Emotional Love Story Bengali | অন্তরের প্রেমের গল্প

WhatsApp Channel Follow Now
Telegram Group Follow Now

Last updated on July 4th, 2023 at 12:50 am

Rate this post
আজকের love story bengali টির নাম – “মধুরেন” গল্পের প্রধান চরিত্রে নেপেন ও শৈল, বিষয় – ভালোবাসার বন্ধন, bangla love story এবং valobashar Golpo আর bangla premer golpo অথবা bangla jokes আরও পাওয়ার জন্য আমাদের ব্লগ টিকে সাবস্ক্রাইব করে আমাদের সাথে থাকুন, গল্পটি পড়িয়া যদি আপনার ভালো লাগিয়া থাকে তাহলে অবশ্যই কমেন্ট এবং শেয়ার করিতে ভুলিবেন না। 

love story bengali

Love Story in Bengali – বাংলা ভালোবাসার গল্প

আজকের গল্প – মধুরেন 


আজ ছুটি ছিল। তারিণী চাটুজ্যে সকালে চারটি মুড়ি আর এক কাপ চা খেয়ে বেরিয়েছিলেন। তাঁর বেরুনাে মানেই–কন্যা শৈলের জন্য পাত্র খুঁজতে বেরুনাে। তিনি আজ এই তিন বছর এইরূপ বেরুচ্ছেন। এক পা ধুলাে নিয়ে সন্ধ্যায় ফিরে, মাথায় হাত দিয়ে বাড়ির রােয়াকে তিনি বসে পড়েন। পত্নী নবদুর্গা তাড়াতাড়ি মাদুরখানা এনে পাশেই পেতে দেন, উঠে বসতে বলেন, গরমের দিন, পাখা নিয়ে বাতাস করতে বসেন। তারিণীবাবুর মুখে ম্লান হাসি না ফুটতেই দীর্ঘশ্বাসে তা মিলিয়ে যায়। বলেন, “আমাকে আর যত্ন করে বাঁচিয়ে রাখা কেন? 

শৈল আজ তিন বছর বাপের এই অবস্থা দেখে আসছে, আর ওই কথা শুনে আসছে। সে পনেরাে উত্তীর্ণ হল, এইবার ম্যাট্রিক দেবে। ওটা নাকি সর্বাগ্রে দরকার, তারিণীবাবু পাত্র খুঁজতে যেখানেই যান, প্রথমে শুনতে হয় ম্যাট্রিক পাস কি না! তিনি যেন কেরানিগিরির দরখাস্ত নিয়ে গিয়েছেন, তাই আধপেটা খেয়েও শৈলকে পড়াতে হচ্ছে। শৈল গরিব মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে, সংসারের সকল কাজেই মাকে সাহায্য করে। এখন সংসারের সকল চিন্তায় যােগ দেয়, সব বােঝে ও ভাবে। তারিণীবাবু রেলে চাকরি করেন, মাইনে পান পঁয়ত্রিশ টাকা। সন্ধ্যার পর মাড়ােয়ারিদের গদিতে গিয়ে ইংরাজি চিঠিপত্র টেলিগ্রাম লিখে দেন, তাঁদের মাল খালাসও করে দেন। তাতেও কিছু পান। 




কাকারিয়া বিশিষ্ট ধনী, গরিব ব্রাম্মনকে ভালােবাসেন, দয়া করে কাজকর্ম দেন, এই পাঁচ রকমে তার সংসার চলে। একদিন সকালে কাকারিয়ার মােটর তারিণীবাবুর ভাড়াটে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। বেরিয়ে এসে শেঠ কাকারিয়াকে সপরিবারে নামতে দেখে তিনি বিচলিত হয়ে পড়েন। কাকারিয়া সহাস্যে বলেন, বাড়িতে একটি বিবাহােৎসব আছে, আমার স্ত্রী-কন্যা তােমাদের নিমন্ত্রণ করতে এসেছেন, তারা বাড়ির মধ্যে যাবেন। শুনে তারিণীবাবুর কথা জোগালাে না। ইতিমধ্যে দাসীর হাতে একখানি পরাতে মিষ্টান্নাদি, পশ্চাতে স্ত্রী-কন্যা, বাড়ির ভিতর গিয়ে উপস্থিত। দুঃখের সংসারে তারিণী চাটুজ্যের এত বড়াে বিপদ কোনাে দিন ঘটেনি। 

