আজকের গল্প “সতী” গল্পের প্রধান চরিত্রে হরিশ, নির্মলা ও লাবন্যপ্রভা, বিষয় – ভালোবাসায় সন্দেহ, আরও Love story in Bengali পড়ার জন্য আমাদের ব্লগ টিকে সাবস্ক্রাইব করতে পারেন।আমাদের এই ব্লগে আপনি আরও পাবেন bengali love story এবংlove story in bengali এবং valobashar golpo আর bangla premer golpoঅথবা bangla jokes গল্প টি পড়িয়া যদি আপনার ভালো লাগিয়া থাকে তাহলে অবশ্যই কমেন্ট করিয়া জানাইতে ভুলিবেন না।
New Romantic Love Story in Bengali – রোমান্টিক প্রেমের গল্প
আজকের গল্প – সতী
হরিশ পাবনার একজন সম্রান্ত ভালাে উকিল। কেবল ওকালতি হিসাবেই নয়, মানুষ হিসেবেও বটে। দেশের সর্বপ্রকার সদনুষ্ঠানের সহিতই সে অল্প-বিস্তর সংশ্লিষ্ট। শহরের কোনাে কাজই তাহাকে বাদ দিয়া হয় না।
সকালে ‘দুর্নীতি-দমন’ সমিতির কার্যকরী সভার একটা বিশেষ অধিবেশন ছিল, কাজ সারিয়া বাড়ি ফিরিতে বিলম্ব হইয়া গেছে, এখন কোনােমতে দুটি খাইয়া লইয়া আদালতে পৌঁছিতে পারিলে হয়। বিধবা ছােট বােন উমা। কাছে বসিয়া তত্ত্বাবধান করিতেছিল পাছে বেলার অজুহাতে খাওয়ার ত্রুটি ঘটে। স্ত্রী নির্মলা ধীরে ধীরে প্রবেশ করিয়া অদূরে উপবেশন করিল, কহিল, কাল-কের কাগজে দেখলাম আমাদের লাবণ্যপ্রভা আসছেন এখানকার মেয়ে-ইস্কুলের পরিদর্শিকা হয়ে। এই সহজ কথা কয়টির ইঙ্গিত অতীব গভীর। উমা চকিত হইয়া কহিল, সত্যি নাকি? তা লাবণ্য নাম তাে কত আছে বৌদি। নির্মলা বলিল, তা আছে। ওঁকে জিজ্ঞেস করছি। হরিশ মুখ তুলিয়া সহসা কটুকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, আমি জানবাে কী করে শুনি? গভর্নমেন্ট কি আমার সঙ্গে পরামর্শ করে লােক বাহাল করে নাকি? স্ত্রী স্নিগ্ধস্বরে জবাব দিল, আহা রাগ করাে কেন, রাগের কথা তাে বলিনি।
তােমার তদবির-তাগাদায় যদি কারও উপকার হয়ে থাকে সে তাে আহ্লাদের কথা। এই বলিয়া যেমন আসিয়াছিল তেমনি মন্থর মৃদুপদে বাহির হইয়া গেল। উমা শশব্যস্ত হইয়া উঠিল আমার মাথা খাও দাদা, উঠো না উঠো না। হরিশ, বিদ্যুৎ বেগে আসন ছাড়িয়া উঠিল নাঃ শান্তিতে এক মুঠো খাবারও জো নেই। উঃ আত্মঘাতী না হলে আর, বলিতে বলিতে দ্রুতবেগে বাহির হইয়া গেল। যাবার পথে স্ত্রীর মধুর কণ্ঠ কানে গেল, তুমি কোন্ দুঃখে আত্মঘাতী হবে? যে হবে সে একদিন জগৎ দেখবে। এখানে হরিশের একটু পূর্ব-বৃত্তান্ত বলা প্রয়ােজন। এখন তাহার বয়স চল্লিশের কম নয়, কিন্তু কম যখন সত্যই ছিল সেই পাঠ্যাবস্থার একটু ইতিহাস আছে। পিতা রামমােহন তখন বরিশালের সব-জজ, হরিশ এম-এ পরীক্ষার পড়া তৈরি করিতে কলিকাতা ছাড়িয়া বরিশালে আসিয়া উপস্থিত হইল। প্রতিবেশী ছিলেন হরকুমার মজুমদার, স্কুল-ইনসপেক্টর। লােকটি নিরীহ, নিরহংকার এবং অগাধ পণ্ডিত।
সরকারী কাজে ফুরসত পাইলে এবং সদরে থাকিলে মাঝে মাঝে আসিয়া সদর-আলা বাহাদুরের বৈঠকখানায় বসিতেন। অনেকেই আসিতেন। টাক-ওয়ালা মুনসেফ, দাড়ি-ছাঁটা ডেপুটি, মহাস্থবির সরকারী উকিল এবং শহরের অন্যান্য মান্য-গণ্যের দল সন্ধ্যার পরে কেহই প্রায় অনুপস্থি থাকিতেন না। তাহার কারণ ছিল সদর-আলা নিজে ছিলেন নিষ্ঠাবান হিন্দু। অতএব আলাপ-আলােচনার অধিকাংশই হইত ধর্ম সম্বন্ধে এবং যেমন সর্বত্র ঘটে এখানেও। তেমনি আধ্যাত্ম-তত্ত্বকথার শাস্ত্রীয় মীমাংসা সমাধা হইত খণ্ডযুদ্ধের অবসানে। সেদিন এমনি একটি লড়াইয়ের মাঝখানে হরকুমার তাহার বাঁশের ছড়িটি হাতে করিয়া আস্তে আস্তে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। এই সকল যুদ্ধ-বিগ্রহ ব্যাপারে কোনােদিন তিনি কোনাে অংশগ্রহণ করিতেন না। নিজে ব্রাম্ম-সমাজ-ভুক্ত ছিলেন বলিয়াই হােক।
অথবা শান্ত মৌন প্রকৃতির মানুষ ছিলেন বলিয়াই হােক, চুপ করিয়া শােনা ছাড়া গায়ে পড়িয়া অভিমত প্রকাশ করিবার চঞ্চলতা তাহার একটি দিনও প্রকাশ পায় নাই। আজ কিন্তু অন্যরুপ ঘটিল। তিনি ঘরে ঢুকিতেই টাকওয়ালা মুনসেফবাবু তাহাকেই মধ্যস্থ মানিয়া বসিলেন। ইহার কারণ, এইবার ছুটিতে কলিকাতায় গিয়া তিনি কোথায় যেন এই লােকটির ভারতীয় দর্শন সম্বন্ধে গভীর জ্ঞানের একটা জনরব শুনিয়া আসিয়া-ছিলেন।। হরকুমার স্মিতহাস্যে সম্মত হইলেন। অল্পক্ষণেই বুঝা গেল, শাস্ত্রের বঙ্গানুবাদ মাত্র সম্বল করিয়া ইহার সহিত তর্ক চলে না। সবাই খুশি হইলেন, হইলেন না শুধু সব-জজ বাহাদুর নিজে। অর্থাৎ যে ব্যক্তি জাতি দিয়াছে তাহার আবার শাস্ত্রজ্ঞান কিসের জন্য? এবং বলিলেনও ঠিক তাই।
