WhatsApp Channel
Follow Now
Telegram Group
Follow Now
Last updated on July 4th, 2023 at 12:50 am
আজকের bangla sad love story টির নাম – “বিষ হয়েগেছে অমৃত” গল্পের প্রধান চরিত্রে ললিতাগৌরি ও প্রদম্ম, বিষয় – ভালোবাসার অভিনয়, bengali love stories এবং bangla love story আর romantic premer golpo অথবা jokes in bengali আরও পাওয়ার জন্য আমাদের ব্লগ টিকে সাবস্ক্রাইব করে আমাদের সাথে থাকুন, গল্পটি পড়িয়া যদি আপনার ভালো লাগিয়া থাকে তাহলে অবশ্যই কমেন্ট এবং শেয়ার করিতে ভুলিবেন না।
আজকের গল্প – বিষ হয়েগেছে অমৃত
কথাটা হঠাৎ সেদিন মনে পড়ে যায়। কে বলেছিলেন। কবে। কোন্ উপলক্ষে। স্মরণ করতে গিয়ে উমাপতি ধর দেখেন তার মনের পরতে কোথাও কোনাে চরণরেখা নেই। চারদিকি শূন্যতা। মাঝখানে জ্বলজ্বল করছে ওই ক’টি অক্ষর। “বিষ আমার ভাগ্যে অমৃত হয়ে গেছে।” এখন তার কাজের চাপ কমেছে। পূজার উপন্যাস শেষ হয়েছে। তাই একটু অবসর পাচ্ছেন ভাববার। সকাল থেকে লেগে আছেন ওর পেছনে। jigsaw puzzles যেমন করে আস্তে আস্তে জোড়া লাগে, তেমনি করে জুড়ে যাচ্ছে একটার পর একটা ছিন্নবিচ্ছিন্ন টুকরাে। গড়ে উঠছে একটা স্মৃতিগত ঐক্য। এখানে ওখানে দু’চারটে টুকরাে নিরুদ্দেশ পরে হয়তাে খুঁজে পাওয়া যাবে। তখন যার যার জায়গায় বসিয়ে দিতে পারা যাবে। না পারলে কল্পনা আছে কী করতে। ফাক যদি কোনাে মতে না ভরে তবে কল্পনা দিয়ে ভরাতে হবে। মিশ যদি না খায় নিরুপায়।
ময়মনসিং থেকে কলকাতা আসার পথে যমুনা নদী পার হবার সময় স্টীমারে আলাপ। ভদ্রলােক পরিচয় শুনে বলেন, “কাব্য পড়ে যেমন ভাবি কবি তেমন নয় গাে। নিরাশ হলুম, মিস্টার ধর।” ধর কাষ্ঠহাসি হেসে বলেন, “আমার দুর্ভাগ্য, ডক্টর রায়।” ওঁদের ডেকে ওঁরা যাত্রী বলতে তিনজন কি চারজন। ঘুরে ফিরে বার বার দেখা। ধরও ভালােবাসেন হেঁটে বেড়াতে। রায়ও তাই। ছােট একটা খাঁচায় একজোড়া শার্দুল। মুখােমুখি ও ঠোকাঠুকি অনিবার্য হলেই ইনি বলে ওঠেন, “সরি।” উনি বলে ওঠেন, “পার্ডন।” ভদ্রলােকের চেহারা থেকে মনে হয় না যে রাতে ঘুম হয়। চোখের কোল ফোলা। সিগারেট টানছেন তাে টানছেন। একটা ফুরােলে আরেকটা। তাও পুরােপুরি ফুরােতে দেন কই! পা দিয়ে মাড়িয়ে দেন। হুঁশিয়ার করে দিলে নদীর জলে ছুঁড়ে ফেলে দেন।
“বুঝতে পারছি আপনি একটা তত্ত্ব নিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন, ডক্টর রায়।” “তত্ত্ব না হাতী। আমি মরছি, মশায়, প্রাণের জ্বালায়। দারুণ অশান্তি ভােগ করছি। দাবদাহ জানেন তাে। আর হরিণ।” “ওঃ তাই নাকি। আমার সমবেদনা।” বলে ধর তার ডান হাত বাড়িয়ে দেন। “ধন্যবাদ। কী খাবেন, বলুন। whiskey আর soda না beer, no thanks, cold drinks ধর ও রসে বঞ্চিত। “তা হলে আপনি একজন old man. রায় পরিহাস করেন।“ওল্ড ম্যান বললে আমি তেমন খুশি হইনে যেমন হই old friend বললে।” ধর তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলেন। “ওল্ড অ্যাডমায়ারার যদি বলি তা হলে কি আপনি বিশ্বাস করবেন। উমাপতি ধরের কবিতা আমরা ছাত্র বয়সে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তুম। কোথায় গেল সেসব দিন। আপনিও আর কবিতা লেখেন না। আফসােস।” পাশাপাশি জমিয়ে বসা গেল। দৃষ্টি যমুনার উপরে। সে বেচারি শুকিয়ে এসেছে। মাসটা বােধহয় জ্যৈষ্ঠ। বর্ষণের দেরি আছে।