একতলা, আড়াইখানি স্যাতসেঁতে কুঠরি, তার তদুপযুক্ত আসবাব, ময়লা ছেড়া লেপ-কাঁথা, মাটির হাঁড়ি কলসি সরা। সেদিন তৃণাদপি সুনীচেন’ একবার তাঁর মনেও পড়েনি, পড়লেও বােধ হয় শান্তি দিত না। তিনি ন যযৌ অবস্থায় কাকারিয়ার মােটরের পাশে দাঁড়িয়ে দু-একটি বিনয়-বচন ভিন্ন কথাই কইতে পারেননি, তাকে নামতেও বলতে পারেননি কোথায় বসাবেন ? প্রৌঢ় কাকারিয়া তার অবস্থাটা বুঝে অন্য কথা পাড়েন। বললেন, ‘তারিণীবাবু, যে কাজ আমি জানি না, বুঝি না, এমন একটা কাজে হাত দিয়ে ফেলেছি। অনেক টাকার কাজ, তাতে ফ্যাসাদও বহুৎ। তােমার সাহায্যে আমার দরকার, অনেক লেখাপড়া করতে হবে। বিলেত থেকে মালপত্র মেশিনারি এসে পড়েছে, খালাস করতে হবে। এখন ভগবতী মাই যা করেন। তারিণীবাবু কথা কইবার অবলম্বন পেয়ে জিজ্ঞাসা করেন, কী কাজ শেঠজী?” কাকারািয় হাসতে হাসতে বলেন, “বাইসকোপ, তসবির-ঘর। 

তসবির বনবে তারিণীবাবুকে আর কথা কইতে হয়নি ; কাকারিয়ার স্ত্রী-কন্যা তার বাসা থেকে এসে মােটরে ওঠেন। ‘আচ্ছা, কথা পরে হবে।’ বলে শেঠজীর মােটর বেরিয়ে যায়। তারিণীবাবুর যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল, তিনি সহজ নিশ্বাস ফেলে বাঁচেন। কাকারিয়ার কথাগুলি তার কানে গেলেও প্রাণে পৌঁছয়নি। বড়ােলােকের সদ্ব্যবহারও গরিবদের উপভােগ্য হয় না, স্বাচ্ছন্দ্য দেয় না। নবদুর্গা ডাকায় তার চমক ভাঙে।‘এ সব আবার কী? আমাকে খবরটা দিতে হয়! আমি এই হেঁড়া কাপড় পরে শাক-সড়সড়ি চড়িয়েছি, মেয়েটা ওই কাপড়ে ডালের খুদ বাটছিল, তাড়াতাড়ি তােমাকে দু’খানা বড়া ভেজে ভাত দেব বলে, এমন সময় ছি-ছি’, শৈল বললে, “তাতে কি হয়েছে মা? যে যা, তার তাই থাকাই তাে ভালাে।




আমি সাটিনের শাড়ি পরে বাটনা বাটলে কেমন দেখাত? ওঁদের আসায় আর অন্যায়টা কি হয়েছে মা? বড়লােক যদি আদর করে আসেন, সেটা কত মিষ্টি। নবদুর্গা বলেন, আমি কি ওঁদের দুষছি? হঠাৎ কিনা, তাই আতান্তরে পড়তে হয়। এই দেখ না, কত রকমের মেঠাই, আবার পাঁচ টাকা নগদ দিয়ে গেছেন। আমাদের তাে-‘ শৈল বলে, ‘তুমি বুঝি তাই ভাবছ মা? ওঁরা বড়ােলােক, ওঁদের মতাে কাজ ওঁরা না করলে সমাজ নিন্দে আছে। আমরা গেলেই ওঁরা খুশি হবেন।