সকলে উঠিয়া গেলে তাহার পরমপ্রিয় সরকারী উকিলবাবুকে চোখের ইঙ্গিতে হাসিয়া কহিলেন, শুনলেন তাে ভাদুড়ী মশাই, ভূতের মুখে রাম নাম আর কি! ভাদুড়ী ঠিক সায় দিতে পারিলেন না, কহিলেন, তা বটে কিন্তু জানে খুব। সমস্ত যেন মুখস্ত। আগে মাস্টারি করত কিনা। হাকিম প্রসন্ন হইলেন না বলিলেন, ও জানার মুখে আগুন। এরাই হল জ্ঞানপাপী। এদের আর মুক্তি নেই। হরি সেদিন চুপ করিয়া একাধারে বসিয়াছিল। এই স্বল্পভাষী মেধাবী প্রৌঢ়ের জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য দেখিয়া সে মুগ্ধ হইয়াছিল। সুতরাং পিতার অভিমত যাহাই হােক, পুত্র তাহার আসন্ন পরীক্ষা-সমুদ্র হইতে মুক্তি পাইবার ভরসায় তাঁহাকে গিয়া ধরিয়া পড়িল সাহায্য করিতে হইবে। হরকুমার সম্মত হইলেন। এইখানে তাহার কন্যা লাবণ্যের সহিত হরিশের পরিচয় হইল। সেও আই-এ পরীক্ষার পড়া তৈরি করিতে কলিকাতার গণ্ডগােল ছাড়িয়া পিতার কাছে আসিয়াছিল। সেইদিন হইতে পতিদিনের আনাগােনায় হরিশ পাঠ্যপুস্তকের দুরুহ অংশের অর্থই শুধু জানিল না, আরও একটা জটিলতর বস্তুর স্বরূপ জানিয়া লইল যাহা তত্ত্ব হিসাবে ঢের বড়াে।
কিন্তু সে কথা এখন থাক। ক্রমশঃ পরীক্ষার দিন কাছে ঘেঁষিয়া আসিতে লাগিল, হরিশ কলিকাতায় চলিয়া গেল। পরীক্ষা সে ভালােই দিল এবং ভালাে করিয়াই পাস করিল। কিছুকাল পরে আবার যখন দেখা হইল হরিশ সমবেদনায় মুখ পাংশু করিয়া প্রশ্ন করিল, আপনি ফেল করলেন যেন বড়াে? লাবণ্য কহিল, এইটুকুও পারব না, আমি এতই অক্ষম? হরিশ হাসিয়া ফেলিল, বলিল, যা হবার হয়েছে, এবার কিন্তু খুব ভালাে করে একজামিন দেওয়া চাই। লাবণ্য কিছুমাত্র লজ্জা পাইল না, বলিল, খুব ভালাে করে দিলেও আমি ফেল হব। ও আমি পারব না। হরিশ অবাক হইল, জিজ্ঞাসা করিল, পারবে না কি রকম ?
লাবণ্য জবাব দিল, কি রকম আবার কি? এমনি, এই বলিয়া সে হাসি চাপিয়া দ্রুতপদে প্রস্থান করিল!
ক্রমশঃ কথাটা হরিশের মাতার কানে গেল। সেদিন সকালে রামমােহনবাবু মকদ্দমার রায় লিখিতেছিলেন। যে দুর্ভাগা হারিয়াছে তাহার আর কোনাে কূল-কিনারা না থাকে, এই শুভ সংকল্প কার্যে পরিণত করিতে। রায়ের মুসাবিদায় বাছিয়া বাছিয়া শব্দ-যােজনা করিতেছিলেন, গৃহিণীর মুখে ছেলের কাণ্ড শুনিয়া তাহার মাথায় আগুন ধরিয়া গেল। হরিশ নরহত্যা করিয়াছে শুনিলেও বােধকরি তিনি এতখানি বিচলিত হইতেন না। দুই চক্ষু রক্তবর্ণ করিয়া কহিলেন, কী! এত বড়াে। ইহার অধিক কথা তাহার মুখে আর জোগাইল না। দিনাজপুরে থাকিতে একজন প্রাচীন উকিলের সহিত তাহার শিখার গুচ্ছ, গীতার মর্মার্থ ও পেনশানান্তে কাশীবাসের উপকারিতা লইয়া অত্যন্ত মতের মিল ও হৃদ্যতা জন্মিয়াছিল।
একটা ছুটির দিনে গিয়া তাহারই ছােট মেয়ে নির্মলাকে আর একবার চোখে দেখিয়া ছেলের বিবাহের পাকা কথা দিয়া আসিলেন। মেয়েটি দেখিতে ভালাে। দিনাজপুরে থাকিতে গৃহিণী তাহাকে অনেকবার দেখিয়াছেন, তথাপি স্বামীর কথা শুনিয়া গালে হাত দিলেন বলাে কি গাে, একেবারে পাকা কথা দিয়ে এলে ? আজকালকার ছেলে কর্তা কহিলেন, কিন্তু আমি তাে আজকালকার বাপ নই। আমি আমার সেকেলে নিয়মেই ছেলে মানুষ করতে পারি। হরিশের পছন্দ যদি না হয় তাকে আর কোনাে উপায় দেখতে বােলাে। গৃহিণী স্বামীকে চিনিতেন তিনি নির্বাক হইয়া গেলেন। কর্তা পুনশ্চ বলিলেন, মেয়ে ডানাকাটা পরী না হােক ভদ্রঘরের কন্যা। সে যদি তার মায়ের সতীত্ব আর বাপের হিন্দুয়ানী নিয়ে আমাদের ঘরে আসে, তাই যেন হরিশ ভাগ্য বলে মানে। খবরটা প্রকাশ পাইতে বিলম্ব হইল না। হরিশও শুনিল প্রথমে সে মনে করিল।
পলাইয়া কলিকাতায় গিয়া, কিছু না জুটে, টিউশনি করিয়া জীবিকানির্বাহ করিবে। পরে ভাবিল সন্ন্যাসী হইবে। শেষে পিতা স্বর্গঃ পিতা ধর্মঃ পিতাহি পরমং তপঃ ইত্যাদি স্মরণ করিয়া স্থির হইয়া রহিল। কন্যার পিতা ঘটা করিয়া পাত্র দেখিতে আসিলেন এবং আশীর্বাদের কাজটাও এই সঙ্গে সারিয়া লইলেন। সভায় শহরের বহু সম্রান্ত ব্যক্তিই আমন্ত্রিত হইয়া আসিয়াছিলেন, নিরীহ হরকুমার কিছু না জানিয়াই আসিয়াছিলেন। তাহাদের সমক্ষে রায়বাহাদুর ভাবী বৈবাহিক মৈত্র মহাশয়ের হিন্দু ধর্মের প্রগাঢ় নিষ্ঠার পরিচয় দিলেন এবং ইংরাজি শিক্ষার সংখ্যাতীত দোষ-কীর্তন করিয়া অনেকটা এইরূপ অভিমত প্রকাশ করিলেন যে, তাহাকে হাজার টাকা মাহিনার চাকুরি দেওয়া ব্যতীত ইংরাজের আর কোনাে গুণ নাই। আজকাল দিন-ক্ষণ অন্যরূপ হইয়াছে, ছেলেদের ইংরাজি না পড়াইলে চলে না। কিন্তু যে মূখ এই ম্লেচ্ছবিদ্যা ও ম্লেচ্ছ-সভ্যতা হিন্দুর শুদ্ধান্তঃপুরে মেয়েদের মধ্যে টানিয়া আনে তাহার