গলাটাও তেমনি শুকিয়ে যাচ্ছে। কখন একসময় রায় শােনাতে শুরু করলেন তাঁর চাকুরি জীবনের দুঃখের কাহিনী। অন্যায়ভাবে বদলি আর সুপারসেসন। অন্যায় রিপাের্ট আর রিমার্ক। বছরের পর বছর কেস সাজিয়ে যাওয়া যাতে এফিসিয়েন্সি বারে আটকায়। কে কাকে শােনাবে। কে না ভুগেছে। ধর মনে মনে বিরক্ত হন। চাকুরির বিষ তার আস্বাদন করতে বাকী নেই। তবে আকণ্ঠ পান করতে তখনাে কিছু বাকী। my dear roy তিনি তাকে পরামর্শ দেন, “আপনি একবার আপনার উজির সাহেবের সঙ্গে মােলাকাত করুন। শুনেছি সদাশয় লােক।” করিনি ভাবছেন। উজির সাহেব আমাকে সিগারেট অফার করলেন। শুধু তাই নয়, স্বয়ং আমার সিগারেট ধরিয়ে দিলেন, তারপর নিজেরটা ধরালেন। কিন্তু তারপর যা বললেন তা শুনে আমার আক্কেল গুড়ুম। বললেন, আমি মুসলমানের ভােটে নির্বাচিত হয়েছি, মুসলমানের ভােটের জোরে মন্ত্রী হয়েছি, মুসলমানের কাছেই আমার দায় দায়িত্ব। মুসলমানের জন্যে কী করতে পারি সেই আমার একমাত্র ভাবনা।
নইলে পরের বার কেউ আমাকে ভােট দেবে না। আমি আবার সেই ফকির। আপনার কী! আপনার চাকরি তাে কেউ কেড়ে নিচ্ছে না। সামান্য একটা প্রমােশন, তার জন্যে কেন এত মাথাব্যথা।” রায় উত্তেজিত হয়ে বলেন। ধর দুঃখিত হয়ে উপদেশ দেন ভগবানে বিশ্বাস রাখতে। রায় তা শুনে আরাে উত্তেজিত হন। বলেন, “আমার পদবীটাই ভগবানের নামে। অথচ আমি সম্পূর্ণ নাস্তিক। biology তে ওরকম কোনাে জীব নেই, physics এ ওরকম কোনাে পদার্থ নেই, science ওঁর কোনাে সন্ধান রাখে না। ভগবান থাকলে ত্রিশ লক্ষ মহাপ্রাণী দুর্ভিক্ষে মারা যায়। তাও মানুষের তৈরি দুর্ভিক্ষে মারা যায়। আর এই হিরােশিমার পরমাণু বােমা। আহা, পরমাত্মার অস্তিত্বের কী মহৎ প্রমাণ।” ধর তার ব্যথা বােঝেন। সমবেদনার সঙ্গে বলেন, “আপনি এখনাে যুবক। ইচ্ছে করলে আবার নতুন করে আরম্ভ করতে পারেন। নিজেই তাে বললেন বিয়ে করেননি!” প্রসঙ্গটা এবার অন্য মােড় নেয়।
জীবিকার কথা ছেড়ে রায় এবার জীবনের কথায় ধ্যান দেন। জীবনই তাে বড়াে। জীবিকা তার তুলনায় কতটুকু ! “সেদিক থেকেও আমি হ্যামলেটের মতাে দোদুল্যমান। কিন্তু তার আগে সবটা শুনবেন কি! কাহিনীটা মনােহর হন। কাহিনী না বলে কিসসা বলতে পারি।” “কিসসা।” ধর চাঙ্গা হয়ে ওঠেন। কিসসা শুনতে কার না ভালাে লাগে। তিনি মনে মনে বলেন, এখনাে আমি বুড়াে হইনি, ভায়া। গম্ভীরভাবে বলেন, “আচ্ছা।” “কলকাতায় বদলি হয়ে সেবার এক মাঝারি হােটেলে সাময়িকভাবে বাস করছি। কবে কোথায় ঠেলে দেয় তার স্থিরতা কী। সেখানে থাকতে একটি ফুটফুটে খােকার সঙ্গে ভাব হয়ে যায়। বরাবরই আমি ছােট ছেলেমেয়েদের ভালােবাসি। ওদের জন্যে বিস্কুট লজেন্স চকোলেট রাখি। খােকার সঙ্গে দেখা হলেই পকেট খালি হয়ে যায়। দুই পকেটে দুই হাত ঢুকিয়ে দিয়ে লুট করে। ওর মা দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখেন আর হাসতে হাসতে শাসান। আমাকে একটা ছােট্ট নমস্কার করেন, কিন্তু ধন্যবাদ দেন না। কথা বলেন না। ওর বাপকে বড়াে একটা দেখিনে।
কখন আসেন, কখন যান, কতক্ষণ থাকেন তাতে আমার কাজ কী। আমি আমার নিজের ধান্দায় ব্যস্ত। নামধাম পরিচয়ও জানিনে। জানতেও চাইনে। তবে একটা আভিজাত্যের আভাস পাই। অভিজাত অথচ অভাবগ্রস্ত। যা আমি কল্পনাও করিনি তাই একদিন ঘটে। ভদ্রমহিলা একদিন খােকার হাত ধরে আমার ঘরের সামনে এসে টোকা দেন। আমি শশব্যস্ত হয়ে সুপ্রভাত জানাই। তিনি বলেন, “আপনি তাে ডাক্তার। আমাকে একটু সাহায্য করতে পারেন।” “আমি ডাক্তার নই, ম্যাডাম। আমি ডক্টর। বলেন তাে আপনাকে ডাক্তার ডেকে দিতে পারি।” ভদ্রমহিলা তখন পূর্ণগর্ভা। লেডী ডাক্তারের প্রয়ােজন। কিন্তু হােটেলে নেই নিশ্চয়। তিনি আমার ভাব দেখে বলেন, “দেরী আছে। কিন্তু এখন থেকে হাসপাতালে বা নার্সিং হােমে ব্যবস্থা করে রাখতে হবে। আমার কর্তাটি প্রায় টুরে যান। নির্ভর করতে পারি এমন একজনও নেই। খােকনকে যখন এত ভালােবাসেন তখন আপনিই ভরসা।” ব্যবস্থা আমাকেই করতে হয়। টাকা যা লাগে তিনিই দেন। সময় যখন ঘনিয়ে আসে তখন তিনি আমাকে একটি আশ্চর্য কথা বলেন। তার স্বামী একমাস তাঁর কাছে আসেননি, অথচ আছেন কলকাতাতেই। টেলিফোনের ঠিকানা দিয়েছেন, কিন্তু বাসার ঠিকানা দেননি। তাঁর বাসার ঠিকানা খুঁজে বার করা কি সম্ভব। আমি কি পারব এটুকু উপকার করতে। এমন কিছু নয়!