তুমি আজ একবার যেও বাবা।” শুনে তারিণীবাবুর মনটা শান্ত হয়। তাকে ভাত বেড়ে দিয়ে নবদুর্গা বলেন, তােমার মেয়ে তাঁদের সঙ্গে এমন কথা কইলে গাে যেন কত কালের চেনা! তাদের মুখেও শৈলর কথাবার্তার, রূপের সুখ্যাতি ধরে না। “আর রূপের সুখ্যাতি। তাতে টাকার কামড় তাে কমে না!”-বলে উদাসভাবে একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে তারিণীবাবু উঠে অফিসে চলে যান। স্ত্রী-কন্যাও যথাসময়ে কাকারিয়া ভবনে নিমন্ত্রণ রক্ষা করে আসেন। শেঠ-কন্যা রুক্মিণীবাই শৈলর প্রতি বিশেষ আকৃষ্ট হয়ে তার সঙ্গে সখী-সম্পর্ক পাতায়। উল্লিখিত ঘটনার পর তারিণী চাটুজ্যে এই প্রথম পাত্র-খোঁজা ‘টুর’ থেকে হতাশ শ্রান্ত অবস্থায় ফিরে নবদুর্গাকে ব্যস্ত হয়ে বাতাস করতে দেখে, দীর্ঘনিশ্বাসের সঙ্গে ম্লান হাসি মিশিয়ে যখন বলেন, আমাকে আর যত্ন করে বাঁচিয়ে রাখা কেন? শৈল তা শুনেছিল। 

আরও পড়ুনঃ গল্পঃ সতী 


কষ্টের এরূপ মর্মন্তুদ অনেক কথা অনেকবার সে শুনেছে এবং নিভৃতে নীরবে অসহায়ের মতাে কেঁদেছে। এখন সে কেবল কষ্টই পায় না, তার আত্মাভিমান বিদ্রোহ করে ওঠে, সে দারুণ লজ্জা ও অপমান বােধও করে। আজ আর সে থাকতে পারলে না, বাপকে সবিনয়ে জানিয়ে দিলে, ‘তুমি আমার জন্য পাত্র খুঁজতে আর যেয়াে না বাবা। এ-সব পাঁচ বছর আগে সম্ভব ছিল, তখন আমার জ্ঞান হয়নি। এখন কিন্তু তােমার অপমান, আর তার সঙ্গে নিজেরও আমাকে অত্যন্ত লাগছে। প্রত্যেকবারই শুনছি ও বুঝছি কোনাে ভদ্রলােকই তাে নগদ দু-হাজার টাকার কমে ছেলে ছাড়বেন না। 





