একেই বলে- আলুনাে রাগ, তা রাগ করলি করলি। আপন ঘরে বেশি করে ভাত খাবি।” বলিয়া হাসিতে চেষ্টা করিল– কিন্তু হাসি আসিল না, শুধু পটপট করিয়া কুলগুলাের বোঁটা ছাড়াইয়া চলিল।
মা কামিনী ভিক্ষা হইতে ফিরিয়া তারি পানে চাহিয়া কহিল, “ওমা গাে, এখনও উনানের মুখে কাঠ পড়ে নাই, জলের ঘড়া ঢন করছে, এ কি?- বলি- হলাে কমলি, তাের রীতিকরণের কি বল দেখি।”
কমলি অহেতুক ঝঙ্কার দিয়া কহিল,-“পারবাে না। আমি পারবাে না আমি পিরবাে না না হয় খেতে নাই দিবি।” বলিতে বলিতে সে কাদিয়া ফেলিয়া কহিল “শুধুই বকুনি, শুধুই বকুনি, যার যত রাগ আমার ওপর। কেন আমি করেছি কি?” মা মেয়ের কান্নার মমতায় গলিয়া— তার পিঠে হাত বুলাইয়া কহিল, “কিছু তাে বলি নাই মা আমি, বলেছি বুড়াে মানুষ, তেতে-পুড়ে এলাম,এখন আবার জল-আনা।” কমলি চোখের জলে ভরিয়া হাসিতে হাসিতে ঘড়াটা কাধে তুলিয়া কহিল, “ঠাণ্ডা হও, তুমি, জল আনছি আমি”
কমলি চলিয়া যাইতে আসিয়া পড়িল হরি মােড়ল, রঞ্জনের বাপ। সে যে এই অবসরটুকুর প্রতীক্ষাতেই কোথাও দাঁড়াইয়া ছিল। আসিয়াই সে কমলির মায়ের দুটো হাত চাপিয়া ধরিয়া কাকুতিভরে কহিল—“কামিনী, তাের সন্তান আছে, আমার সন্তান আমাকে ফিরে দে, আমাকে বাঁচা কামিনী।”
কামিনী সবিস্ময়ে হাত দুটো ছাড়াইয়া লইয়া কহিল, “হল কি, কি হল মােড়ল!” মােড়ল সমস্ত কহিয়া শেষে চোখের জল ফেলিয়া কহিল, “সে বলে বিয়ে করবে না, বােষ্টম হবে বলে বাড়ি থেকে চলে এসেছে।”
কামিনী কহিল, “এতদূর হয়ে থাকলে এখন ছাড়াছাড়ি হলে আমারই মেয়ের সুখ হবে মােড়ল? আমাকে কি মা হয়ে মেয়ের বুকে শেল হানতে বল—তুমি সন্তানের পিতা হয়ে?”
হরি মােড়ল কহিল—“টাকা দোব আমি, তােমার মেয়েকে দু’বিঘে সম্পত্তি দোব!” কামিনী বাধা দিয়া কহিল-“ছিঃ, আমার মেয়ের কি ইজ্জৎ নাই?” হরি মােড়ল আরও কাকুতি করিয়া কহিল-“হরি, হরি— তা হলে জিভ খসে যাবে আমার!”
কামিনী কহিল—“যাও মােড়ল, আমার মেয়েকে নিয়ে আমি কিছুদিন সরে যাব, ছেলেকে তুমি বিয়ে দিয়ে বাগিয়ে নিয়াে–!” সহসা বাইরে বেড়ার পাছে একটা শব্দ হইল—‘ঢ’। কামিনী ছুটিয়া বাহিরে যাইতে যাইতে কহিতেছিল, “কে, কে, কমলি-না-কে?”
সত্যই সে কমলি। তাহার কাধের কলসীটা খসিয়া পড়িয়া ভাঙিয়া গিয়াছে, আর সে সিক্তবস্ত্রে দাঁড়াইয়া কাঁপিতেছে।
হরি মােড়ল ত্রস্তপদে অপরাধীর মত পলাইয়া গেল। স্নেহ-তরলকণ্ঠে মা কহিল, “ভেঙে গেল,—যাক! আয় ভিজে কাপড় ছাড়বি আয়!” কমলি মৃদু হাসিয়া কহিল,-“না জল আনি।”
কামিনী কহিল—“সেই বেশ, চল মায়ে-ঝিয়ে দু-ঘড়া জল নিয়ে আসি!” পথে যাইতে যাইতে কমলি কহিল, “মা!”
“কি রে?”
“রাসে নবদ্বীপের মেলা, নবদ্বীপ চল না, মা। ও গাঁয়ের ক’টি লােক যেতে যেতে বলছিল, তারা যাবে।”
কামিনীর কথা ফুটিল না; চোখের শিরা কয়টা রুদ্ধ জলে টলটল করিয়া উঠিল। কমলি আবার কহিল—“যাবে মা!”
কামিনী কহিল,-“যাব।”
ফিরিবার পথে সহসা কামিনী কহিল,—“ফিরিয়াই বিয়ে দোব তাের, নবদ্বীপে চাদের মতাে চাদ খুঁজে নিয়ে আসব আমি।”
মেয়ে কহিল,-“না।”
চপলা আজ সবলা ধীরা তাহার কথা আজ যেন হাসিয়া উড়াইবার কথা নয়, উপেক্ষার নয়।
ঘরে কলসী নামাইয়াই আবার সেই চাপা চটুল চরণে কমলি বাহিরের পানে পথ ধরিল। মা কহিল—“কোথায় যাবি আবার?”
“নবদ্বীপ যেতে হবে, বলে আসি বাবাজীকে—” বলিয়া সেই খিলখিল হাসি। কামিনী কিন্তু ওই হাসির অন্তরালে অশু-সাগরের সন্ধানের পাইল। তাহার ছােট কয়টা ঢেউ তাহার চোখে উথলিয়া আসিয়া পড়িল; ওই সন্ধান যে দিল, তাহার মনের সেই অন্তর্যামীও বুঝি-বা দু-ফোটা চোখের জল ফেলিলেন। ক্ষণপরেই রসিক দাসকে পাড়াইয়া লইয়া কমলিনী হাজির। মাকে কহিল, “এই নাও, বললে বিশ্বেস করে না, তুমি বল তবে হবে।”
কামিনী কহিল, “বস মহন্ত, বস। কথা আছে, শােনাে। কমলি, যা তাে মা, ওদের বাড়ি থেকে খানিকটা নুন নিয়ে আয়।”
কমলিনী মাথা নাড়িয়া কহিল, “ওইতাে ভাড়ে সের দরুনে নুন রয়েছে।” “তুই যা না, ওতে হবে না”
“ওতে না হলে মন দরুনে নুনেও তােমার মরণ হবে না,আমি পারব না।” —“যাও না মা খানিকক্ষণ বেড়িয়ে এস,-মায়ের কথা শুনলে বুঝি পাপ হয়?” এবার কমল হাসিয়া কহিল, “বল না মা তুমি, কমল তােমার শুকোবে না।” কামিনী হরি মােড়লের কথাগুলাে কহিল, কহিতে পারিল না রঞ্জনের কথা। তাহার জাত দিবার কথা, তাহার গৃহত্যাগের কথা।
কমলিনী সেটুকু পূরণ করিয়া দিয়া কহিল—“সে বলেছে, সে বিয়ে করবে নাজাত দেবে। মহন্ত, মা-বাপের ছেলে মা-বাপের থাক, চল আমরা চলে যাই।” গান ধরিয়া দিল-
রসিক দাস কহিল, “তা হলে কাল সকালেই,—কি বল রাই-কমল?”—বলিয়া সে “গােরা সেরা গােরাচাদ চল দেখে আসি সখি—” কমলি সুর করিয়া কহিল—“গান ভালাে লাগছে না—বগ-বাবাজী।” গান থামাইয়া রসিক দাস কহিল,-“তবে আমি পোঁটলা বাঁধছি, তােমরাও বাঁধ।” কিন্তু রাস্তায় বাহির হইয়াই সে আপন মনে গান ধরিল— “মথুরাতে থাকলে সুখে আসতে তারে বলিসনে গা— তাতে মরণ হয় যদি মাের সুখের মরণ জানি সে গাে।”
নবদ্বীপে কামিনী যেন বাস করিবার মতােই জাকিয়া বসিল। আখড়া কিনিল। সকাল সন্ধ্যায় আখড়ায় গান হয়, বৈয়ব মহন্তদের নিমন্ত্রণ করে। রসিক দাস কহে—“এ চাঁদের হাট বসিয়ে দিলে গাে রাই-এর মা! আহা,– কি সব সুন্দর চেহারা, গােরা চান্দের দেশের রূপই আলাদা।” কমলিনী কহে—“তাহলে গঙ্গাতীরের রূপে তুমি মজেছ, এইবার ভালাে দেখে একটি বােষ্টমী করে ফেল।” বলিয়া মুখে কাপড় দিয়া হাসে। রস-পাগল রসিকের একটু যেন লজ্জা হয়, সে কহে- “রাধে, রাধে, রাধারাণীর জাত, কৃয়পূজার ফুল। কি যে তুমি বল রাই-কমল-
কমলিনী কহে—“তা পেসাদী মালা গলায় পরাও চলে, পায়ে না মাড়ালেই হল। তা-কি বল।”
‘তােমার কথা বল?”