আরও পড়ুনঃ গল্পঃ রোমান্স
সীলভাম রিট্রীট, রিজেন্ট পার্ক, টালিগঞ্জ খুঁজে বার করতে কতটুকু উদ্যোগ লাগে! তা শুনে ভদ্রমহিলা বলেন, “আমার স্বামীকে টেলিফোন করে সাড়া পাইনে। চিঠি লিখে সাড়া পাব কি না কে জানে! আমাকেই যেতে হবে দেখছি, কিন্তু ওরা যদি আমাকে ঢুকতে না দেয়! যদি ওঁর সঙ্গে দেখা করতে না দেয়। তা হলে কী হবে, ডক্টর রায়। আপনিও চলুন না। লক্ষ্মীটি।” অদ্ভুত আবদার। আমি ইতস্তত করছি দেখে তিনি বলেন, “বুঝেছি, আপনি ভাবছেন এটা আমাদের স্বামী-স্ত্রীর প্রাইভেট ব্যাপার। এর মধ্যে আপনি নাক গলাবেন কেন। কিন্তু আমার যে কেউ নেই, ডকটর রায়। সবাই আমাকে ছেড়েছে। যার জন্যে ছেড়েছে। তিনিও আমায় ছাড়লেন কি না জানতে চাই।” সেদিন তিনি আমাকে বিশ্বাস করে তার বৃত্তান্ত বলেন। দেওগড় রাজ্যের দেওয়ান ছিলেন তার বাবা। সে সময় রাজবংশের একটি ছেলে তাদের বাড়িতে আসত, বাংলা শিখত, পারিবারিক উৎসবে যােগ দিত। তারপর সে ছেলে বড়াে হয়ে কলকাতার কলেজে পড়ে, কিন্তু বাল্যসখীকে ভােলে না।
দেওয়ানও ততদিনে অবসর নিয়েছেন, নিয়ে কলকাতায় বাস করছেন। ছেলেটি একদিন বিয়ের প্রস্তাব করে, কিন্তু ক্ষত্রিয়কে কন্যাসম্প্রদান করতে ব্রাম্মনের আপত্তি। তা ছাড়া রাজ্যের বাইরে বাড়ি নেই, জমি নেই, অন্য কোনাে উপার্জনের উৎস নেই। রাজবংশের ছেলে বলে চাকরি যদি বা জোটে তা দিয়ে ঠাই বজায় রাখা দায়। ওদিকের গুরুজনও অসম্মত। ওঁরা নাকি এক ক্ষত্রিয় পরিবারে বিয়ের সম্বন্ধ করে ফেলেছেন। আর কিছুদিন দেরি করলে প্রদ্যুন্মকে পাওয়া যেত না। তাই ললিতাগৌরী বাপ মার অমতে ওকে বিয়ে করেন। সিভিল ম্যারেজ। সঙ্গে সঙ্গে রাজকীয় মাসােহারা বন্ধ হয়ে যায়। শুরু হয় অর্থকষ্ট। টার্ফ ক্লাবে একটা চাকরি জুটে না গেলে পথে বসতে হতাে। ছেলেটি যেমন সুপুরুষ তেমনি নিপুণ ঘােড়সওয়ার। আদবকায়দায় অদ্বিতীয়। লেখাপড়ায় গ্র্যাজুয়েট। বিভিন্ন রাজপরিবারের সঙ্গে তার কানেকশন আছে। আর কী চাই? কিন্তু টার্ফ ক্লাবের সভ্যদের সঙ্গে সমান হতে হলে খরচ করতে হয়। অভিজাত স্টাইলে থাকতে হয়। একজন কর্মচারীর পক্ষে তা সম্ভব হবে কেন ? দু’দিক মেলাতে গিয়ে দেখা যায় মিলছে না। ধারকর্য করতে হয়।
অশান্তি ও অনিশ্চয়তা। প্রদ্যুম্নকে উদ্ধার করেন রাজমাতা অফ বিজয়কোণ্ডা। দূর সম্পর্কের মামী। তার প্রাইভেট সেক্রেটারি পদ দিয়ে। ললিতাগৌরী ও খােকা থাকে হােটেলে, প্রদ্যুম্ন কলকাতায় এলে হােটেলে রাত কাটান, কিন্তু সারাদিন রাজমাতার ওখানে ডিউটি দেয়। কলকাতায় তার রেসের ঘােড়া আছে। সেইসূত্রে তাকে প্রায়ই কলকাতা আসতে হয়। ঘােড়দৌড়ের মরসুমে তিনি কলকাতা থেকে নড়েন না। ছেলেকে গদীতে বসিয়ে তিনি এখন স্বেচ্ছাপতি। bank এ ঢালাও হুকুম দেওয়া আছে। মাসে মাসে প্রদ্যুম্নর মাইনে ললিতাগৌরীর হিসাবে জমা দেওয়া হয়। নিজের জন্যে প্রদ্যুম্ন একটি পয়সা রাখেন না। তার যাবতীয় খরচ রাজমাতার পার্সনাল এস্টাব্লিশ-মেন্টের খরচের সামিল। এর চেয়ে লােভনীয় বন্দোবস্ত আর কী হতে পারে ললিতাগৌরী তাে হাতে স্বর্গ পায়। তখন যদি জানতেন এর পেছনে কী আছে! এখন একটু একটু করে জ্ঞান হচ্ছে আর জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেয়ে অনুতাপ হচ্ছে।
একদিন বেরিয়া পড়া গেল লালসাহেবের খোঁজে মিসেস লালকে নিয়ে। সঙ্গে আমার বন্ধু সৈকত। গাড়ীটা তারই। ললিতাদিকে বলি, আমার বিশেষ অনুরােধ, আপনি যেন আমাদের সামনে লালসাহেবকে গালমন্দ না করেন। আপনার কাছে আসতে না পারার গুরুতর কারণ থাকতে পারে। কৈফিয়ৎ না চেয়ে শুধু বলবেন, চল, দরকারী কথা আছে। বনসুলীর মধ্যে সীলভান রিট্রীট। আমরা বাইরে দূরে মােটর রাখি, ভিতরে নিতে সাহস হয় না। ললিতাদিকে বলি মােটরে বসে অপেক্ষা করতে। সৈকত তার প্রহরী হয়। ভিতরে ঢুকতে যাব এমন সময় একটা মােটর আমাকে পাশ করে চলে যায়। ভিতরের দিকেই। আন্দাজে বুঝতে পারি ড্রাইভ করছেন লালসাহেব স্বয়ং। তার পাশে বসেছেন রাজমাতা সাহেবা। বু ভীনাস। ব্লু ভীনাস। প্রমথ চৌধুরীর বর্ণনা পড়েছেন নিশ্চয়। বয়স তার রূপকে একটুও ম্লান করেনি। নিখুঁৎ ভাস্কর্য আর কী ডিগনিটি। রাজরানী বটে। মােটর গাড়ী বারান্দায় থামে।