ছেলেও নিজের সম্মান সেই টাকার ওজনে যখন সপ্রতিভাবেই মেপে রেখেছেন, তখন সে বৃথা চেষ্টা আর কেন বাবা? দু-আড়াই হাজার টাকা কোথা থেকে আসবে? ভদ্রলােকে কি চুরি-ডাকাতি করবে? যাঁরা চান, তাদের ক-জন তা বার করতে পারেন? তিন বছরে কাকাবাবুদের পাওনা পঁচাত্তর টাকা দিতে পারা গেল না। দেখে দাদা লেখাপড়া ছেড়ে দিলে। কাকারিয়া বাবুরা ভালােবাসেন, যাই আসি, কিন্তু মুখ তুলে রুক্মিণীর সঙ্গেও কথা কইতে পারি না। ভগবানের মনে যা আছে তাই হবে। তুমি আর ভেবাে না, পাত্র খুঁজতেও আর যাওয়া হবে না বাবা। এবার গেলে কিন্তু তারিণীবাবু অবাক হয়ে শৈলর কথাগুলি শুনছিলেন। শৈল বরাবরই শান্ত ও অল্পভাষী। আজ তার কথার মধ্যে এমন একটা সত্য ও দৃঢ় সুর ছিল, যা তাকে বিচলিত করে দিলে। তার মুখ থেকে সরব চিন্তার মতাে বেরিয়ে গেল, ‘সমাজ যে রয়েছে, সে কি বলবে? শৈল তেমনই ধীর ভাবেই বললে, ‘সমাজের যদি “বলা” ছাড়া আর কোনাে কাজ থাকে, তবে সে সমাজের জন্য মিছে ভেবাে না। ওই সমাজই অন্য পক্ষের সমাজ হয় কি? নির্জীব কেন, সেখানে তার বলার কিছু নেই কি? যাক, সমাজ বলুক না বলুক, আমি কিন্তু বাবা, তােমাকে আজ বলছি, এইবার তুমি আমার জন্য পাত্র খুঁজতে গেলে, তার পর আর যাতে না যেতে হয় তা আমায় করতেই হবে। এ কষ্ট, এ অপমান তােমাকে আর সইতে দেব না।’ নবদুর্গার হাতের পাখা থেমে গিয়েছিল। শৈল রান্নাঘরে চলে গেল। তারিণীবাবু স্তব্ধ উদাস দৃষ্টিতে মুঢ়ের মতাে বসে রইলেন। ক্ষণপরেই সহসা বলে উঠলেন, ‘হ্যা, ঠিক, আর যাব না রে শৈল। যা করবার ভগবান করবেন। ঠিক বলেছিস। বেচু, নেপেন আর তারিণীবাবুর ছেলে বিজয়, তিন বেকার বন্ধু। কলেজ ছেড়ে কলকাতায় চাকরির চেষ্টায় ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত, হতাশ। তিনজনেই সমদুঃখী, দুঃখের সমবায়ই তাদের দুঃখের সান্ত্বনা দাঁড়িয়েছিল। বেচুর বিদকুটে চেহারাই শেষে তার কাজে লাগল কোয়ালিফিকেশনে দাঁড়াল। নাক নাই বললেই হয়, সে চেপটে মুখের অনেকখানি দখল করেছে। ব্যাক-ব্রাশ করা লম্বা চুল। তাতে কান দুটো খােলা ফটকে দুটি পাল্লার মতােই দেখাত। নাকের নিচে সযত্নে দু-বার কামানাে গোঁফের মধ্যমাংশটুকু যেন প্রাণরক্ষার্থে নাকের উঁটি কামড়ে রয়েছে। বেচু জন্তুজানােয়ারের স্বর হুবহু নকল করতে পারে এবং করেও। কেরানি হওয়া সম্বন্ধে হতাশ হলেও সে বলত, ‘জগতে আমারও দরকার আছে রে, ভগবান মিছিমিছি কিছু করেন না। ভগবানকে ওই সার্টিফিকেট দিয়েই হােক বা যে কারণেই হােক, কথাটা তার ফলে গেল। অস্ট্রেলিয়ার এক সার্কাস-পার্টি কলকাতায় খেলা দেখাচ্ছিল, বেচু তাদের নজরে পড়ে গেল। তাদের সঙ্গে সাংঘাই যাবার সময়ে বললে, আইএসসি পড়ে কটা বছর কী নষ্টই করেছি। বিজয়ের কাছে সংবাদটা পেয়ে শৈল মৃদুহাস্যে বললে, এইবার তার বাপও দু-হাজার হাঁকবে। নেপেনদা বি-এ না পড়ে যদি। ওদের বড়াে কষ্ট। বাপ বিয়ের যুগ্যি এক মেয়ে ছাড়া আর কিছুই রেখে যেতে পারেননি। নেপেনের চেহারা ভালাে, সুগঠিত পৌনে ছ-ফিট দেহ, সুপুরুষ যুবা, সচ্চরিত্র। বাপ তাকে গ্র্যাজুয়েট বানাতে গােয়ালের গােরু পর্যন্ত বিক্রি করে গিয়েছেন। বি-এ পাস করার পর খিদিরপুর স্কুলে বছর দেড়েক একজনের বদলি মাস্টারি করেছিল। অধুনা বেকার। ওয়াটগঞ্জ থিয়েটারে হিরাে-রােজগার জিরাে। প্রাইভেট টিউশনি করে টাকা পনেরাে পায়। কাকারিয়ার নব-প্রতিষ্ঠিত ফিল-হাউ-মরীচিকা মঞ্চে’ ঢােকবার উমেদারি করেছে। শৈল যখন থার্ড ক্লাসে পড়ে, তখন নেপেনদার বাড়িতে পড়া বলে নিতে যেত তাই তাদের অবস্থা জানে। নেপেনের ভগ্নী মনােলােভা তার সমবয়সী, আলাপী, অনেকদিন দেখা-সাক্ষাৎ নেই বয়স উভয়েকেই বেরুতে বাধা দেয়। মন ছুটোছুটি করে। নেপেন বিবাহ করবে না দুঃখের উপর যে কষ্ট বাড়াতে চায় না। কন্যাপক্ষেরা এলে তার মাও বি-এ পাশ ছেলের যে নজরানা আশা করে আছেন, তা শুনে মধ্যবিত্তদের চিত্ত চমকে যায়। তিন মাস ধরে কাকারিয়ার ‘মরীচিকা-মঞ্চে একখানি সামাজিক নাটকের মহলা চলছে। কাকারিয়ার অর্থের অভাব নেই, নামী অভিনেত্রীদের-যারা নৃত্য, গীত ও অভিনয়ে সুপরিচিতা স্বদেশী তারকা, তাদের মােটা টাকার সংগ্রহ করা হয়েছে। কাকারিয়ার ধারণা, সেরা সেরা সুন্দরীরাই ফিল্মের প্রধান আকর্ষণ। পুরুষের পার্টে লােকাভাব নেই পঁচিশ থেকে পঞ্চাশ দিলেই হিরাে মেলে। সুতরাং সুন্দরী সংগ্রহের ব্যয়টা এইতে পুষিয়ে যাবে। শেঠের অদৃষ্ট বাধা-বিঘ্ন কেটে চলে। প্রথম প্রচেষ্টার মুখেই ঘটেও গেল তাই। নানা সদুদ্দেশ্যে সভ্যজগৎ আজকাল ভারতের আচার-ব্যবহার প্রথা-পদ্ধতি জানবার জন্য উৎসুক, উদগ্রীব। কাকারিয়ার ভাগ্য ইওরােপের এক ফিলম্ কোম্পানির মালিক ভারত-ভ্রমণে এসে ভদ্র হিন্দুদের বিবাহ-পদ্ধতিটার নিখুঁত ছবি বিশেষ মূল্যে সংগ্রহ করতে চান এবং কাকারিয়ার সঙ্গে কন্ট্রাক্ট করেন। 