ইহকালও নাই পরকালও নাই। একা হরকুমার ভিন্ন ইহার নিগুঢ় অর্থ কাহারও অবিদিত রহিল না।
সেদিন সভা ভঙ্গ হইবার পূর্বেই বিবাহের দিন স্থির হইয়া গেল এবং যথাকালে শুভকর্ম সমাধা হইতেও বিঘ্ন ঘটিল না। কন্যাকে শ্বশুর-গৃহে পাঠাইবার প্রাক্কালে মৈত্র গৃহিণী, নির্মলার সতী-সাধ্বী মাতা ঠাকুরানী বধূ জীবনের চরম তত্ত্বটি মেয়ের কানে দিলেন। বলিলেন, মা পুরুষ মানুষকে চোখে চোখে না রাখলেই সে গেল। সংসার করতে আর যা-ই কেন না ভােলাে, কখনাে এ কথাটি ভুলাে না। তাহার নিজের স্বামী টিকির গােছা ও শ্রীগীতার মর্মার্থ লইয়া মাতিয়া উঠিবার পূর্ব পর্যন্ত তাহাকে অনেক জ্বালাইয়াছেন। আজিও তাহার দৃঢ় বিশ্বাস, মৈত্র-বুড়া চিতায় শয়ন না করিলে আর তাহার নিশ্চিন্ত হইবার জো নাই। নির্মলা স্বামীর ঘর করিতে আসিল এবং সেই ঘর আজ বিশ বর্ষ ধরিয়া করিতেছে। এই সুদীর্ঘকাল কত পরিবর্তন, কত কি ঘটিল।
রায়বাহাদুর মরিলেন, স্বধর্মনিষ্ঠ মৈত্র গতাসু হইলেন, লেখাপড়া সাঙ্গ হইলে লাবণ্যের অন্যত্র বিবাহ হইল, জুনিয়ার উকিল হরিশ সিনিয়ার হইয়া উঠিলেন, বয়স তখন যৌবন পার হইয়া প্রৌঢ়ত্বে গিয়া পড়িল, কিন্তু নির্মলা তাহার মাতৃদত্ত মন্ত্র আর এ জীবনে ভুলিল না। এই সজীব মন্ত্রের ক্রিয়া যে এত সত্বর শুরু হইবে তাহা কে জানিত! রায়বাহাদুর তখনও জীবিত, পেনশন লইয়া পাবনার বাটীতে আসিয়া বসিয়াছেন। হরিশের এক উকিল-বন্ধুর পিতৃশ্রাদ্ধ-উপলক্ষ্যে কলিকাতা হইতে একজন ভালাে কীর্তনওয়ালী আসিয়াছিল, সে দেখিতে সুশ্রী এবং বয়স কম। অনেকেরই ইচ্ছা ছিল কাজকর্ম অন্তে একদিন ভালাে করিয়া তাহার কীর্তন শুনা। পরদিন হরিশের গান শুনিবার নিমন্ত্রণ হইল ; শুনিয়া বাড়িতে ফিরিতে একটু অধিক রাত্রি হইয়া গেল।
নির্মলা উপরের খােলা বারান্দায় রাস্তার দিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়াছিল ; স্বামীকে উপরে উঠিতে দেখিয়াই জিজ্ঞাসা করিল, গান লাগলাে কেমন? হরিশ খুশি হইয়া কহিল, খাসা গায়। দেখতে কেমন? মন্দ না, ভালােই।
নির্মলা কহিল, তা হলে রাতটা একেবারে কাটিয়ে এলেই তাে পারতে। এই অপ্রত্যাশিত কুৎসিত মন্তব্যে হরিশ ক্রুদ্ধ হইবে কি, বিস্ময়ে অভিভূত হইয়া গেল। তাহার মুখ দিয়া শুধু বাহির হইল, কি রকম? নির্মলা সক্রোধে বলিল, রকম ভালােই। আমি কচি খুকী নই, জানি সব, বুঝি সব। আমার চোখে ধুলাে দেবে তুমি? আচ্ছা । উমা পাশের ঘর হইতে ছুটিয়া আসিয়া সভয়ে কহিল, তুমি করছাে কি বৌদি, বাবা শুনতে পাবেন যে! নির্মলা জবাব দিল, পেলেনই বা শুনতে। আমি তাে চুপি চুপি কথা কইছিনে। এই উত্তরের প্রত্যুত্তরে যে উমা কি বলিবে ভাবিয়া পাইল না, কিন্তু পাছে তাহার উচ্চস্বরে বৃদ্ধ পিতার ঘুম ভাঙিয়া যায় এই ভয়ে সে পরক্ষণেই জোড়-হাতে ক্রুদ্ধ চাপা গলায়। মিনতি করিয়া কহিল, রক্ষে করাে বৌদি, এত রাত্রে চেঁচিয়ে আর কেলেঙ্কারি করাে না।
কহিল, কিসের কেলেঙ্কারি! তুমি বলবে না কেন ঠাকুরঝি, তােমার বুকের ভেতর তাে আর জ্বলে-পুড়ে যাচ্ছে না! বলিতে বলিতে সে কঁদিয়া ফেলিয়া দ্রুতবেগে ঘরে ঢুকিয়া সশব্দে দ্বারে খিল বন্ধ করিয়া দিল।
হরিশ কাঠের পুতুলের মতাে নিঃশব্দে নিচে আসিয়া বাকি রাতটুকু মক্কেলদের বসিবার বেঞ্চের উপর শুইয়া কাটাইল।
অতঃপর দিন দশেকের মতাে উভয়ের বাক্যালাপ স্থগিত হইয়া গেল। কিন্তু হরিশকেও আর সন্ধ্যার পরে বাহিরে পাওয়া যায় না। গেলেও তাহার শঙ্কাকুল ব্যাকুলতা লােকের হাসির বস্তু হইয়া উঠিল। বন্ধুরা রাগ করিয়া বলিতে লাগিলেন, হরিশ, যত বুড়াে হচ্ছে, রােগও তত বেড়ে যাচ্ছে হে! হরিশ অধিকাংশ স্থলেই জবাব দিত না, কেবল খোঁচা বেশি করিয়া বিধিলেই বলিত, এই ঘেন্নায় আমাকে যদি তােমরা ত্যাগ করতে পারাে তাে তােমরাও বাঁচো আমিও বাঁচি।