“কি শুধাচ্ছ বল-
“নবদ্বীপ কেমন?”
কমলিনী মাথা নাড়িয়া সর্বদেহে মনে অস্বীকার করিয়া কহে—“ভালাে নয় বগ-বাবাজী। ক্ষণপদে কহে—“তবে গঙ্গা ভালাে।”
প্রবল বিস্ময়ে রসিক দাস কহে—“অমন সােনার গােরায় তােমার মন উঠল না।” —“না বগ-বাবাজী, তবে হ্যা ঐ রূপের সত্যি মানুষটি যদি পেতাম তবে পায়ে বিকোতাম তা ঠিক।”
এবার রসিক দাসের রস যােগাইল, সে কহিল—“রাই-কমল রঞ্জনকে ভুলে,——” কমলিনী হাসিয়া কহিল—“তা সােনার মােহর পেলে কে রুপাের আধুলি ভােলে না।
বল?”
“তবে রাই-কমল, আধুলি-টাকার তফাতের লােকও তাে রয়েছে। টাকাটা নিয়ে আধুলির মায়াটা ছাড় না!”
“সাধে কি বগ-বাবাজী বলি, চুনাে পুঁটিতেও তােমার লােভ। ওটুকু তফাতে আমার মন ওঠে না,—অত লােভ আমার নাই।”
কামিনী কোথায় আড়াইয়া বসিয়া কন্যার মনের কথা শুনিতেছিল। কেহ দেখে নাই, সে থাকিতে পারিল না, বাহিরে আসিয়া কহিল, “তা বলে টাকা-আধুলির উলটো কদরও কেউ করে না মা, তােমার সবই আদিখ্যেতা—হ্যা।” কমলিনী আড়ি পাতিয়া ধরা-পড়া তরুণীটির মতাে হাসিয়াই সারা। সে হাসিতে মা রাগিয়া কহিল,-“মরণ, এতে হাসির কি পেলে,—হাসছিস যে?” কমলিনী মুখে কাপড় দিয়ে হাসিতে হাসিতে কহিল,-“মর পােড়ার মুখ, আড়িয়ে-বাড়িয়ে মেয়ের মনের কথা শােনা হচ্ছিল! তা শুনেছিস যখন, তখন শােন, -ঢেপা, হাঁদা টাকার মালা গলায় না পরে যদি কেউ প্রণামী আধুলির মালাই পরে তাতে নিন্দের কি আছে? ওখানে তাে ঘরের কথা, চলে না—ও রুচির কথা। নইলে টাকা-আধুলির উল্টো কদরও করি না আমি,-সমান কদরও করি না; কাকে আমি হেনস্থা করি বল?”
সত্যই কমল কাহাকেও হেনস্তা করে না, হাসিমুখেই সবার সাথে কয়, সকলকেই আগ বাড়াইয়া লয়।
কমলিনী যখন বসিয়া কি ভাবে—তখন সুন্দর সখা আসিয়া কহে—“রাইকমলিনী, বিমলিনী কেন গাে?”
সকল ভাবনা ফেলিয়া কমলিনী হাসিমুখে কহে—“গােষ্ঠের বেলা যায় যে সখা, তাই ভাবছি বাছনি বুকে সুন্দর সুবল সখা আমার এল না কেন এখনও ?” সুবল সখা বুঝি মরমে মরিয়া যায়, সে কমলিনীর হাত ধরিতে হাত বাড়ায়, সে হাত কাঁপে, আর কহে—“সখি!”
কমলিনী মৃণালের মতােই লীলায়িত ভঙ্গীতে দেহখানি বাঁকাইয়া সরিয়া গিয়া কয়—“ছি, এই কি সুবল সখার কাণ্ড!”
সুবল সখা লজ্জায় পলাইতে, কমলিনী হাত ধরিয়া সাদরে কহে,—“বাঃ, চলে যাচ্ছ যে—”।
সুবল ফেরে,—কিন্তু দৃষ্টি তুলিতে পারে না; কমলিনী তাহার হাতদুটি ধরিয়া কহে—“তুমি আমার সত্যি সুবল সখা,-বেশ।” সুবল এবার মুখ তুলিয়া আকুণ্ঠিত দৃষ্টি চাহিয়া কহে-“বেশ!”
দিনে দিনে মাস কাটিয়া গেল, মাসে মাসে বৎসর পূর্ণ হইয়া গেল, তবু কামিনী নবদ্বীপের বাস উঠাইল না,কহিল,-“আর কেন,—চলে তাে যাচ্ছে দিন,শেষ দিন কটা আর—এইখানেই কেটে যাক্।
কমল-কোরক দিনে দিনে আজ পূর্ণ-প্রস্ফুটিতা, পূর্ণতার গাম্ভীর্য, সে চাপা চাপল্যটুকু আজ পূর্ণ ফোটা কমলের দোদুল দোলার লীলায়িত ভঙ্গীতে রূপ নিয়াছে; আপনার পানে আপনি চাহিয়া কমলিনী আপনাকে একটু মন্থর করিতে চেষ্টা করে–লজ্জাও হয়, আবার স্বভাবের চটুলতাও মরে না; সে চটুল লজ্জায় রূপ অপূর্ব। রসিক দাস সে রূপ দেখিয়া বিভাের হইয়া যায়, মাঝে মাঝে গুনগুন করিয়া গায়“ঢল ঢল কাচা অঙ্গের লাবনি
অবনী বহিয়া যায়,
অবনী বহিয়া যায় রে।”
কমল ভূকুটি করিয়া বলে,-“বলি, বয়স হল কত ?”
রসিক এক গাল হাসিয়া বলে,-ভােমরা বয়স মানে না রাই-কমল, আমরণ ফুলের রূপের বন্দনা গেয়েই বেড়ায়।”
কমল ঝঙ্কার দিয়া উঠে—“বেশ, তুমি থাম মহন্ত।”
রসিকের সে হাসি মিলায় না,—কহে, “আমি না হয় থামছি, কিন্তু তুমি মহন্ত নামটি ছাড় দেখি।”
কমলিনীর হাসি শুরু হয়, চাপা হাসিতে মুখ তুলিয়া সকৌতুকে সে কয়,-“কেন, তুমি মহন্ত নও নাকি?”
খুব জোরে মাথা নাড়িয়া মহন্ত কহে,—“না!”
“তবে তুমি কি?”