তিনি লাল-সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অন্দরে যান। গাড়ী সেখানেই রেখে লালসাহেব আমার দিকে এগিয়ে আসেন। বােধহয় স্ত্রীকে লক্ষ্য করেছেন। আরাে এগিয়ে গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলবেন। আমি তাকে গ্রীট করে আমার পরিচয় দিই। তিনি এমন সুরে “হ্যালাে” বলেন যেন কতকালের চেনা। অবশ্য আমাকে তিনি হােটেলেই দেখেছিলেন, যদিও জানতেন না আমি কে। আমি তাকে বলি আমরা কেন এসেছি। তার স্ত্রীর যে রকম অবস্থা যে কোনাে দিন নার্সিং হােমে যেতে হতে পারে। রিজেন্ট পার্ক পর্যন্ত আসা তাে রীতিমতাে ঝুঁকি নেওয়া। কিন্তু স্বামীর সঙ্গে দেখা না করে তিনি নার্সিংহােমে যাবেন না। কে জানে যদি পরে কখনাে দেখা না হয়। যদি না বাঁচেন। তাকে অভয় দেবে কে। কার কাজ সেটা। ডাক্তারের। নার্সের। না স্বামীর ! “সব বুঝি। কিন্তু দেখছেন না ড্রাইভার নেই, ছুটিতে গেছে, আমাকেই ড্রাইভ করতে হচ্ছে। কী করে বলি, আমাকেও ছুটি দিতে আজ্ঞা হােক। শেষে কি চাকরিটা খােয়াব। আপনিও তাে চাকরি করেন।
বলুন দেখি, ছুটি কি চাইলেই পাওয়া যায়। একটু পরেই ওঁকে নিয়ে আবার বেরােতে হবে। লাঞ্চের নিমন্ত্রণ আছে। ডিনার তাে রােজ বাইরে খাওয়া হয়, কখনাে রাজরাজড়াদের সঙ্গে। ফিরতে রাত এগারােটা থেকে বারােটা। একটু ফুরসৎ পেলেই আমি আসব। আপনাকে কী বলে ধন্যবাদ দেব, ডক্টর রায়।” স্বামীকে দেখে স্ত্রীর ও স্ত্রীকে দেখে স্বামীর মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত। ওরা সত্যি দু’জনে দু’জনকে ভালােবাসে। অদর্শনটা সাময়িক। কারণটা বিশ্বাসযােগ্য। উভয়ের উপরােধে দায়িত্ব টা আমাকেই নিতে হয় নার্সিংহােমে নিয়ে যাবার, সেখানে খাবার পৌঁছে দেবার ভার, এদিকে খােকনকে সামলাবার ভার। অবশ্য আয়া ছিল। এসবও করি, সঙ্গে সঙ্গে ডিউটিও দিই। একটু আধটু গাফিলতি না ঘটে পারে না। তার জন্যে কী কৈফিয়ৎ দেব ? পরার্থে আত্মদান? শত্রুরা রটায় ওটা আমারই স্বার্থ। বাপ আমিই। শুনে তাে আমি থ। কেমন করে বােঝাব কাকে বােঝাব যে বাপ কলকাতায় থেকেও ভার নিতে অক্ষম। তাঁকে সংসার চালানাের জন্যে অর্থোপার্জন করতে হয়। মনিবের কাজ আগে।
মেয়ে হয়। নাম রাখা হয় প্রতিমাগৌরী। আমি যদি ওই সৌন্দর্য প্রতিমাকে নিয়ে মেতে উঠে থাকি তবে সেটা আমি ওর জনক বলে নয়। বাপ থাকতেও বেচারি বাপের আদর পাচ্ছে না, তাই আমি সে ফাক ভরিয়ে দিই। লােকে ভুল বুঝবে। বুঝুক। আমার গুরুজনের কাছে খবর যায়। মা নেই, বাবা দ্বিতীয় পক্ষ করার পর থেকে আমাদের প্রতি উদাসীন। আমিই ভাইবােনের প্রতিপালক। সেইজন্যে বিয়ে করিনি। সত্যি একদিন হুকুম আসে। আমি অবাক হইনে, কিন্তু ললিতাদি অবাক হন। তিনি বলেন, “আপনি থাকতেই আমি এর একটা হেস্তনেস্ত চাই। আমার স্বামীর সঙ্গে। ওসব ওজর আপত্তি আমি শুনব না। হয় ওঁকে আমার সঙ্গে বসবাস করতে হবে, নয় আমাকে মুক্তি দিতে হবে। আমার বাবার কি টাকা ছিল না যে আমি টাকার জন্যে আমার অধিকার বিকিয়ে দেব! কে চায় ওঁর মনিবের টাকা। আমি চাই ওঁর সঙ্গ। মামী ভাগনের এই রাধাকৃয় লীলা আমি আর সহ্য করতে পারছিনে। আমাকে দয়া করে উকীলের কাছে নিয়ে চলুন।” “এসব আপনি কী বলছেন, ললিতাদি।” আমি হকচকিয়ে যাই। “কী করে আপনি জানলেন যে ওটা রাধাকৃয় লীলা। যেখানে বয়সের এত তফাৎ।” তিনি গম্ভীর হয়ে যান। বলেন, “আমারও সেই ধারণা ছিল।