বন্ধুরা কহিতেন, বৃথা! বৃথা! ওকে লজ্জা দিতে গিয়ে এখন নিজেরাই লজ্জায় মরি। সেবার বসন্তরােগে লােক মরিতে লাগিল খুব বেশি। হরিশকেও রােগে ধরিল। কবিরাজ আসিয়া পরীক্ষা করিয়া মুখ গম্ভীর কহিলেন কহিলেন, মারাত্মক রক্ষা পাওয়া কঠিন। রায়বাহাদুর তখন পরলােকে। হরিশের বৃদ্ধা মাতা আছাড় খাইয়া পড়িলেন। নির্মলা ঘর হইতে বাহির হইয়া কহিল, আমি যদি সতী মায়ের সতী কন্যা হই, আমার নােয়া-সিঁদুর ঘােচাবে সাধ্যি কার? তােমরা ওঁকে দেখাে, আমি চললুম। এই বলিয়া সে শীতলার মন্দিরে গিয়া হত্যা দিয়া পড়িল। কহিল, উনি বাঁচেন তাে আবার বাড়ি ফিরবাে, নইলে এইখান থেকে ওঁর সঙ্গে যাবাে। সাত দিনের মধ্যে দেবতার চরণামৃত ভিন্ন কেহ তাহাকে জল পর্যন্ত খাওয়াইতে পারিল না।
কবিরাজ আসিয়া বলিল, মা, তােমার স্বামী আরােগ্য হয়েছেন, এবার তুমি ঘরে চলাে। লােক ভিড় করিয়া দেখিতে আসিল। মেয়েরা পায়ের ধুলা লইল, তাহার মাথায় থাবা থাবা সিঁদুর ঘষিয়া দিল কহিল মানুষ তাে নয়, যেন সাক্ষাৎ মা বৃদ্ধেরা বলিলেন, সাবিত্রীর উপাখ্যান মিথ্যে, না কলিতে ধর্ম গেছে বলেই একেবারে ষােলাে-আনা গেছে? যমের মুখ থেকে স্বামীকে ফিরিয়ে নিয়ে এলাে। বন্দুরা লাইব্রেরী- ঘরে বলাবলি করিতে লাগিল, সাধে আর মানুষে স্ত্রীর গােলাম হয় হে! বিয়ে তাে আমরাও করেছি, কিন্তু এমন নইলে আর স্ত্রী! এখন বােঝা গেল কেন হরিশ সন্ধ্যার পরে বাইরে থাকত না। বীরেন উকিল ভক্ত লােক, গত বৎসর ছুটিতে কাশী গিয়া সে সন্ন্যাসীর কাছে মন্ত্র লইয়া আসিয়াছে,টেবিলে প্রচণ্ড করাঘাত করিয়া কহিল, আমি জানতাম হরিশ মরতে-ইপা রে না। সত্যিকার সতীত্ব জিনিসটা কি সােজা ব্যাপার হে? বাড়ি থেকে বলে গেল,যদি সতী মায়ের সতী কন্যা হই তাে উঃ! শরীর শিউরে ওঠে। তারিণী চাটুজ্জের বয়স হইয়াছে, আফিং-খাের লােক।
একধারে বসিয়া নিবিষ্টচিত্তে তামাক খাইতেছিল, হুঁকাটা বেহারার হাতে দিয়া নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, শাস্ত্রমতে সহধর্মিণী কথাটা ভারী শক্ত। আমার দেখ না, কেবল মেয়েই সাতটা ; বিয়ে দিতে দিতে ফতুর হয়ে গেলাম ।অনেকদিন পরে ভালাে হইয়া আবার যখন হরিশ আদালতে উপস্থিত হইল তখন কত লােক যে তাহাকে অভিনন্দিত করিল তাহার সংখ্যা নাই। ব্রজেন্দ্রবাবু সখেদে কহিলেন, ভাই হরিশ, স্ত্রৈণ বলে তােমাকে অনেক লজ্জা দিয়েছি, মাপ করাে। লক্ষ কেন, কোটি কোটির মধ্যেও তােমার মতাে ভাগ্যবান নেই, তুমি ধন্য।ভক্ত বীরেন বলিল, সীতা-সাবিত্রীর কথা না হয় ছেড়ে দাও, কিন্তু খনা, লীলাবতী গার্গী আমাদের দেশেই জন্মেছিলেন। ভাই, স্বরাজ ফরাজ যাই-ই বলাে, কিছুতেই হবে না মেয়েদের যতদিন না আবার তেমনি তৈরি করতে পারবাে। আমার তাে মনে হয়, শীঘ্রই পাবনায় একটা আদর্শ নারী-শিক্ষা-সমিতি গড়ে তােলা প্রয়ােজন এবং যে আদর্শ মহিলা তার পার্মানেন্ট প্রেসিডেন্ট হবেন তার নাম তাে আমরা সবাই জানি। বৃদ্ধ তারিণী চাটুজ্জে বলিলেন, সেই সঙ্গে একটা পণ-প্রথা নিবারণী সমিতিও হওয়া আবশ্যক।
দেশটা ছারখার হয়ে গেল।
ব্রজেন্দ্র কহিলেন, হরিশ, তােমার তাে ছেলেবেলায় খাসা লেখার হাত ছিল, তােমার উচিত তােমার এই রিকভারি সম্বন্ধে একটি আর্টিকেল লিখে আনন্দবাজার পত্রিকায়
ছাপিয়ে দেওয়া। হরিশ কোনাে কথারই জবাব দিতে পারিল না, কৃতজ্ঞতায় তাহার দুই চক্ষু ছল্ ছল্ করিতে লাগিল। মৃত জমিদার গোঁসাইচ-রণের বিধবা পুত্রবধূর সহিত অন্যান্য পুত্রদের বিষয় সংক্রান্ত মামলা বাধিয়াছিল। হরিশ ছিল বিধবার উকিল। জমিদারের আমলা কে-যে কোন্ পক্ষে জানা কঠিন বলিয়া গােপনে পরামর্শের জন্য বিধবা নিজেই ইতিপূর্বে দুই-একবার উকিলের বাড়ি আসিয়াছিলেন। আজ সকালেও তাহার গাড়ি আসিয়া হরিশের সদর দরজায় থামিল। হরিশ সসম্রমে তাহার নিজের বসিবার ঘরে আনিয়া বসাইল। আলােচনা পাছে ও ঘরে মুহুরীর কানে যায়, এই ভয়ে উভয়েই সাবধানে ধীরে ধীরে কথা কহিতে-ছিল। বিধবার কি একটা অসংলগ্ন প্রশ্নে হরিশ হাসিয়া ফেলিয়া জবাব দিবার চেষ্টা করিতেই পাশের ঘরে পর্দার আড়াল হইতে অকস্মাৎ তীক্ষকণ্ঠের শব্দ আসিল, আমি সব শুনেছি। বিধবা চমকিয়া উঠিল, হরিশ লজ্জা ও শঙ্কায় কাঠ হইয়া গেল। একজোড়া অতি সতর্ক চক্ষু কর্ণ যে তাহাকে অহরহ পাহারা দিয়া আছে, এ-কথা সে মুহুর্তের জন্য ভুলিয়াছিল।