এবার কমল মুখে কাপড় চাপা দেয়।
রসিক কহে,—“আমি রাই-কমলের বগ-বাবাজী।”
চাপা কাপড় ঠেলিয়া তরুণী-কণ্ঠের অবাধ্য হাসি জলকলধ্বনির মতাে বাহির হইয়া আসে। অবাধ্য রসিক গানটির পাদপূরণ করে, “ঈষৎ হাসির তরঙ্গ হিল্লোলে মদন মূরছা যায় রে, মদন মূরছা যায়।”
কামিনীর শেষ ইচ্ছা পূর্ণ হইল। সে নবদ্বীপেই দেহ রাখিল। হয় নাই বেশি কিছু, —সামান্য জ্বর, তাও বেশি দিন নয়—চার দিন।
শেষের দিন কামিনী কহিল, “মরণে আমার দুঃখ নাই মহন্ত, গােরাচান্দের চরণে, মা গঙ্গার কোলে এ সুখেরই মরণ আমার; তবে রসিক বাধা দিয়া কহিল—“মিছে ভাবছ কেন রাই-এর মা, কি হয়েছে তােমার” কামিনী হাসিয়া কহিল,-“হয়েছে সবই, মরণের সাড়া আমি পাচ্ছি, আমার মনে হচ্ছে কি জান! আমি যেন তােমাদের হতে দূরে অনেক দূরে চলে যাচ্ছি। শােন, মরণে আমার খেদ নাই, শুধু মেয়ের ভাবনা আমার, মহন্ত।” চোখের জলে রসিকের বুক ভাসিয়া গেল,—সে কহিল, “ভেবাে না তুমি, তাই যদি হয়, রাই-কমলের ভার আমি নিলাম।”
কামিনীর মুখে হাসি ফুটিল, সে কহিল,-“সে আমি জানি মহন্ত, কিন্তু—কই–কমলি কই?”
কাদিতে কাদিতে কমল মায়ের বুকে মুখ রাখিয়া কহিল,-“মা!” কামিনী হাসিয়া অবশ হস্ত মেয়ের মাথায় বুলাইয়া কহিল, “কাদিস না বেটী, মা কি চিরদিন কারও থাকে রে?”
কমলিনী তবু কাদিল, মা অবশ হস্তপরশ বুলানাের মাঝে কহিল—“শােন, যাবার সময় আমায় নিশ্চিন্তি কর” কমলিনী কহিল—“বল- “শােন, যে লতা গাছে জড়ায় না, সে চিরদিন ধূলায় গড়াগড়ি যায়, জানােয়ারে ” কমলিনী ব্যগ্রভাবে কহিল, “মা কষ্ট হচ্ছে তােমার, চুপ কর তুমি,আমি বিয়ে করব।” কামিনী একটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিল,-“আঃ!” তারপর সে দুটি কথা কহিয়াছিল—কহিল, “বাপমায়ের ছেলে কেড়ে নিস্ না যেন।” কমলিনী শপথ করিল—“না,না,না।”
মহন্ত তখন নাম আরম্ভ করিয়াছে, “জয় রাধে, রাধে-” কামিনী কহিল—“গােবিন্দ গােবিন্দ!”
কালের তালে তালে ঘুম পাড়ানীর গানের মতাে বিস্মরণীর গান গাহিয়া মাটি-মা-মানুষের দুঃখ ভােলায়—কমলিনীও দিনে দিনে মায়ের শােক ভুলিল,—আবার হাসিল, কীর্তন গাহিল। ব্যথাতুর শিশু বেদনার উপশমে কাঁদন ভুলিয়া হাসিলে মায়ের মুখে হাসি ফুটে, রসিক দাসের মুখে সেই হাসি ফুটিল। একদিন রসিক দাস কহিল-
“রাই-কমল, তাহলে—” কথাটা বলিতে যেন তাহার বাধিতেছিল।
আরও পড়ুনঃ বড়দের গল্প একান্ত গোপনে
এই কুণ্ঠা দেখিয়া কমলিনী হাসিয়া কহিল, “কি তাহলে,—বলই না গাে,বগ-বাবাজীর গলায় কি কাটা আটকেছে না কি?”
রসিক দাস গলাটা খাঁকি দিয়া ঝাড়িয়া কহিল,-“না—তা।” কমলিনী হাসিয়াই সারা।
কমলিনী এবার চট্ করিয়াই বলিয়া ফেল—“তােমার বিয়ের কথা কমলিনী গম্ভীর হইয়া গেল, খানিক একদৃষ্টে চাহিয়া রহিয়া কহিল,—“কাটাই আটকেছে বটে,-আচ্ছা এ বেলাটা সবুর কর মহন্ত, ও বেলায়”
কথাটা সে শেষ না করিয়াই ঘরে গিয়া বসিল; সারাটা দিন আর সে বাহির হইল না। কথার মালা—যাহারা উচ্চারণান্তেই মহাশূন্যে অদৃশ্য হইয়া যায়, তাহাতেও কি মানুষকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধে! এ পাশ যে ছিড়িবার উপায় নাই। তাহার অন্তরাত্মা অনির্দিষ্ট লােকের উদ্দেশ্যে কাতর প্রার্থনা জানায় “মা, মা—কথা ফিরিয়ে নে গাে মা!”
উত্তর আসে না, উপায়হীনা নারী বিশ্বদরদীর পায়ে মাথা কুটে। “এ মনহীন দেহ কাহাকে দিব,কেমনে দিব! অথচ দিতে হইবে, একি তােমার বিধান?” উত্তর আসে না, কমলিনীর মন মানুষের রাজ্যে ফিরিয়া আসে,-সে খুঁজিয়া বেড়ায়, কাহাকেও এ বঞ্চনা করিবার তাহার অধিকার আছে!
রসিক দাস সারাটা দিন বাহিরে বসিয়া কোনাে অনির্দিষ্ট ভাবনা ভাবিয়া কাটাইয়া দিল। রসিক বসিয়াছিল—পূর্বমুখে, সন্ধ্যার স্বর্ণাভা মুখে মাখিয়া কমলিনী তাহার সম্মুখে দাঁড়াইয়া ম্লানহাসি হাসিয়া কহিল।
“মালার তরে যে ফুল চাই মহন্ত !”
রসিক পরম আনন্দে সঙ্গে সঙ্গে উঠিয়া কহিল—“নিয়ে আসি।” কতক্ষণ পরে সিক্তবস্ত্রে রসিক ফিরিয়া কহিল—“রাই-কমল,কমল ফুলই এনেচি, -” কথাটা সে সম্পূর্ণ করিতে পারিল না কমলের রূপ দেখিয়া—এলানাে চুলের রাশি, পরনে টকটকে রাঙাপাড় তসরের শাড়ী, নাকে ক্ষীণরেখায় আঁকা শুক্লা প্রতিপদের চন্দ্রকলার মত রসকলি, কপালে সন্ধ্যার গােধূলি-তারার মতাে শুভ্র টিপ, আভরণ নাই, কিন্তু তাই যেন অনেক!
কমলিনী কহিল, “রাখ, আমি চন্দনটা ঘষি, ওই কাপড়টা ছাড় দেখি, কাপড় রেখেছি।” রসিক দেখিল, কমলিনীর শখ করিয়া কেনা ফিতাপাড় শান্তিপুরে কাপড়খানি; পরমানন্দে কাপড়খানা পরিতে পরিতে কহিল,-“শিরােপা যে মজুরির চেয়েও দামী গাে; তারপর হুকুম কর, সুবল সখাকে ডাকি।”
কমলিনী মালা গাঁথিতে গাঁথিতে কহিল, “আর একগাছি মালা গাঁথ দেখি আগে।” পরম কৌতূকে রসিক মালা গাঁথিতে বসিয়া কহিল, “খুব ভালাে হবে রাই-কমল, সুবল-সখা আসামাত্র পরিয়ে দেবে।”
কমলিনীর মালা যত শেষ হইয়া আসে তত সে তাগিদ দেয়—“বলি আর দেরী কত, আমার শেষ হল যে।”
রসিক রসিকতা করিল, “রাই ধৈর্যং” তারপর সুতার গিঠ বাঁধিতে বাঁধিতে কহিল“আমারও মালা তৈরি গাে।”
কমলিনী আপন হাতের মালাটি রসিকের গলায় পরাইয়া দিয়া প্রণাম করিয়া কহিল, -“এইবার তােমার মালা আমায় দাও।”
অতর্কিত রসিক দাস আর্তস্বরে কহিল—“কি করলে রাই-কমল?” কমলিনী সুন্দর হাসি হাসিয়া কহিল—“মালার প্রসাদ দেবে না আমায়?” বলিয়া চন্দন লইয়া রসিকের জরাজীর্ণ পাণ্ডুর ললাট চৰ্চিত করিয়া দিল। এবার রসিক দাস হাসিল, সে আপন হাতের খসিয়া-পড়া মালাগাছি তুলিয়া কমলের গলায় পরাইয়া দিয়া তাহার সুন্দর মসৃণ ললাটে সুন্দর করিয়া সুবঙ্কিম অলকা-তিলক আঁকিয়া দিল। আঁকিতে আঁকিতে সে গাহিতেছিল—
“কৃপূজার কমল আমি রেখে দিব মাথার পরে—”
কমল লীলাকৌতুকে কহিল, “হল তােমার? এবার আমি বাসর সাজাই।” রসিক কহিল, -“না গাে রাই-কমল, বাসর সাজাব আমি; আমাদের লীলা উল্টো—এ লীলায় তুমি কাদবে, আমি কাঁদবো
রসিক দাস বাসর সাজাইল—একদিকে টাটকা ফুলে আর একদিকে শুকনাে ফুলে, কমলিনীকে কহিল, “তুমি আর আমি।”
কমলিনী কহিল—“তার চেয়ে আঙারে সাজালে না কেন?”