আরও পড়ুনঃ গল্পঃ পত্নীহারা
সেই ধারণা থেকেই অনুমতি দেওয়া। এখন উনি ধরা পড়ে গেছেন। থাক, ওসব আপনি বুঝবেন না। ব্যাচেলার মানুষ। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক এত নিগূঢ় যে কেউ যদি একদিনের জন্যে অবিশ্বাসী হয় তার পরের বার মিলনের সময় তার ব্যবহার বদলে যায়। তার কাছে আমি যেন আরেকজন। ভেবে দেখবেন কী ভয়ানক শকিং আর রিভােল্টিং।” আমি ব্যাচেলার মানুষ। আমি এর কী বুঝি। কিন্তু উকীল বাড়ি যাবার প্রস্তাবে ঘাড় নাড়ি। লালসাহেবরা উল্টে আমাকেই জড়াবেন। ব্যারিস্টার দেবেন। ওঁদের, মানে রাজমাতার, টাকার জোর বেশী। টাকা সত্যকে মিথ্যা করতে পারে, মিথ্যাকে সত্য করতে পারে, দিনকে রাত, রাতকে দিন। ঝগড়া করতে নয়, মিটমাট করতে এমনি আমরা একদিন রিজেন্টস পার্কের বাড়িতে যাই। রাজমাতা দর্শন দেন না। লালসাহেব এসে অভ্যর্থনা করেন। কথাবার্তা চলছে, এমন সময় দেখি রাজমাতার সহচরী এসে লালসাহেবের সামনে সিগারেটের ট্রে রাখেন। লালসাহেব একটি সিগরেট বেছে নিলে সহচরী দেশলাই জ্বেলে ধরিয়ে দেন।
তারপর যা ঘটে তা আরাে বিচিত্র। লালসাহেব শুধু একবার ঠোটে ছুইয়ে প্রসাদ করে দেন। সিগারেট অন্দরে ফিরে যায়। রাজমাতা প্রসাদ পেয়ে ধন্য হন। ললিতাদির মুখখানা যদি দেখতেন। কী লজ্জা, কী রাগ, কী-হা, অনুরাগ। প্রেম। যেন আরাে বেড়ে যায়। মেয়েরা যে কী চীজ সে আমি সেদিন প্রত্যক্ষ করি। আমি সরে যাই। ওদের দু’জনাকে মােকাবিলা করতে দিই। মিটমাট করতে চায় ওরাই করবে। আমি কে যে ফপরদালালি করি। মােটরে ফিরে গিয়ে অপেক্ষা করি। কিছুক্ষণ পরে ললিতাদি এসে যােগ দেন, তাকে পৌঁছে দেন লালসাহেব। দু’জনের চোখে জল। দু’জনের মুখে হাসি। দাম্পত্যকলহে চৈব বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া। আমি এখন নিশ্চিন্ত মনে কলকাতা থেকে বদলির জায়গায় যেতে পারি। ওমা, কোথায় যাব। ললিতাদি ছুটে এসে আমার ঘরে আমার খাটের উপর ভেঙে পড়েন। আমি যদি বিভাকর রায় না হয়ে নিরাকার রায় হতুম তা হলেও হতভম্ব হতুম। শয্যাটা তাে আমার। লােকে বলবে কী। তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে আয়াকে ধরে নিয়ে আসি। দেখি সেও কাঁদছে। তারই মুখ থেকে শুনি যে লালসাহেব বিলেত চলে গেছেন।
পরে ললিতাদির কাছে জানতে পাই যে রাজমাতা ইউরােপ পরিদর্শনের সময় তার প্রাইভেট সেক্রেটারির সাহায্য চান। প্রদ্যুম্ন কখনাে ইউরােপ দেখেন নি। এই তার সুযােগ। ওভারসীজ অ্যালাওয়ান্স হিসাবে তিনি আরাে টাকা পাবেন। সে টাকাও ললিতাদির হাতে আসবে। লালসাহেবের ইচ্ছা সেই টাকায় একটি মনের মতাে ফ্ল্যাট নিয়ে ঘরকন্না পাতা। ললিতাদিও তাই চান। হােটেলের লােকের সামনে মুখ দেখানাে দায়। পরে যখন কলকাতা আসি ওঁর ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখা করি। বালীগঞ্জের মেফেয়ারে আরামে আছেন। ঠিকানাটা এমন লােভনীয় যে হেটেলে যাঁরা কোনােদিন খোঁজ নিতে যেতেন না তারাও প্রায়ই আসা যাওয়া করেন ও মাঝে মাঝে থাকেন। তার বৌদি, তার বােন, তার ভাইপাে ভাগনের দল। বুঝতে পারি যে আমার প্রয়ােজন ফুরিয়েছে। আমি ফালতু লোক। এই কথাটা যাঁহাতক ওঁকে বলা উনি গভীরভাবে বিচলিত হন।