পর্দা ঠেলিয়া নির্মলা রণমূর্তিতে বাহির হইয়া আসিল, হাত নাড়িয়া কণ্ঠস্বরে বিষ ঢালিয়া দিয়া কহিল, ফুস ফুস করে কথা কয়ে আমাকে ফাঁকি দেবে? মনেও কোরাে না।
কই, আমার সঙ্গে তাে কখনাে এমন হেসে কথা কইতে দেখিনি! অভিযােগ নিতান্ত মিথ্যা নয়। বিধবা সভয়ে কহিল, এ কি কাণ্ড হরিশবাবু!হরিশ বিমূঢ়ের মতাে ক্ষণকাল চাহিয়া থাকিয়া বলিল, পাগল। নির্মলা কহিল, পাগল? পাগলই বটে।
কিন্তু করলে কে শুনি? বলিয়া সে হাউ হাউ করিয়া কাঁদিয়া ফেলিয়া সহসা হাঁটু গাড়িয়া বিধবার পায়ের কাছে ঢিপ ঢিপ করিয়া মাথা খুঁড়িতে লাগিল।
মুহুরী কাজ ফেলিয়া ছুটিয়া আসিল, একজন জুনিয়ার উকিল সেইমাত্র আসিয়াছিল সে আসিয়া দ্বারের কাছে দাঁড়াইল, বােস্ কোম্পানির বিল সরকার তাহারই কাধের উপর দিয়া উকি মারিতে লাগিল এবং তাহাদের চোখের সম্মুখে নির্মলা মাথা খুঁড়িতে লাগিল আমি সব জানি, আমি সব বুঝি, থাকো, তােমরাই সুখে থাকো।
কিন্তু সতী মায়ের সতী কন্যা যদি হই, যদি মনে-জ্ঞানে এক বই দুই না জেনে থাকি, যদি এদিকে বিধবা নিজেও কাঁদিয়া ফেলিয়া বলিতে লাগিল, এ কি ব্যাপার হরিশবাবু। এ কি দুর্নাম দেওয়া এ কি আমার- হরিশ কাহারও কোনাে প্রতিবাদ করিল না। অধােমুখে দাঁড়াইয়া শুধু তাহার মনে হইতে লাগিল, পৃথিবী দ্বিধা হও না কিসের জন্য?
লজ্জায় ঘৃণায় ক্রোধে সেদিন হরিশ সেই ঘরেই স্তব্ধ হইয়া রহিল, আদালতে বাহির হইবার কথা ভাবিতেও পারিল না। মধ্যাহ্নে উমা আসিয়া বহু সাধ্য-সাধনা এবং মাথার দিব্য দিয়া কিছু খাওয়াইয়া গেল।
হরিশের প্রথমে ইচ্ছা হইল লাথি মারিয়া ফেলিয়া দেয়, কিন্তু আত্মসংবরণ করিয়া আজও পায়ের বুড়া আঙুলটা ডুবাইয়া দিল। স্বামীর পাদোদক পান না করিয়া নির্মলা কোনােদিন জল-স্পর্শ করিত না।
রাত্রে বাহিরের ঘরে একাকী শয়ন করিয়া হরিশ ভাবিতেছিল, তাহার এই দুঃখময় দুর্ভর জীবনের অবসান হইবে কবে? এমনি অনেকদিন অনেক রকমেই ভাবিয়াছে, কিন্তু তাহার এই সতী স্ত্রীর একনিষ্ঠ পতিপ্রেমের সুদুঃসহ নাগপাশের বাঁধন হইতে মুক্তির কোনাে পথই তাহার চোখে পড়ে নাই।
পাঁচ বছর দুই গত হইয়াছে। নির্মলা অনুসন্ধান করিয়া জানিয়াছে যে, খবরের কাগজের খবর ঝুটা নয়।
লাবণ্য যথার্থই পাবনার মেয়ে-ইস্কুলের পরিদর্শক হইয়া আসিতেছে। আজ হরিশ একটু সকাল-সকাল আদালত হইতে ফিরিয়া ছােট বােন উমাকে জানাইল যে, রাত্রের ট্রেনে তাহাকে বিশেষ জরুরী কাজে কলিকাতায় যাইতে হইবে, ফিরিতে বােধহয় দিন চারেক বিলম্ব হইবে। বিছানা এবং প্রয়ােজনীয় কাপড়-চোপড় যেন চাকরকে দিয়া ঠিক করিয়া রাখা হয়।
দিন-পনেরাে হইল স্বামী-স্ত্রীতে বাক্যালাপ বন্ধ ছিল।রেলওয়ে স্টেশন দূরে, রাত্রি আটটার মধ্যেই মােটরে বাহির হইয়া পড়িতে হইবে। সন্ধ্যার পর সে মকদ্দমার দরকারী কাগজপত্র হ্যান্ডব্যাগে গুছাইয়া লইতেছিল, নির্মলা আসিয়া প্রবেশ করিল।
হরিশ মুখ তুলিয়া চাহিয়া দেখিল, কিছু বলিল না।নির্মলা ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া প্রশ্ন করিল, আজ কলকাতায় যাচ্ছাে নাকি?
হরিশ কহিল, হুঁ। কেন? কেন আবার কি! মক্কেলের কাজ, হাইকোর্টে মকদ্দমা আছে।
চলাে না, আমিও তােমার সঙ্গে যাই। তুমি যাবে? গিয়ে কোথায় থাকবে শুনি? নির্মলা কহিল, যেখানে হােক। তােমার সঙ্গে গাছতলায় থাকতেও আমার লজ্জা নেই। কথাটি ভালাে এবং সতী স্ত্রীরই উপযুক্ত।
কিন্তু হরিশের সর্বাঙ্গে যেন বিছুটি মাখাইয়া দিল। কহিল, তােমার লজ্জা না থাক, আমার আছে। আমি গাছতলার পরিবর্তে আপাতত কোনাে এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে উঠব স্থির করেছি। নির্মলা বলিল, তা হলে তাে ভালােই হল, তাঁর বাড়িতেও স্ত্রী আছে, ছেলে-মেয়ে আছে, আমার কোনাে অসুবিধা হবে না।
হরিশ কহিল, না, সে হবে না। বলা নেই কহা নেই, বিনা আহ্বানে পরের বাড়ি তােমাকে নিয়ে গিয়ে আমি উঠতে পারব না। নির্মলা বলিল, পারবে না সে জানি, আমাকে সঙ্গে নিয়ে লাবণ্যের ওখানে ওঠা যায় না।
দিন-তিনেক পরে হরিশ কলিকাতা হইতে ফিরিয়া আসিলে স্ত্রী কহিল, চার-পাঁচ দিন বলে গেলে, তিন দিনেই ফিরে এলে যে বড়াে? হরিশ কহিল, কাজ চুকে গেল, চলে এলাম। নির্মলা জোর করিয়া একটু হাসিয়া প্রশ্ন করিল, লাবণ্যের সঙ্গে দেখা হয়নি বুঝি?