রসিক অপ্রস্তুতের হাসি হাসিয়া কহিল, “না না, শুকনাে ফুল ফেলে দি।” বাধা দিয়া কমলিনী কহিল, “না ওই থাক,” বলিয়া সে গিয়া শুকনাে শয্যার পরে বসিল— কহিল, “তােমার তাে শয্যে হবে না, হবে আমার,টাটকা শয্যে তােমার।” বলিয়া খিল খিল হাসি।
রসিক দাসের সমস্ত বুক গুর গুর করিয়া উঠিল, একটা ক্ষীণ কাপনে দেহ কাঁপিতেছিল, সে পিছাইয়া কহিল- “রাই-কমল থাক।”
কমলিনী ম্লান হাসি হাসিয়া কহিল, “যা, করতে হয়, তা না করলে কি চলে? আর আমার বিয়ের একটা সাধ-আহ্লাদও তো আছে!”
রসিক শয্যার পরে বসিয়া কমলের হাতখানি আপন হাতে লইয়া কহিল, “রাই-কমল, আধুলির বদলে শেষে আধলার মালা গলায় বাঁধলে।”
কমলিনী কহিল—“সােনায় তামায় বড় ধাঁধা লাগে গাে; সােনা বলেই তাে গলায় গাঁথলাম, তামা যদি হয় তবু জানব ওই আমার সােনা। সােনা-তামার তফাত তাে মনের ভুল।”
রসিক কমলের মুখখানি পরিপূর্ণ আলােকে তুলিয়া ধরিল,—দেখিয়া দেখিয়া আশ যেন মিটে না!
কমল হাসিয়া কহিল, “বগই বটে তুমি, গাল নিয়ে ওকি হচ্ছে?” রসিক দাস সহসা প্রবল আকর্ষণে কমলিনীকে বুকে টানিয়া লইল,কমলিনী ছাড়াইবার ব্যর্থ প্রয়াস করিয়া পারিল না— ওই শীর্ণ বাহুতে যেন মত্ত-হস্তীর বল, কঙ্কাল যেন ফঁসির দড়ির মত দৃঢ়। সে আর্তকণ্ঠে প্রার্থনা করিল, “মহন্ত মহন্ত!” প্রভাতে উঠিয়া মহন্ত যেন পাষাণ হইয়া গেল। নিশ্চল, মূক, স্থির শূন্যদৃষ্টি, নয়নের কোলে কোলে আঁকা শুধু রজনীর অন্ধকারে ঝরা অশ্রুধারার রেখা!
কমলিনী সে মূর্তি দেখিয়া শিহরিত হইয়া উঠিল, কতবার সান্ত্বনার কথা কহিতে গিয়াও সে পারিল না, জিহ্বাগ্রে আসিয়া বাক্য যেন নিস্পন্দ হইয়া গেল; সেও আড়ে আড়ে ফিরিল।
রসিক দাসই আগে কথা কহিল, “কমল!”
ডাকটা কমলির কানে যেন কেমন ঠেকিল—যেন খাটোখাটো; কমলি সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল।
মহন্ত কাকুতি ভরা কণ্ঠে কহিল—“কমল, আমি মানুষ।” অসমাপ্ত কথা —কিন্তু অর্থ স্পষ্ট।
কমলি উত্তর দিল—“কেউ পাথর নয়, তবে তুমি আজ পাথর হয়েছ দেখছি।” কঁদন যেন সুরে ঝরিয়া পড়িতেছিল, মহন্ত কহিল, “অহল্যার মতাে পাষাণই বুঝি হলাম, কমল!”
কমলি কতকালের গৃহিণীর মতাে অঞ্চলে মহন্তর অশু মুছাইয়া দিয়া কহিল,“এ দায়ের মালা তুমি ছিড়ে ফেল মহন্ত ?”
মহন্ত কহিল, “না।”
কমলি কহিল, “আমার তরে তুমি ভেবাে না।”
আক্ষেপের সুরেই যেন মহন্ত কহিল, “না, পারব না, পারি নাই, কাল রাতে পালাতে গিয়ে পারি নাই—পা উঠছে, চোখ ফেরে নাই।” বলিয়া সে কমলের দুটি হাত ধরিয়া কাকুতি করিয়া কহিল, “তুমি যেন আমায় ছেড়াে না কমল!”
আজন্ম কুমার বৈরাগীর বুকের ক্ষুধা—এতদিন ঘুমন্ত জনের বুকের ক্ষুধার মতাে অবিচলিত ছিল। আজ আহার্য সম্মুখে ধরিয়া তাহাকে জাগানােয় সে ক্ষুধা রাক্ষসের গ্রাস বিস্তার করিয়া বসিল।
সে গ্রাস দেখিয়া তাহার আজন্ম সাধনার বৈরাগ্য শিহরিয়া উঠিল; বৈরাগ্যের পরাজয়ে বৈরাগী যেন মরিল। রসিকের যে রসের উৎস কোথায় শুষ্ক হইয়া গেল,—শুকসারীর গান আর জমে না, রসের গান আর সে গায় না।
এই গুমােট কমলিনীরও অসহ্য হইয়া উঠল, তার যেন শ্বাস রুদ্ধ হইয়া আসিতেছিল। সে একদিন কহিল, “এতাে আর ভালাে লাগে না মহন্ত।”
রসিক চমকিয়া উঠিল, বিবর্ণ মুখে নিস্পলক দৃষ্টিতে কমলির মুখপানে সে চাহিয়া রহিল। কমলিনী আবার কহিল—“চল কোথাও যাই।”
রসিক যেন একটু জীবন্ত হইয়া উঠিল, ঘর যেন তাহার বিষ হইয়া উঠিতেছিল, সে কহিল, “তাই চল কমল, তাই চল, কোথায় যাবে বল দেখি?”
কমলি কহিল, “বৃন্দাবন।”
শিহরিয়া রসিক কহিল, “না—ব্রজের চাদকে এ মুখ দেখাতে পারব না।” কমলিনীর মরিতে ইচ্ছা করিল, আপনার পানে চাহিতে তাহার ঘৃণা হইতেছিল—সে মহন্তকে কহিল, “আমার মাঝে কি এতই পাপ আছে, মহন্ত?” রসিক কথার উত্তর দিতে পারিল না। অপরাধ-নত মস্তকে মাটির পানেই চাহিয়া রহিল। কমলি চোখ মুছিতে মুছিতে আবার কহিল, “বেশ কোথাও গিয়ে কাজ নেই, পথেই ঘুরব শুধু।” রসিক কহিল, “তাই চল আজই—” সে উঠিয়া দাঁড়াইল। কমলি হাসিয়া কহিল, “উঠ বললেই-কাধে ঝুলি! ঘর দোর” রসিক কহিল, “থাক, থাক্-পড়ে থাক, ঘর যখন আর বাঁধব না ঘর তখন আর সাথে নিয়ে কি হবে?”