ঘরে আর কেউ তখন ছিল না। আমার কাছে সরে এসে বসেন ও এত আস্তে আস্তে বলেন যে তৃতীয় প্রাণীর কানে পড়ে না। “বিভাকর, তুমিও কি আমাকে ছাড়বে? যাকে সবাই ছেড়েছে? এ যা দেখছ এটা তােমার দৃষ্টিবিভ্রম। আমি আরাে নিঃসঙ্গ। কারণ তােমার সঙ্গে মেশার সুযােগ পাইনে।” আমি কল্পনাও করিনি যে তিনি আমাকে ভালােবাসবেন ও আমার ভালােবাসা চাইবেন। একি স্বপ্ন! এ কি মায়া ! সেদিন থেকে আমাদের সম্বন্ধটা বদলে যায়। হ্যা, আমিও তাকে ভালােবাসি। না ভালােবেসে পারিনে। এর পরে আমি আবার কলকাতায় বদলি হয়ে আসি ও এক বন্ধুর ওখানে পেয়িং গেস্ট হই। ললিতাকে একথা বললে সে অভিমান করে বলে, “পেয়িং গেস্ট যদি হলে তাে আমার ওখানে কেন নয়? আমার ছেলেমেয়েরা তাে কাকু বলতে অজ্ঞান। আমি একাই ওদের মা বাবা হতে পারব কেন। পারব কদ্দিন।”
ললিতার ওখানে পেয়িং গেস্ট হওয়ার মানে যে কী তা আমি আন্দাজে বুঝেছিলাম। তবু একবার বাজিয়ে নিই। বলি, “যদি আত্মসংবরণ করতে না পেরে একটা কিছু করে বসি তখন কি তুমি আমাকে ক্ষমা করবে না, আমি আমাকে ক্ষমা করব? না লালসাহেব আমাদের ক্ষমা করবে?” “আমার কথা যদি বল”, সে অস্ফুট স্বরে বলে, “আমি প্রাণ ফিরে পাব।” আমি মহামুনির মতাে মৌন দেখে সে আরেকটু মুখর হয়। “আমার পােজিশনটা কী কুৎসিত। আমার স্বামী আরেকটি নারীর রক্ষিত। তার জন্যে তিনি যে শুল্ক পান তাই দিয়ে আমার জীবনযাত্রা চলে। আমাকে এই পাঁক থেকে টেনে তুলবে কে? তােমার মতাে নিঃস্বার্থ ও শুদ্ধ কে আছে? তুমি যদি আমাকে নিরাশ কর আমিও বকে যেতে পারি, বিভাকর। ও আগুন আমাকেও পুড়িয়ে খাক করতে পারে।” এ এক বিদ্রোহ ঘােষণা। কিন্তু আমি কেমন করে এ আগুনে হাত দিই? যদি জানতুম যে ডিভাের্সের মামলা ফেস করতে পারব। তারপর বীরপুরুষের মতাে বিয়ে করতে পারব। তা ছাড়া আমার দৃঢ়তম বিশ্বাস ললিতা বা প্রদ্যুম্ন কেউ কাউকে ছাড়বে না। ওদের প্রেম আপাতত রাহুগ্রস্ত হলেও চিরকাল তা থাকবে না। যৌবনজ্বালা সইতে না পেরে ললিতা হয়তাে আমাকে ধরা দেবে, কিন্তু প্রদ্যুম্ন ফিরে এলে মিঞা বিবি এক হয়ে যাবে।
তখন আমাকে ওরা লাথি মেরে তাড়িয়ে না দেয় তাে আমিই মানে মানে সরে পড়ব। ভালােবাসাকে আমি ততদূর যেতে দেব না। ললিতাকে বলি আমি অসম্মত।
লালসাহেবকে একটি ছােট্ট পাখী খবর দেয় যে তার স্ত্রী চন্দননগরের এক বিশিষ্ট পরিবারের কুলচন্দনের সঙ্গে দিবারাত্র মেলামেশা করছেন। তিনি ললিতাকেও দোষ দেন না, গােকুলকেও না। কিন্তু দু’জনের মাঝখানে একটি পাঁচিল খাড়া করেন। দেওগড় থেকে সামন্তরানী আসেন কালীঘাটে তীর্থ করতে। ওঠেন পুত্রের ফ্ল্যাটে। বলতে ভুলে গেছি যে ওটা প্রদ্যুম্নর নামেই নেওয়া। ও তাসখানা লালসাহেব নিজের হাতেই রেখেছিলেন। ললিতা বুঝতে পারে যে শাশুড়ী থাকতে সে যখন খুশী বাইরে যেতে পারবে না, যাকে খুশি বাড়িতে আনতে পারবে না। এরা হলে জাত ক্ষত্রিয়। যাদের ভয়ে বাঘে গােরুতে এক ঘাটে জল খায়। সেই মহাভারতের যুগের পর থেকে আজ অবধি এরাই ভারতের শাসকশ্রেণী, যদিও মােগল বা ব্রিটিশের দ্বারা পরাজিত। সামন্তরানী কলকাতায় জাঁকিয়ে বসেন। দেওগড়ে ফিরে যাবার নাম করেন না। নাতি নাতনিকে নিয়ে তার সময় কেটে যায় মন্দ না। মালা জপ করার বয়স এখনাে হয়নি। বিগতযৌবনা, কিন্তু রূপবতী।
আর কি সুন্দর নাম। নক্ষত্রমালী। আমি তাকে দেখেই চিনতে পারি যে যৌবনে অনেক বাঘ শিকার করেছেন। আমার সঙ্গে প্রথম আলাপের সময় থেকেই বুঝতে পারি যে এ নারীকে “না” বলার সাধ্য আমার নেই। আর তামাশা দেখুন। আমাকেই ললিতা তার গাইড হবার ভার দেয়। যাদুঘর, চিড়িয়াখানা, ভিক্টোরিয়া মেমােরিয়াল, গড়ের মাঠের সেইসব জাঁদরেল মূর্তি, এসব কে দেখাবে, কে বুঝিয়ে দেবে আমি যদি প্রদর্শক না হই। আসলে ললিতা চেয়েছিল শাশুড়িকে কৌশলে সরিয়ে দিয়ে গােকুলকে নিয়ে আমােদ আহ্লাদ করতে। আমারও আপত্তি ছিল না জীবনের অভিজ্ঞতা বাড়িয়ে নিতে। তবে হুঁশিয়ার ছিলুম যাতে ফলস পােজিশনে না পড়তে হয়। চাকরি খুইয়ে এক সামন্তরানীর প্রাইভেট সেক্রেটারি হতে আমার রুচি ছিল না।