হরিশ কহিল, না। নির্মলা অতিশয় ভালাে মানুষের মতাে জিজ্ঞাসা করিল, কলকাতাতেই যদি গেলে একবার খবর নিলে না কেন? হরিশ জবাব দিল, সময় পাইনি।
অত কাছাকাছি গেলে, সময় একটুখানি করে নিলেই হত। এই বলিয়া সে চলিয়া গেল ইহার মাসখানেক পরে, একদিন আদালতে বাহির হইবার সময়ে হরিশ ভগিনীকে ডাকিয়া কহিল, আজ আমার ফিরতে বােধকরি একটু রাত হয়ে যাবে উমা।
কেন দাদা?
উমা কাছেই ছিল, আস্তে বলিলেই চলিত, কিন্তু কণ্ঠস্বর উঁচুতে চড়াইয়া অদৃশ্য কাহাকেও লক্ষ্য করিয়া হরিশ উত্তর দিল, যােগীনবাবুর বাড়িতে একটা জরুরী পরামর্শ। আছে, দেরি হয়ে যেতে পারে।
ফিরিতে দেরিই হইল। রাত্রি বারােটার কম নয়।
হরিশ মােটর হইতে নামিয়া বাহিরের ঘরে গিয়া প্রবেশ করিল।
কাপড় ছাড়িতে ছাড়িতে শুনিতে পাইল, স্ত্রী উপরের জানালা হইতে সােফারকে ডাকিয়া বলিতেছে, আবদুল, যােগীনবাবুর বাড়ি থেকে এলে বুঝি ? আবদুল কহিল, নেহি মাইজী, স্টেশন সে আতেহেঁ।
ইস্টিশান?
ইস্টিশান কেন ?
গাড়িতে কেউ এলাে বুঝি?
আবদুল কহিল, কলকাত্তাসে এক মাইজী আউর বাচ্চা আয়া। কলকাতা থেকে? বাবু গিয়ে তাদের নিয়ে এসে বাসায় পৌঁছে দিলেন বুঝি?
আবদুল হাঁ বলিয়া জবাব দিয়া গাড়ি আস্তাবলে লইয়া গেল। ঘরের মধ্যে হরিশ আড়ষ্ট হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। এরূপ সম্ভাবনার কথা যে তাহার মনে হয় নাই তাহা নয়, কিন্তু নিজের চাকরকে মিথ্যা বলিতে অনুরােধ করিতে সে কিছুতেই পারিয়া উঠে নাই। রাত্রে শােবার ঘরের মধ্যে একটা কুরুক্ষেত্র-কাণ্ড হইয়া গেল।
পরদিন সকালেই লাবণ্য ছেলে লইয়া এ বাড়িতে আসিয়া উপস্থিত হইল। হরিশ বাহিরের ঘরে ছিল, তাহাকে কহিল, আপনার স্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় নেই, চলুন আলাপ করিয়ে দেবেন। হরিশের বুকের মধ্যে তােলপাড় করিতে লাগিল, একবার সে এমনও বলিতে চাহিল যে, এখন অত্যন্ত কাজের তাড়া, কিন্তু সে অজুহাত খাটিল না। তাহাকে সঙ্গে করিয়া আনিয়া স্ত্রীর সহিত পরিচয় করাইয়া দিতে হইল। বছর দশেকের ছেলে এবং লাবণ্য, নির্মলা তাহাদের সমাদরে গ্রহণ করিল।
ছেলেকে খাবার খাইতে দিল এবং তাহার মাকে আসন পাতিয়া সযত্নে বসাইল, কহিল, আমার সৌভাগ্য যে আপনার দেখা পেলাম। লাবণ্য ইহার উত্তর দিয়া বলিল, হরিশবাবুর মুখে শুনেছিলাম আপনি ক্রমাগত বার-ব্রত আর উপবাস করে করে শরীরটাকে নষ্ট করে ফেলেছেন। এখনাে তাে বেশ ভালাে দেখাচ্ছে না।
নির্মলা সহাস্যে কহিল, বাড়ানাে কথা। কিন্তু এ আবার উনি কবে বললেন? হরিশ তখনও কাছে দাঁড়াইয়াছিল, সে একেবারে বিবর্ণ হইয়া উঠিল।
লাবণ্য কহিল, এবার কলকাতায়, খেতে বসে কেবল আপনারই কথা। ওর বন্ধু কুশলবাবুর বাড়ি থেকে আমাদের বাড়ি খুব কাছে কিনা।
ছাদের ওপর চেঁচিয়ে ডাকলে শােনা যায়।
নির্মলা বলিল, খুব সুবিধে তাে। লাবণ্য হাসিয়া বলিল, কিন্তু তাতেই শুধু হয়নি, ছেলেকে পাঠিয়ে রীতিমতাে ধরে আনতে হত। বটে!
লাবণ্য বলিল, আবার জাতের গোঁড়ামিও কম নেই, ব্রাম্মনদের ছোঁয়া খান না। আমার পিসিমার হাতে পর্যন্ত না। সমস্তই আমাকে নিজে রেঁধে নিজে পরিবেশন করতে হত। এই বলিয়া সে হাসিমুখে সকৌতুকে হরিশের প্রতি চাহিয়া বলিল, আচ্ছা, এর মধ্যে আপনার কি লজিক আছে বলুন তাে?
আমি কি ব্রাম্মন-সমাজ ছাড়া? হরিশের সর্বাঙ্গ ঝিম ঝিম্ করিতে লাগিল, তাহার মিথ্যাবাদিতা প্রমাণিত হওয়ায় তাহার মনে হইল, এতদিনে মা বসুমতা দয়া করিয়া বােধহয় জঠরে টানিয়া লইতেছেন।
কিন্তু পরমাশ্চর্য এই যে, নির্মলা আজ ভয়ংকর উন্মাদ কাণ্ড কিছু একটা না করিয়া স্থির হইয়া রহিল।
হরিশ বাহিরে আসিয়া স্তব্দ পাংশুমুখে বসিয়া রহিল। এই ভীষণ সম্ভাবনার কথা স্মরণ করিয়া লাবণ্যকে পূর্বাহ্নে সতর্ক করিবার কথা বহুবার তাহার মনে হইয়াছে, কিন্তু আত্ম-অবমাননাকর ও একান্ত মর্যাদাহীন লুকোচুরির প্রস্তাব সে কোনাে মতেই এই শিক্ষিত ও ভদ্র মহিলাটির সম্মুখে উচ্চারণ করিতে পারে নাই। লাবণ্য চলিয়া গেলে নির্মলা ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকিয়া বলিল, ছিঃ তুমি এমন মিথ্যাবাদী!