কমলি কহিল, “যা খুশী তােমার তাই কর—
পরাজিত বৈরাগী মুক্তির আশায় কাধে ঝােলা তুলিয়া মাথায় নামাবলী বাঁধিতে বাঁধিতে কত কাল পরে আজ অভিসারের পথ ধরিল।
ঘর ছাড়িয়া পথে দাঁড়াইয়া বৈরাগী যেন হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিল। কমলির সুবাস সে পায়, কিন্তু কমল-মৃণালের পাশ আর সহিতে হয় না; সে যেন এইটুকুই চাহিতেছিল।
বাজারের গ্রামের মুখে পথের পাশে পুকুরের ঘাট দেখিয়া পথবাসী নরনারী দুটি ঘর পাতিল; কমলিনী স্নান সারিয়া রন্ধনের ব্যবস্থায় বসিয়া গেল, “ঝুলির ভাড়ারে নুন নাই যে গাে বৈরাগী ঠাকুর—”
মহন্ত নুন আনিতে গেল-নুনের ঠোঙা হাতে ফিরিয়া দেখে কমলিনীকে ঘেরিয়া দর্শকের দল। পরম কৌতুকে মহন্ত দর্শকদের পিছনে দাঁড়াইয়া কমলিনীকে দেখিল, হ্যা দেখিবার রূপ বটে, ভিজা এলােচুল—ভাঁজ করিয়া মাথায় তােলা, নাকে রসকলি, কপালে তিলক; অনিন্দ্য রূপ; দর্শকদের দোষ দিতে পারিল না সে! একটু গর্বও হইল তাহার, এ হেন কমল-মালার মালিক সে!
দর্শকের দল শুধু দেখিয়া নিরস্ত ছিল না, প্রশ্নের আর অন্তও ছিল না। কিন্তু প্রশ্নের জবাব ছিল না, কমলিনী আপন গরবে গরবিনীর মতই বসিয়া ছিল এদিকে তাহার ভূক্ষেপই নাই।
একজন বার বার শুধাইতেছিল—“কি নাম গাে, বধুমীর ঘর?” পিছন হইতে রসিক উত্তর দিল, “নাম রাই-কমল-বাস ওর রসকুঞ্জে।” কথার শব্দে পিছন ফিরিয়া সকলে রসিক দাসের পানে চাহিল। মাঝখান থেকে কে কহিল, “ও আবার কে হে?”
রসিক কমলিনীর পাশে আসিয়া সেই লতার লাঠিটা ঠুকিয়া কহিল, “আজ্ঞে আমার নাম— খেটে হাতে আয়ান ঘােষ গাে প্রভু, বােষ্টুমীর বােষ্টম গাে আমি।” দর্শকের দল খসিতে শুরু করিল।
মহন্ত হাসিয়াই সারা— নির্জীব বৈরাগী যেন আজ বাঁচিয়া উঠিল; আপন মনে গুনগুন করিতে করিতে সহসা কহিল, “রাই-কমল।”
কমল ম্লান হাসিয়া কহিল, “তবু ভালাে, আজ কতদিন পরে রাই-কমল বলে ডাকলে!” ঘর ছাড়ার কোন্ আনন্দে বৈরাগী আজ মাতােয়ারা কে জানে,-রসিকের শুষ্ক রসসায়রে আজ যেন বান ডাকিল, স্মিতহাস্যে কৌতুকোজ্জ্বল নয়নে কহিল—“তুমি ভালাে, রাই-কমল, মানই তুমি কর আজ, গেরস্তের দুয়ারে দুয়ারে আমি মানের পালা গাইব।” কমল হাসিয়া কহিল, “গান তুমি গাইতে পার, কিন্তু মান তাে ভাঙাতে পারবে –লজ্জা—পাপ-” খুব জোরের সহিত বৈরাগী কহিল, “খুব পারব গাে রাই-মানিনী,—খুব পারব, পাপ লজ্জা ঘরেই ফেলে এসেছি আমি, তাই তাে আজ আবার তুমি আমার রাই-কমল!” মায়ার টানে না পথের ফেরে কে জানে, পথের মানুষ দুটি আসিয়া উঠিল, আপন গ্রামের প্রান্তে রস-কুঞ্জের দুয়ারে। দুয়ার বলিলে ভুল হইবে, রস কুঞ্জের ধ্বসিয়া পড়া। ভিটার প্রান্তে।
মনের কোণে মমতায় কোথায় লুকান ছিল কেন জানে, বৈরাগীর চোখে জল আসিল। কমলাকুঞ্জের অবস্থাও তাই, তবে অটুট আছে এখনও জোড়া-লতার কুঞ্জটি। কিছু বেশি ঘন হইয়াছে মাত্র। আর তলের রাঙা মাটিতে নিকাননা ক্ষেতটির পরে জাগিয়েছে। সবুজ ঘাসের আস্তরণ।
পথ-বাসী মানুষ দুটি সেই ছায়াতলে বসিল।
কমল কহিল—“বড় মায়া হচ্ছে মহন্ত, থাকতে মন চাইছে।” রসিক দাস তখন আপন মনে গান ধরিয়াছে— “বহু পরে বঁধুয়া এলে দেখা তাে হত না পরাণ গেলে গানের শেষে মহন্ত কহিল, “আর যাব না রাই-কমল। বাতাসে মাটিতে আমাকেও যেন জড়িয়ে ধরছে— তবে আমাকে কিন্তু রস-কুঞ্জে থাকতে দিতে হবে।” কমল হাসিয়া কহিল, “তাই হবে গাে বৈরাগী। তুমি তােমার কুঞ্জেই থাকবে, ভয় নাই তােমার, ধ্যান তােমার ভাঙবে না।”
মহন্ত কহিল, “না—গাে আসব আমি; শাওনের বাদল রাতের ঝুলনে তােমায় দোলাতে আসব,রাসের রাতে ফুলের গয়না নিয়ে তােমার দরবারে আসব আমি; ফাল্গুনের পুন্নিমায় আবীর কুমকুম নিয়ে আসব আমি।” ব্যঙ্গের হাসি হাসিয়া কমল কহিল, “একটি লীলা যে তােমার বাকি থাকল ঠাকুর, —গিরি গােবর্ধন ধারণ!”
মহন্ত কহিল, “সে পলা তাে আগেই সারব আমি, কমলকুঞ্জের চাল ছাইতে বর্ষা নিবারণ তাে করতেই হবে আমাকে, তবে, আমি তাে এ খেলায় সে হয়ে আসব না গাে, আমি হব দূতী!”
কমলিনী কহিল, “ফুলের মালা কি ফাসি হয়েই গলায় লেগেছে মহন্ত যে ছিড়তেই হবে?”
মহন্ত কহিল—“দূর-দূর, বাজে বকে সময় মাটি। বলি ওগাে বােষ্টমী পেটের কথা ভাব– চল দুয়ারে দুয়ারে দুটো মেগে আসি।” বলিয়া সে একতারায় ঝঙ্কার দিয়া উঠিল।
ম্লান হাসি হাসিয়া কমল কহিল, “চল, কিন্তু শাক দিয়ে কি মাছ ঢাকা যায় মহন্ত?” পথে একতারা বাজাইয়া বাউল চলে—চরণে যেন নৃত্য ঝরিয়া পড়িতেছিল, কমল সহসা কহিল, “মহন্ত আর একদিন এই কথাটাই শুধিয়েছিলাম, আজ আবার শুধাই, আমার মাঝে কি এতই পাপ আছে—মহন্ত!”
একতারা নীরব হইয়া গেল, নৃত্যপর চরণের গতি কাটিয়া যায়, মহন্ত উত্তর খুঁজিয়া পায় না।
কমল আপনার পানে চায়, চিকণ উজ্জ্বল ত্বক—ফুলের পাপড়ির মতাে, বুকের নিঃশ্বাসে সে সুরভির আভাস পায়, মন তাহার কহে, “কোথায় পাপ! সে আর প্রশ্ন করিল না, গৃহস্থের দুয়ারে আসিয়া কহিল-“বাজাও মহন্ত একতারা বাজাও।” বলিয়া সে গান করে— দুয়ারে দুয়ারে বৈয়বী গান গাহিয়া ভিখ মাগিয়া ফেরে—গ্রামের জন কুশল শুধায়, মহন্ত গানে উত্তর দেয়- “বল বল তােমার কুশল শুনি,
তােমারই কুশলে কুশল মানি।”
মেয়েরা কমলিনীকে শুধায়, “এ যে লক্ষ্মী ঠাকরুণটি হয়েচিস্ কমলি,-নবদ্বীপের জলের গুণ আছে।”
কমলের মুখ লজ্জিতহাস্যে ভরিয়া উঠে; কথার জবাব দেয় রসিক দাস—“সে যে গােরাচাদের দেশ, রূপের সায়রে গাে!”