মাস তিনেক পরে আমি তাকে কলকাতার সিনেমা ও থিয়েটারগুলাে দেখাচ্ছি, এমন সময় তুচ্ছ একটা ঘটনা ঘটে। অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে আমার হাতখানা কেমন করে তার হাতে চলে যায় ও মুখ মদের আস্বাদন পায়। চেপে যাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু আমি কিনা শুকদেব, তাই ললিতার কানে তুলি। তখন কি জানতুম যে ওটা ব্ল্যাকমেলের উপকরণ হবে? বেচারি শাশুড়ীকে দেওগড়ে ফিরে যাবার জন্যে চাপ দেওয়া হবে। যেদিন তিনি মানে মানে বিদায় হন সেদিন আমার দিকে তাকিয়ে অগ্নিবান হানেন। যেন বলতে চান, এটা মর্দানা নয়। প্রণাম করবার ছলে আমি তার পায়ে ধরে মার্জনা চাই। তিনি আমাকে কোলে তুলে নিয়ে মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেন ও সেই ছলে সমঝিয়ে দেন যে কোণারকের সেসব মূর্তি এখনাে জীবন্ত। নারীর স্তন কাকে বলে তার জন্যে আমাকে মন্দির দেখতে যেতে হবে না।
আরও পড়ুনঃ Bengali Jokes
লালসাহেবের এ চাল ব্যর্থ হবার পর বাকী থাকে সশরীরে আগমন। আমি সেদিন দৈবক্রমে উপস্থিত ছিলুম। গােকুলকে নিয়ে তিনি এমন মজা করেন যে সে বেচারার গৌরবরণ লাল হয়ে যায়। ললিতার নিষ্ঠুর রূপ সেইদিন প্রত্যক্ষ করি। সে ষোলো আনা স্বামীর দিকে। এবার সে স্বামী-পুত্র-কন্যা নিয়ে ঘর করবে। ঘরমুখাে গােরু যেমন পেছন ফিরে তাকায় না সেই তেমনি। গােকুলকে আর তার দরকার নেই। ও এখন পুনর্মুষিক। ওই খেলাটা খেলেই সে স্বামীকে সাগর পার থেকে ঘরে টেনে আনতে পেরেছে। উপায়টা হয়তাে নীতির দিক থেকে শুচি নয়, কিন্তু উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে। সে আর ক’টা দিনের জন্যে। প্রদ্যুম্ন একদিন আমাকে বলল, “তুমি যদি তােমার চাকরি ছেড়ে দাও তাে আমিও আমার চাকরি ছেড়ে দিই। তারপর নতুন করে আরম্ভ করা যাবে। কী বল, বিভাকর।”
ললিতাও আমাকে মিনতি করে। “বিভাকর, তুমি আমাদের একমাত্র বন্ধু। ওঁকে আমি রাজী করিয়েছি, কিন্তু ওঁর শর্ত তাে শুনলে। তুমি যদি ছাড়াে তাে উনিও ছাড়বেন।” চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কথা আমি কিছু না হােক এক শাে বার বলে থাকব। তার যে এই পরিণতি হবে তা কি তখন জানতুম। সরকারী চাকরি ছেড়ে দেওয়া কি মুখের কথা। তার তুলনা হল কিনা রাজমাতার চাকরি ছেড়ে দেওয়া। কিন্তু কেন নয়। রাজমাতা সরকারের চেয়ে কম কিসে। ভদ্রমহিলা এখনাে বিশ ত্রিশ বছর বাঁচবেন। প্রদ্যুম্নকে তিনি প্রাণভরে ভালােবাসেন। কোনােদিন তার অর্থাভাব হবে না। সেটার মতাে নিশ্চিত কি সরকারী চাকরিতে আছে। এইসব মন্ত্রীদের চেয়ে ওই রাজমাতা ঢের ভালাে। যদি না থাকত স্ত্রী আর ছেলেমেয়ে। সেই থেকেই হ্যামলেটের মতাে ভাবছি, মিস্টার ধর, চাকরিটা রাখব না ছাড়ব। যদি ছাড়ি লালসাহেবকেও ছাড়ানাে যায়। নয়তাে তিনি ফিরে যাবেন রাজমাতার আঁচলে। ব্যাঙ্গালােরে। সেইখানেই ঘােড়া চালান গেছে।
বাড়ী কেনা হয়েছে। এবার গেলে লালসাহেবকে ফিরে পাওয়া শক্ত হবে। বছরে একবার পাওয়া তাে ফিরে পাওয়া নয়।” ধর এতক্ষণ নির্বাক হয়ে শুনছিলেন। বলেন, “এমন অদ্ভুত কথা আমি শুনিনি। প্রদ্যুম্ন পাপ করছে। সে তার পাপ ছাড়বে কি ছাড়বে না নির্ভর করতে তার স্ত্রীর বন্ধুর চাকরি ছাড়া না ছাড়ার উপরে? কখনাে অমন কাজ করবেন না। তবে যদি উপর- ওয়ালাদের সঙ্গে বনিবনার অভাব হয় সেটা অন্য কথা। সেক্ষেত্রেও দুম করে কিছু করবেন না। চিন্তায়সি।” রায় চিন্তান্বিত হয়ে বলেন, “তা হলে ললিতার কী হবে? সে কি ওইরকম ত্রিশঙ্কুর মতাে শূন্যে ঝুলতে থাকবে? না আবার গােকুলের দিকে ঝুঁকবে?” “মাই ডিয়ার রায়”, ধর হিতােপদেশ দেন, “সেটা আপনার বিজনেস নয়। যদি সত্যি ভালােবেসে থাকেন তাে বিয়ে করে ফেলুন। ডিভাের্স কেমন করে কোথায় পেতে হবে সে আমি আপনাদের বলতে পারি bombay is the palace.