এত মিথ্যা কথা বলাে?
হরিশ চোখ রাঙাইয়া লাফাইয়া উঠিল বেশ করি বলি, আমার খুশি। নির্মলা ক্ষণকাল স্বামীর মুখের প্রতি নিঃশব্দে চাহিয়া কাঁদিয়া ফেলিল। কহিল, বলাে যত ইচ্ছে মিথ্যে বলাে, যত খুশি আমাকে ঠকাও।
কিন্তু ধর্ম যদি থাকে, যদি সতী মায়ের মেয়ে হই, যদি কায়মনে সতী হই আমার জন্যে তােমার একদিন কাদতে হবে, হবে, হবে, বলিয়া সে যেমন আসিয়াছিল তেমনি দ্রুতবেগে বাহির হইয়া গেল।
বাক্যালাপ পূর্ব হইতেই বন্ধ চলিতেছিল, এখন সেটা দৃঢ়তর হইল এইমাত্র। নিচের ঘরে শয়ন ও ভােজন। হরিশ আদালতে যায় আসে, বাহিরের ঘরে একাকী বসিয়া কাটায়–নূতন কিছুই নয়। আগে সন্ধ্যার সময়ে একবার করিয়া ক্লাবে গিয়া বসিত, এখন সেটুকু বন্ধ হইয়াছে। কারণ শহরের সেইদিকে লাবণ্যের বাসা। তাহার মনে হয় পতিপ্রাণা ভার্যার দুই চক্ষু দশ চক্ষু হইয়া দশ দিক হইতে পতিকে অহরহ নিরীক্ষণ করিতেছে। তাহার বিরাম নাই, বিশ্রাম নাই, মাধ্যাকর্ষণের ন্যায় তাহা নিত্য।
স্নানের পরে আরশির দিকে চাহিয়া তাহার মনে হইত, সতী-সাধ্বীর এই অক্ষয় প্রেমের আগুনে তাহার কলুষিত দেহের নশ্বর মেদ-মজ্জা-মাংস শুষ্ক ও নিস্পাপ হইয়া অত্যন্ত দ্রুত উচ্চতর লােকের জন্য প্রস্তুত হইয়া উঠিতেছে। তাহার আলমারির মধ্যে একখানা কালী সিংহের মহাভারত ছিল। সময় যখন কাটিত না তখন তাহা হইতে বাছিয়া বাছিয়া সতী নারীর উপাখ্যান পড়িত। কী তার প্রচণ্ড বিক্রম ও কতই না অদ্ভুত কাহিনী। স্বামী পাপী-তাপী যাহাই হােক, কেবল মাত্র স্ত্রীর সতীত্বের জোরেই সমস্ত পাপ মুক্ত হইয়া অন্তে কল্পকাল তাহারা একত্রে বাস করে। কল্পকাল যে ঠিক কত হরিশ জানিত না ; কিন্তু সে যে কম নহে এবং মুনি ঋষিদের লেখা শাস্তুবাক্য যে মিথ্যা নহে, এই কথা মনে করিয়া তাহার সর্বাঙ্গ অবশ হইয়া উঠিত। পরলােকের ভরসায় জলাঞ্জলি দিয়া সে বিছানায় শুইয়া মাঝে মাঝে ইহলােকের ভাবনা ভাবিত।
কিন্তু কোনাে পথ নাই। সাহেবদের হইলে মামলা-মকদ্দমা খাড়া করিয়া এতদিনে যা হােক একটা ছাড়-রফা করিয়া ফেলিত ; মুসলমানদের হইলে তিন তালাক দিয়া বহু পূর্বেই চুকাইয়া ফেলিত ; কিন্তু নিরীহ, এক পত্নীব্রত ভদ্র বাঙালী না, কোনাে উপায় নাই। ইংরাজি শিক্ষায় বহু-বিবাহ ঘুচিয়াছে, বিশেষতঃ নির্মলা চন্দ্র সূর্য তাহার। মুখ দেখিতে পায় না, অতি-বড়াে শত্রুও যাহার সতীত্বে বিন্দুমাত্র কলঙ্ক লেপন করিতে পারে না, বস্তুতঃ স্বামী ভিন্ন যাহার ধ্যান-জ্ঞান নাই, তাহাকেই পরিত্যাগ! বাপরে! নির্মলা নিষ্কলুষ হিন্দু-সমাজের মধ্যে কি আর মুখ দেখাইতে পারিবে।
এমনি করিয়া বােধহয় মাসাধিক কাল গত হইয়া গেছে, হরিশ আদালতে বাহির হইতেছিল, ঝি আসিয়া একখানা চিঠি তাহার হাতে দিল কহিল, জবাবের জন্য লােক দাঁড়িয়ে আছে। খাম ছেড়া, উপরে লাবণ্যের হস্তাক্ষর। হরিশ জিজ্ঞাসা করিল, চিঠি আমার, খুললে কে?
ঝি কহিল, মা। হরিশ চিঠি পড়িয়া দেখিল লাবণ্য অনেক দুঃখ করিয়া লিখিয়াছে, সেদিন আমার অসুখ চোখে দেখে গিয়েও আর একটিবারও খবর নিলেন না আমি মরলুম কি বাঁচলুম। অথচ বেশ জানেন এ বিদেশে আপনি ছাড়া আমার আপন লােকও কেউ নেই। যাই হােক ; এ-যাত্ৰা আমি মরিনি, বেঁচে আছি। এ চিঠি কিন্তু সে নালিশের জন্যে নয়। আজ আমার ছেলের জন্মতিথি, কোর্টের ফেরত একবার এসে তাকে আশীর্বাদ করে যাবেন। এই ভিক্ষা।
লাবণ্য পত্রের শেষে পুনশ্চ দিয়া জানাইয়াছে যে, রাত্রির খাওয়াটা আজ এইখানেই সমাধা করিতে হইবে। একটুখানি গান-বাজনার আয়ােজনও আছে।
চিঠি পড়িয়া বােধকরি সে ক্ষণকাল বিমনা হইয়া পড়িয়াছিল। হঠাৎ চোখ তুলিতেই দেখিতে পাইল, ঝি হাসি লুকাইতে মুখ নিচু করিল অর্থাৎ বাটীর দাসী চাকরের কাছেও এ যেন একটা তামাসার ব্যাপার হইয়া উঠিয়াছে। এক মুহুর্তে তাহার শিরার রক্ত আগুন হইয়া উঠিল ইহার কি সীমা নাই, যতই সহিতেছি ততই কি পীড়নের মাত্রা বাড়িয়া চলিয়াছে? জিজ্ঞাসা করিল, চিঠি কে এনেছে?