কৌতুকচপলা পল্লীনারী কহে, “তা বটে, তােমারও চেহারার জৌলুস হয়েছে দেখচি—” কথার শেষে তাহারা মুখে কাপড় দিয়া হাসে।”
রসিক দাস অপ্রস্তুত হয় না, স্মিতমুখে কহে—“কাল যে কলি, নইলে শুকনাে গাছেও ফুল ফুটতাে।”
মুখের চাপা কাপড় ভেদ করিয়া অবাধ্য হাসি বাহিরে আসে—খিলখিল!
মেয়েরা কৌতুক ভুলিয়া কৌতূহলে মাতিয়া শুধায়, “তা কলি, এখনও সোঁদা আছিস নাকি? তাের বােষ্টম কই লাে?
মহন্তকে এবার লজ্জায় নীরব হইতে হয়।
কমলই জবাব দেয় স্মিতমুখে, “এই যে আমার মহন্ত।” মেয়েরা আবার হাসে, কেহ কহে—“কাল কলি হলে কি হবে মহন্ত, নামের গুণ যায় নাই, শুকনাে গাছে ফুল ফুটেছে।”
মহন্ত কহে, “ভিক্ষে দাও-গো, পাঁচ দোর ফিরতে হবে।” রঞ্জনদের বাড়ির কাছাকাছি আসিয়া মহন্ত কহিল, “রাই-কমল, আজ থাক—দুটো পেট এতেই চলবে।”
কমল কহিল—“বাঃ—তাই কি হয়— আমার লঙ্কার বাড়ি, না গেলে বলবে কি!” এতটুকু দ্বিধার লেশও তাহার কণ্ঠস্বরে ছিল না।
মহন্ত সবিস্ময়ে তাহার মুখপানে চাহিল, আনন্দোজ্জ্বল মুখ, দৃষ্টি সম্মুখের পথে আগাইয়া চলিয়াছে।
দুয়ারের পর দুয়ার মাগিয়া রঞ্জনদের দুয়ারে আসিয়া তাহারা দাঁড়াইল। কমল হাঁকিল, “রাধাকৃয় ভিক্ষে পাই মা?”
সাথে সাথে মহন্ত একতারায় ঝঙ্কার দিয়া উঠিল।
যন্তেক্রর ঝঙ্কারে একটি তরুণী সম্মুখের রােয়াকে আসিয়া দাঁড়াইল, সীমন্তে সিন্দুর—মাথায় অবগুণ্ঠন, গায়ে তাহার লেখা—যেন বাড়ির বধূ সে। চাঁদের উদয়ে কমলদল যেন মুদিয়া গেল!
কমল স্থিরদৃষ্টিতে তাহার পানে চাহিল—তাহার অন্তর্যামী কহিল, “সে পর—সে পর—সে পর।”
তাহার বিভাের মনের মাঝে ছিল সেই আগেকার ছবি—কালের পরিবর্তন সে কল্পনাও করে নাই।
বধূটি হাসিয়া কহিল, “গান গাও গাে বন্ধুমী!”
কমল সেই ভঙ্গীতে কহিল, “তুমি বৌ!”
বধূটি লজ্জিতহাস্যে মুখ ভরিয়া চোখের পলকের ইঙ্গিতে ঘাড় নাড়ার ভঙ্গীতে উত্তর দিল—“হা!”
ওই পুলকিত পলকে, সঘন ঘাড়ের দোলায় কমল বুঝিল, বধূটির আনন্দের অভাব নাই, সে তাহাকে পাইয়াছে।
বড় করুণ হাসি তাহার অধরে ফুটিয়া উঠিল, সে কহিল, “গান শুনবে বৌ?” বলিয়া মহন্ত গান না ধরিতেই সে গান ধরিল—
“সখি বলিতে বিদরে হিয়া!
আমার বঁধুয়া আন বাড়ি যায়।
আমারই আঙিনা দিয়া।”
ফিরিবার পথে মহন্ত কহিল, “চল, রাই-কমল; আজই হেথা হতে ওঠা যাক্।” কমলের বুকের মাঝে তুফান বহিতেছিল, এত বড় বনায় সে বাঁচিবে কি করিয়া!
তবু সে কহিল, “না।”
মহন্ত মুদির দোকানে কয়টা জিনিস কিনিয়া ফিরিয়া দেখিল আখড়ার ভাঙা দাওয়ার উপরে ইটের উনান তৈয়ারি করিয়া ঝরা পাতার ইন্ধনে কমল ফুঁ পাড়িতেছে;-মুখখানা তাহার রাঙা, চোখের জলে নিটোল গাল দুটি চক্ করিতেছে। মহন্ত যেন কেমন হইয়া গেল; একটা প্রবচন আছে—“ছেলে কোলে মরে জলে ফেলব, তবু না পােয্যপুত্র দিব।” বৈরাগীর অন্তরের স্বামীত্বটুকু ঐ ভাবের ঈর্ষায় জুলিতেছিল। তাহার জিহ্বাগ্রে কয়টা কঠিন কথা আসিয়া জুটিল—সে বলিয়া ফেলিল—“বলি, ও চোখের জল ধোঁয়ায় না মায়ায় গাে!” উগ্র ভঙ্গিতে আহতা ফণিনীর মতাে মুহূর্তে কমল মাথা উঁচু করিয়া স্থিরদৃষ্টিতে মহন্তের পানে চাহিল; কিন্তু বিচিত্র নারীর মন, দেখিতে দেখিতে দৃষ্টিতে তীব্রতা তাহার কোথায় চলিয়া গেল, অধরে স্বল্প কঠিন হাসির রেখা ফুটিয়া উঠিল, কমল অতি ধীরে কহিল, “মায়ারই বটে!”
মহন্ত গুম হইয়া বসিয়া রহিল; কতক্ষণ পরে একটা দীর্ঘশ্বাসের সাথে যেন সে গুমােট ঝরিয়া গেল, মহন্ত উঠিয়া কমলের হাত ধরিয়া অতি কোমলকণ্ঠে কহিল, “রাই-কমল।”
কমল হাতখানি টানিয়া লইয়া কহিল, “আমার মাঝে পাপ আছে।” অতি সুন্দর হাসি হাসিয়া মহন্ত কহিল, “না-গাে-না, পাপ কি তােমার হয়, পাপ আমার।”
কমলের বাঁকা মন কথার অর্থটা বাঁকাইয়া ধরিল। সে প্রদীপ্ত হইয়া হাত ছাড়াইয়া লইল।
মহন্ত সকল উপেক্ষা নীরবে মাথা পাতিয়া লইল, তবু তাহার মনের হাসি মিলাইল ,কতক্ষণ পর লতা দুটির ছায়াতলে বসিয়া আপন মনে গুনগুন্ করিয়া গান ধরিল“কহে চণ্ডীদাস শুন বিনােদিনী ।
সুখ দুখ দুটি ভাই- সুখের লাগিয়া যে করে পিরীতি
দুখ যায় তার-ই ঠাই।”
মানুষের যত্নে আখড়া আবার সুখের হইয়া উঠিল, আবার গান জমিল। পাঁচজনে আসিল—সেই ভােলা, বিনােদ, পঞ্চানন।
কত হাসি, কত গল্প, কত গান!
কিন্তু তাহারা আনন্দ করিয়া চলিয়া যায়, ঘরে মানুষ দুটির তরে পড়িয়া থাকে শুধু অশান্তি।
ভােলা আসিলে কমল কহে, “এস ভােলানাথ, গাঁজা তােয়েরী,” বলিয়া হাসিয়া সারা!
ভােলা পরমানন্দে কহে, “কই মহন্ত, দম লাগাও।”
পঞ্চানন আসিলে কমল কহে, “নাম গান কর পঞ্চানন, বলিয়া বাউলের সুরে নিজেই গান ধরিয়ে দেয় “পঞ্চানন পঞ্চমুখে গায় হরি নাম!”