এরপরে কুরুক্ষেত্র বাধে। দেশ ভাগ হয়ে যায়। কে যে কোথায় ছিটকে পড়ে খবর রাখা দায়। রায় ধর ভুলে যান। কিসসাটা তার মনে থাকে না। বছর সাতেক পরে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে দিল্লীতে এক বন্ধুর পার্টিতে দেখা। রায় ছুটে এসে আপনার পরিচয় দেন। “ওঃ আপনি সেই রায়। এখন কি ব্ৰত্মবাদী হয়েছেন না তেমনি নাস্তিক।” ধর তার হাতে আঁকানি দিয়ে সুধান। তাকে নিয়ে একটু আড়ালে যান। “এখন আমি ভগবানে বিশ্বাস করি। আর আমার কোনাে সংশয় নেই।” “যে ভগবান আপনাকে এত কষ্ট দিয়েছেন, যাঁর রাজ্যে এত অবিচার, সেই ভগবানে আপনি বিশ্বাস করেন। যার জন্যে এক কোটি না দেড় কোটি লােক প্রাণ নিয়ে পালিয়েছে, পাঁচ লাখ লােক পালাতে না পেরে মরেছে, কে জানে ক’হাজার নারী ধর্ষিতা হয়েছে, এখনাে তাদের অনেকে বন্দিনী, সেই ভগবানে আপনি বিশ্বাস করেন!” “করি। আমার জীবনের সব দুর্ভোগ আমাকে তার দিকে নিয়ে গেছে। আমার ভাগ্যে বিষ হয়ে গেছে অমৃত।” রায় শান্ত সম্মিতভাবে বলেন।
“মিরাকেল! কী করে এটা সম্ভব হল?” ধর জানতে চান। “যেদিন দেখলুম আমার সেই উজির ও তার দলবল হাওয়ার সঙ্গে উড়ে গেলেন, যেদিন দেখলুম আমার উপরওয়ালারাই আমার কাছে জোড়হস্তে সাহায্য প্রার্থনা করলেন সেদিন আমি ভগবানকে ডেকে বললুম, তুমি আছাে, তুমি আছাে। পাকা ঘুটি কেঁচে যাবে কেউ কোনােদিন জানত। তাঁর পক্ষে সকলি সম্ভব। ইচ্ছাময়ের ইচ্ছা।” রায় একেবারে ব্ৰত্মবাদী বনে গেছেন। “তা হলে চাকরিতে আপনি টিকে গেছেন, বলুন।” “তখনকার মতাে। তারপরে দেখি একই সমস্যা ও তার একই সমাধান। চাকরি আমাকে ছাড়তেই হল। কেন, জিজ্ঞাসা করবেন না। এর সঙ্গে ললিতার কোনাে সম্বন্ধ নেই। এটা আমার একার সমস্যা।” রায় অন্যমনস্ক হয়ে যান। “তারপর বিয়ের খবর কী? করেছেন না করেননি?” ধর তার ঔৎসুক্য দমন করতে পারেন না। “বিয়ে আমার জন্যে নয়। যে মানুষ কথায় কথায় চাকরি ছেড়ে দেয় তার বিয়ে না করাই ভালাে। যদি কোনােদিন সেটল্ড হই ভেবে দেখব। দেখছেন তাে আমি ভেসে বেড়াচ্ছি। এখন দিল্লীতে একটা কোম্পানীর অ্যাডভাইজার।
চেষ্টা করছি ইউনাইটেড নেশনসে যেতে। যাই হােক, আমার যা হয়েছে ভালােই হয়েছে। বিষ আমার ভাগ্যে অমৃত হয়ে গেছে।” “তারপর ওদের কী খবর? ললিতা, প্রদ্যুম্ন ওরা এখন কোথায়?” “ললিতা কলকাতায় চাকরি পেয়েছে। আর প্রদ্যুম্ন বাঙ্গালােরে চাকরি করছে। বছরে একবার কি দু’বার দেখা হয়। কেউ কারাে আশা ছাড়েনি। পরস্পরের প্রতীক্ষা করছে।” ধরের হঠাৎ মনে পড়ে যায়। “আর ওই গােকুল না গােপাল?” “গােকুল ললিতাকে ছাড়তে পারেনি। ললিতাও ওকে ছাড়বে না।” রায় মুচকি হাসেন। “ওদিকে রাজমাতাও তেমনি নাছােড়। প্রদ্যুম্নও তাই।” “এমন অদ্ভুত ব্যাপার আমি কোনােকালে শুনিনি। বেজোড় দেখছি শুধু আপনি, ডক্টর রায়। নক্ষত্রমালীকে অমন করে বিদায় না দিলেই হতাে।” ধর রসিকতা করেন জানতেন না যে কেউ সীরিয়াসভাবে নেবে। “আমার জীবনে ওইটেই ছিল মাহেন্দ্রক্ষণ।” রায় গম্ভীরভাবে বলেন।
(সমাপ্ত)