তাদের বাড়ির ঝি। হরিশ কহিল, তাকে বলে দাও আমি কোর্টের ফেরত যাবাে। এই বলিয়া সে বীরদর্পে।
মােটরে গিয়া উঠিল সে রাত্রে বাড়ি ফিরিতে হরিশের বস্তুতঃ অনেক রাত্রিই হইল। গাড়ি হইতে নামিতেই
দেখিল, তাহার উপরের শােবার ঘরের খােলা জানালায় দাঁড়াইয়া নির্মলা পাথরের মূর্তির মতাে স্তব্দ হইয়া আছে। ডাক্তারের দল অল্পক্ষণ হইল বিদায় লইয়াছে। পারিবারিক চিকিৎসক বৃদ্ধ জ্ঞানবাবু যাইবার সময় বলিয়া গেলেন, বােধহয় সমস্ত আফিংটাই বার করে ফেলা গেছে, বৌমার জীবনের আর কোনাে শঙ্কা নেই।
হরিশ একটুখানি ঘাড় নাড়িয়া কি ভাব যে প্রকাশ করিল, বৃদ্ধ তাহাতে মনােযােগ করিলেন না, কহিলেন, যা হবার হয়ে গেছে, এখন কাছে কাছে থেকে দিন দুই সাবধানে রাখলেই বিপদটা কেটে যাবে।
যে আজ্ঞে, বলিয়া হরিশ স্থির হইয়া বসিয়া পড়িল।সেদিন বার-লাইব্রেরী ঘরে আলােচনা অত্যন্ত তীক্ষ ও কঠোর হইয়া উঠিল। ভক্ত বীরেন কহিল, আমার গুরুদেব স্বামীজি বলেন, বীরেন, মানুষকে কখনাে বিশ্বাস করবে না।
সেদিন গোঁসাই বাবুর বিধবা পুত্রবধূর সম্বন্ধে যে স্ক্যান্ডালটা প্রকাশ হয়ে পড়েছিল তােমরা তা বিশ্বাস করলে না, বললে হরিশ এ কাজ করতেই পারে না। এখন দেখলে? গুরুদেবের কৃপায় আমি এমন অনেক জিনিস জানতে পারি তােমরা যা ড্রিম করাে না।
ব্রজেন্দ্র বলিল, উঃ হরিশটা কী স্কাউড্রেল! ও রকম সতী-সধ্বী স্ত্রী যার, কিন্তু মজা দেখেছ সংসারে? বদমাইশগুলাের ভাগ্যেই কেবল এ রকম স্ত্রী জোটে!
বৃদ্ধ তারিণী চাটুজ্জে হুঁকা লইয়া ঝিমাইতেছিলেন, কহিলেন, নিঃসন্দেহে আমার তাে মাথার চুল পেকে গেল কিন্তু ক্যারেক্টারে কেউ কখনাে একটা স্পট দিতে পারলে না। অথচ আমারই হল সাত সাতটা মেয়ে, বিয়ে দিতে দিতে দেউলে হয়ে গেলাম। যােগীনবাবু কহিলেন, আমাদের মেয়ে ইস্কুলের পরিদর্শক হিসেবে লাবণ্যপ্রভা মহিলাটি দেখছি একেবারে আদর্শ! গভর্নমেন্টের বােধকরি মুভ করা উচিত। ভক্ত বীরেন বলিলেন, অ্যাবসােলিউটলি নেসেসরি! সম্পূর্ণ একটা দিন পার হইল না, সতী-সাধ্বীর স্বামী হরিশের চরিত্র জানিতে শহরে কাহারও আর বাকি রহিল না। এবং সুহৃদ্বর্গের কৃপায় সকল কথাই তাহার কানে আসিয়া পৌঁছিল।
উমা আসিয়া চোখ মুছিয়া কহিল, দাদা, তুমি আবার বিয়ে করাে। হরিশ কহিল, পাগল! উমা কহিল, পাগল কেন? আমাদের দেশে তাে পুরুষদের বহুবিবাহ ছিল। হরিশ কহিল, তখন আমরা বর্বর ছিলাম।
উমা জিদ করিয়া বলিল, বর্বর কিসের? তােমার দুঃখ আর কেউ না জানে তাে আমি তাে জানি? সমস্ত জীবনটা কি এমনি ব্যর্থ হয়েই যাবে?
হরিশ বলিল, উপায় কি বােন? স্ত্রী ত্যাগ করে আবার বিয়ে করার ব্যবস্থা পুরুষের আছে জানি, কিন্তু মেয়েদের তাে নেই। তাের বৌদিরও যদি এ পথ খােলা থাকত তাের কথায় রাজী হতাম উমা। তুমি কি যে বল দাদা! এই বলিয়া উমা রাগ করিয়া চলিয়া গেল। হরিশ চুপ করিয়া। একাকী বসিয়া রহিল। তাহার উপায়হীন অন্ধকার চিত্ততল হইতে কেবল একটি কথাই
বারংবার উথিত হইতে লাগিল, পথ নাই! পথ নাই!
এই আনন্দহীন জীবনে দুঃখই ধ্রুব হইয়া রহিল।
তাহার বসিবার ঘরের মধ্যে তখন সন্ধ্যার ছায়া গাঢ়তর হইয়া আসিতেছিল, হঠাৎ তাহার কানে গেল পাশের বাড়ির দরজায় দাঁড়াইয়া বৈষ্ণব ভিখারীর দল কীর্তনের সুরে দূতীর বিলাপ গাহিতেছে। দূতী মথুরায় আসিয়া ব্রজনাথের হৃদয়হীন নিষ্ঠুরতার কাহিনী বিনাইয়া বিনাইয়া নালিশ করিতেছে।
সেকালে এ অভিযােগের কিরূপ উত্তর দূতীর মিলিয়াছিল হরিশ জানিত না, কিন্তু একালে সে ব্রজনাথের পক্ষে বিনা পয়সার উকিল দাঁড়াইয়া তর্কের উপর তর্ক জুড়িয়া মনে মনে বলিতে লাগিল, ওগাে দূতি, নারীর একনিষ্ঠ প্রেম খুব ভালাে জিনিস, সংসারে তার তুলনা নেই।
কিন্তু তুমি তাে সব কথা বুঝবে না বললেও না। কিন্তু আমি জানি ব্রজনাথ কিসের ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন এবং একশ বছরের মধ্যে আর ও-মুখাে হননি। কংশ টংশ সব মিছে কথা। আসল কথা। শ্রীরাধার ঐ একনিষ্ঠ প্রেম। একটু থামিয়া বলিতে লাগিল, তবু তাে তখনকার কালে ঢের সুবিধে ছিলমথুরায় লুকিয়ে থাকা চলতাে।
কিন্তু এ-কাল ঢের কঠিন! না আছে পালাবার জায়গা, না আছে মুখ দেখাবার স্থান। এখন ভুক্তভােগী ব্রজনাথ দয়া করে অধীনকে একটু শীঘ্র পায়ে স্থান দিলেই বাঁচি।