পঞ্চানন গানের জের টানে, গান জমিয়া ওঠে।
আবার ভােলাকে কত বরাত করে, “ভােলা দুখানা কাঠ করে দে—ভাই।” ভােলা কুড়ুল লইয়া কাঠ চেলায়,কখনও রাঙা মাটিও আনিয়া দেয়, অমনি কত বরাত খাটে, আর কমলের দুয়ারেই পড়িয়া থাকে। একা ভােলা নয়, বিনােদ, পঞ্চানন, সবাই। লােকে কত কি বলে, ভােলা, পর মা গালি দেয়। কমলের তাহাতে ভুক্ষেপ নাই; সে প্রতিবাদও করে না, সাথীদেরও কিছু বলে না। কতদিন রাত্রিতে সবাই চলিয়া যায়, মহন্ত পর্যন্ত আপন আখড়ায় চলিয়া যায়—ভােলা আবার ফিরিয়া আসে। কমল কহে-“কি?”
ভােলা কহে, “বলি আর একটু থাকি।”
কমল কহে, “তামুক খাবে, সাজব?”
ভােলা কহে, “ছেলেবেলায় তামুক সাজা মনে পড়ে!” স্বরটা কেমন!
কমল যেন উৎকীর্ণ হইয়া কি শোনার ভান করিয়া কহে, “ওই তাের ছেলে—ডাকচে-” সঙ্গে সঙ্গে সে চেঁচাইয়া মহন্তকে হাঁকে, “মহন্ত—ওমহন্ত, দেখ তাে ভােলার ছেলে কোথা—পথে কাঁদচে!”
মহন্ত নিজের ঘর হইতে আসিয়া কহে, “কই—নাই তাে!”
কমল হাসিতে হাসিতে কহে, “তবে ভােলারও ভুল, আমারও ভুল।” তাহার চলিয়া গেলে কিন্তু কমলের হাসি, কথা আর কিছুই মনে থাকে না। কমল। যেন কঠিন হইয়া পড়ে।
মহন্ত কহে, “রাত অনেক হল, রাই-কমল!” অনুযােগের সুর!
কমল কঠিনকণ্ঠে কহে, “মহন্ত মালা তাে তুমি ছিড়লে পার!” মহন্ত পালাইয়া আসিয়া আপন আখড়ার মাঝে কাঁদিয়া মরে—“তা যে পারি না গাে—তা যে পারি না!”
নিরুপায়ে বৈয়ব অন্তরবাসী গােবিন্দের পায়ে মাথা ঠুকিয়া কাঁদে—“গলার মালা আমার মাথায় তুলে দাও গােবিন্দ, মাথায় তুলে দাও!” পরদিন হইতে মহন্ত পর ডাকিয়া ঘরে আনন্দোৎসব জুড়িয়া দিল। সে উৎসেব আসিল না শুধু একজন, সে রঞ্জন।
ভােলা কহিল, “আজ ডেকেছিলাম মহন্ত, কিন্তু এল না, বললে কি জান?” মহন্ত একতারায় ঝঙ্কার দিয়া কহিল, “কাজ নাই ভাই পরের কথায় নাম কর গে কাজ হবে।”
কমল কহিল, “কার কথা ভােলা!”
ভােলা মুখপানে চাহিয়া রসিকতা করিয়া কহিল, “বলব না—” কমল ভূক্ষেপহীন স্থিরদৃষ্টিতে—তাহার পানে চাহিয়া কহিল, “সে এলাে না?” সে দৃষ্টির সম্মুখে ভােলার আর রসিকতা জোগাইল না, সে শুধু কহিল, “না।” কমল কহিল, “কি বললে?”
ভােলা কাকুতি করিয়া কহিল, “না ভাই কমল, সে তুই শুনিস না!” সাথীর এই অকৃত্রিম মমতার আঘাতে চোখে জল আসিল। সে ছলছল চোখে অধরে হাসি মাখিয়া কহিল, “না—তুই বল!”
ভােলা যেন অপরাধীর মতাে কহিল, “বললে বেনে পুকুরের ঘাটে, তার মুখ দেখলে পাপ হয়, সে মুখ আর দেখবে না – কমলের চোখের পাতার ঘেরে জল আর ধরিল না, কয় ফোটা জল উপচিয়া পড়িল। ভােলা কহিল,-“আর একবার ডাকব কমল!”
কমল কহিল, “ছি!”
রঞ্জন কহিয়াছিল, সে মুখ আর দেখিবে না, কিন্তু সেদিন বেনেপুকুরের বাঁধাঘাটে সে মুখ দেখিয়া সে আর চোখ ফিরাইতে পারিল না।
জনহীন ঘাট; কমল স্নান সারিয়া ভিজা চুল নিঙড়াইতেছে। রঞ্জন ঘাটের উপরে আসিয়া দাঁড়াইল।
সিক্তবস্ত্রে ঘেরা সে-রূপ দেখিয়া রঞ্জনের চোখ আর ফিরিল না। এই কমল,-এত রূপ!
সব দেহে মনে রঞ্জনের যেন আগুন ধরিয়া গেল, সে ডাকিল, “চিনি!” কমল কণ্ঠস্বরে চিনিল, কিন্তু এ রূপ তাহার মনের ছবির সাথে মিলিল না। এ তাে সে কোমল কিশােরটি নয়; নয়নের কোলে এর সে আনন্দ তাে নাই! এ যে সবল যুবা পাথরের মতাে বুক, দৃঢ়বাহু, নয়নে উগ্র ক্ষুধা! নারীর দৃষ্টি আরও দেখিল—ওই বুকের অন্তরালে সুধার সন্ধান তাে মেলে না,—তীব্র বিষ-নীল সে হৃদয়। কমল শিহরিয়া উঠিল—শত চেষ্টাতেও সে ওই উগ্র মূর্তিটিকে তাহার রঞ্জন বলিয়া উত্তর দিতে পারিল না—“লঙ্কা!”
রঞ্জন আসিয়া তাহার অতি নিকটে দাঁড়াইল, তাহার স্নানশীতল অঙ্গে রঞ্জনের নিঃশ্বাস আসিতে-
লাগিতেছিল, তাহার মনে পড়িল মহন্তের সে ক্ষুধার বিষের দাহ!
কমল কলসিটি কাখে লইয়া দ্রুতপদক্ষেপে চলিয়া আসিল, পথে সে হাঁফাইতেছিল। যেটুকু ছিল—সেটুকুও গেল। কি লইয়া থাকিবে সে!
সেদিন সন্ধ্যায় আখড়ার দরজায় রঞ্জন আসিয়া হাঁকিল, “মহন্ত!” রসিকের বুকের ভিতরটা কেমন করিয়া উঠিল; সে মনে মনে গােবিন্দ স্মরণ করিয়া হাসিমুখে রঞ্জনকে আগ বাড়াইয়া লইল-সাথে সাথে সে গান ধরিয়া দিল— “ও কুবুজার বন্ধু,
কেমনেতে পাশরিলে রাই-মুখ-ইন্দু।”
কমল খঞ্জনী ফেলিয়া উঠিয়া গেল, মহন্ত আসিয়া কহিল, “উঠে এস রাই-কমল!” কমল কহিল, “আমার মাথা ধরেছে।”
মহন্ত আবার কহিল, “ছি, রঞ্জন বলবে কি?”
কমল হাতজোড় করিয়া আর্ত কাকুতিতে কহিল, “পায়ে পড়ি তােমার মহন্ত, আমায় দন্ধে মেরাে না!”
মহন্ত বাহির হইয়া গেল। কীর্তন-শেষে যে যার ঘরে ফিরিল, মহন্ত আবার আসিয়া কমলের মাথায় হাত বুলাইয়া কহিল- “রাই-কমল! মাথায় হাত বুলিয়ে দোব!”
কমলের আজন্মের বেদনার বাঁধ আজ টুটিয়া গিয়াছিল, সে কাঁদিয়া কহিল, “আজকের মতাে আমাকে মাপ কর মহন্ত, একটি রাত মহন্ত, একটি রাত!” মহন্ত কহিল, “একটি কথা শােন!”
কমল কহিল, “কাল মহন্ত, কাল।”
মহন্ত কহিল, “কাল আর হয়তাে বলা হবে না।”
আর কমল কহিল, “না বলা হয় ওগাে তুমি বলাে না আমারও শুনে কাজ নাই!” মহন্ত ধীরে ধীরে উঠিয়া গেল।
কমল তেমনিভাবেই পড়িয়া রহিল, দরজা খােলা, বাহিরে অন্ধকার, নিস্তব্ধ গ্রাম, শুধু রজনী-প্রবাহের একটা সন্ শব্দ, সে যেন কমলের বুকের কান্নার প্রতিধ্বনি। সে আসিয়া পা টিপিয়া ঘরে বশিল।
কমল চমকিয়া কহিল “কে?”
রঞ্জন কমলের গায়ে হাত দিয়া মৃদুস্বরে কহিল—“চিনি!” কমল শিহরিয়া উঠিয়া বসিয়া কহিল, “চুপ চুপ—শুনতে পাবে!” পাপ,সাপের মতােই তার প্রকৃতি, গােপনতার মধ্যেই তার বাস। কমল পাশ কাটাইয়া ঘরের বাহির হইয়া ছুটিয়া রস-কুঞ্জের দুয়ারে আছাড় খাইয়া পড়িল- “মহন্ত, মহন্ত!”
ঘরের মধ্যে হইতে যন্ত্রণাকাতর কণ্ঠে মহন্ত উত্তর দিল, “রাই-কমল!” বড় কষ্টে যেন মহন্ত দুয়ার খুলিতেছিল –কমল বাহির হইতে আপন বিপদ ভুলিয়া অতি বড় উদ্বেগে কহিল, “কি হল তােমার মহন্ত!”
দুয়ার খুলিয়া মহন্ত কমলের পায়ের কাছে অবশভাবে লুটাইয়া পড়িয়া কহিল, “তােমার কি হল রাই-কমল?”
দুঃস্বপ্ন স্মরণ করিয়া মানুষ যেমন শিহরিয়া উঠে, কমল তেমনিভাবে শিহরিয়া কহিল—“রঞ্জন এসেছিল!”
মহন্ত ব্যগ্রভাবে কহিল, “চলে গেছে?”
কমলি কহিল, “তােমার কি হল মহন্ত এমন করছ কেন?”
অতি যন্ত্রণায় মহন্তের দেহখানা আঁকিয়া বাঁকিয়া গেল, তাহারই মাঝে সে কহিল, –“বাঁচতে যে ইচ্ছে হচ্ছে রাই-কমল, আমাকে বাঁচাও, আমি বিষ খেয়েছি।” কমল মহন্তের বুকে মাথা ঠুকিয়া কহিল, “কেন, কেন তুমি এমন করলে?” “রঞ্জনের আসা যে সইতে পারলাম না, কমল—আমারই”—বিষের যাতনায় মহন্ত গােঙাইয়া উঠিল, মুখে ফেনা ভাঙিল।
কমল যত্নে মুখে ফেনা মুছাইয়া দিয়া কহিল, “সে তাে আমার নয় গাে, ছেলেবেলার সখা তাে আর সে নাই আমার;—আর তুমিই তাে তাকে নিয়ে এলে, কেন তুমি তাকে তাড়িয়ে দিলে না?”
যাতনার মাঝেও মহন্ত হাসিয়া কহিল—“রাধে রাধে, রাই-কমল, তা কি পারি? বৈরাগী ভিখেরীর জাত আমরা, হাসি আর মুখের মিষ্টিই তাে আমাদের সম্বল। আর শােন—” মহন্তের চেতনা যেন লুপ্ত হইয়া আসিতেছিল—কমল পাশ কাটাইয়া কহিল, “কাহাকে কহিল কে জানে,-বােধ করি বা সর্বকালে—সর্বস্থানে চির-চৈতন্যময় সেই গােবিন্দের চরণেই প্রশ্ন করিল—“আমি কি করব গাে? আমার কি হবে গাে?
কে উত্তর দেবে?
উপায়হীন নারী, আর কিছু করিতে পারিল না—শুধু প্রাণ ফাটাইয়া ডাকিল, ওই মরণপথের যাত্রীকে-“মহন্ত, মহন্ত!”
মহন্ত আবার অতি কষ্টে চক্ষু মেলিয়া কহিল, হা—শােন সেই কথাটা শােন, পাপ। আমারই মনের, পাপ তােমার নয়,—রাধারাণীর জাত তােমরা, গােবিন্দের লীলায় ঠাই—পাপ তােমাদের ছুঁতে পারে না গাে-উঃ-” যাতনায় আবার দেহখানা তাহার আঁকিয়া-বাঁকিয়া গেল, ফেনা ভাঙিয়া জিষ্টা বাহির হইয়া পড়িল। নিঃশব্দে কমল সেই দেহখানা কোলে করিয়া বসিয়া রহিল!
আরও পড়ুনঃ মুন্নির রোমান্টিক প্রেমের গল্প
মহন্তের সমাধি দিল কমল—সেই জোরালতার কুঞ্জতলে। সন্ধ্যায় সেখানে সে দীপটিও জ্বালিয়া দেয়, তাহারই সম্মুখে সে কীর্তন গায়। তেমনি গান এখনও আখড়ায় জমে, —তেমনি আনন্দ;-কমল হাসিমুখে সবাইকে আগ বাড়াইয়া লয়, হাসিমুখে কথা কয় ! আসে না শুধু একজন—সে রঞ্জন!
ভােলা কহে, “ডাকব!”
কমল হাসিয়া কহে, “আসবেন আপনি একদিন!”
লােকে কয়,-“হাসির ছটা-ঘটা দেখেচ! শহর-বাজারে যায় না কেন? ছি-ছি!” মেয়েরা বলে-“মরে না কেন,—যাকে দশে বলে ছি—তার জীবনে কাজ কি?” কমল হাসিমুখে কহে, “মনুষ্য জন্ম বহু ভাগ্যে হয়েছে, তা কি ছাড়তে পারি!
গােবিন্দ-গােবিন্দ।”
শুধু ওই কথা বলিয়াই ক্ষান্ত থাকে না, নিঃসঙ্কোচে গ্রামের অতিথি কুটুম্ব—এমন কি গ্রামের জমিদার আসিলে—সেখান পর্যন্ত সে পান হাতে হাসি পরিবেশন করিয়া আসে। জমিদার রসিকতা করিয়া কয়, “বৈষ্ণুবীর পান যেমন মিষ্টি, ঠোটের হাসি—তার চেয়েও মিষ্টি।”
বৈয়বী ঘােমটাটি ঈষৎ টানিয়া দিয়া আরও একটু হাসিয়া কয়—“ভিখেরীর ওই তাে সম্বল প্রভু!”
সেদিন পাড়ার রামের মা কহিল, “কমল শ্রীধাম যাবি? আমরা যাব ভচ্চাজ মহাশয়ের সাথে।”
বৈয়বী কহিল, “না।”
রামের মা কহিল, “সে কি লাে! ব্রজের চাদ!”
কমল কহিল, “ঠাকুরে আমার মন ওঠে না, রামের মা!” বলিয়া সে হাসিয়া সারা। রামের মা কহিল, “মরণ, তাের আবার হাসি আছে?”
কমল আবার হাসিয়া কহিল,-“ওই তাে আমার সম্বল গাে!” সরমের সীমারেখা পর্যন্ত জিভ কাটিয়া রামের মা পথে পথে বলিয়া চলিল—“কলঙ্কিনী কলঙ্কিনী।”
শ্রীধাম যাইবার অগ্রণী ভট্টাচার্য কহিল, “স্বৈরিণীর ওই লক্ষ্মণ যে, ও স্বৈরিণী।” ভােলা কহিল, “মারব মাগীকে।”
কমল বাধা দিয়া কহিল, “ছি!”
ভােলা কহিল,—“তা বলে,—ওই বলবে না কি?”
কমল সাঁঝের দীপটি সমাধিতলে দিতে দিতে গান ধরিল— “বড় ভালােবাসি আমি—কলঙ্কিনী—নাম গাে।
কলঙ্কের তরে আমি হারাই কি শ্যাম গাে।
শ্যামের আগে রাধায় দিয়ে ডাকে রাধাশ্যাম্ গাে৷” মুখে তার মধুর হাসি, চোখে তার আনন্দ, কোনাে অসূয়ানাই, আক্ষেপ নাই—এলাননা চুল, সে চুলের রাশি পরে খাঁজ কাটিয়া গলাটি বেড়িয়া অঞ্চলখানি। গাহিতে গাহিতে সে সমাধিতলে মাথাটি লুটাইয়া দিয়া গদগদ কণ্ঠে স্মরণ করে গুরু গুরু গুরু।”
(সমাপ্ত)