আরও পড়ুনঃ Bengali Funny Jokes


সুযােগ বুঝে কাকারিয়া অভাবপীড়িত নেপেনকে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে ও ভবিষ্যতের বড় আশা দিয়ে, চট করে একখানি নাটিকা লিখিয়ে নেন। তারই জোর রিহার্সাল চলছে। ক্রেতা বসে আছেন কন্ট্রাক্ট-মতাে দিনে তার পাওয়া চাই, নচেৎ তিনি নেবেন না। জাহাজের টিকিট কিনে প্রত্যাবর্তনের জন্য তিনি প্রস্তুত হয়ে রয়েছেন। কাল ফিলম্ তােলা হবে। নাটিকাখানির বিষয়বস্তু দুই জমিদারের বহু দিনের পােষা, বিরােধ ও শত্রুত একজনের ছেলে ও একজনের মেয়ের অভাবনীয় প্রণয়-আকর্ষণে, শেষে তাদের বিবাহের মধ্য দিয়ে শুভমিলনে মিটে গেল। দুই জমিদারের প্রত্যেকেই অপরের প্রতিযােগীভাবে ঐশ্বর্যবিকাশের আয়ােজনে মুক্তহস্তশিল্পে, সৌন্দর্যে ও আড়ম্বরে। বিবাহসভায় নৃত্যগীতাদির জন্য বােম্বাই, মহীশুর মণিপুর, কাশ্মীর হতে নর্তকীরা এসেছে। বাংলার প্রসিদ্ধরাও আছেন প্রধানত তারাই বাসরের আনন্দ-বর্ধন করবেন। ফল কথা, কাকারিয়া তাদের সৌন্দর্যের সাহায্যে তার ‘মরীচিকা-মঞ’কে সাফল্যমণ্ডিত করে নাম কিনতে ও আমদানির পথ করে নিতে চান। স্টুডিওতে ফিল্ম তােলবার ব্যবস্থা হয়েছে প্রথম শ্রেণীর। সেজন্য বিশেষ বিশেষ বিশেষজ্ঞদের নিযুক্ত করাও হয়েছে। দেশের খ্যাতনামা বিশিষ্ট পদস্থদের দর্শকরূপে নিমন্ত্রণ করাও হয়েছে। তারা সজীব অভিনয়টা দেখবেন এবং তাদের অভিমত-মতাে কাটছাঁট পরিবর্তনও চলবে। কারণ ক্রেতার সন্দেহ ভঞ্জনার্থ কন্ট্রাক্টের মধ্যে এ-সব শর্তও আছে। শৈলর সঙ্গে কাকারিয়া-কন্যা রুক্মিণীর সাক্ষাতের পর থেকে তাদের সখীত্ব এখন ঘনিষ্ঠ, দেখাশােনা প্রায়ই হয়। স্টুডিওতে অভিনয়াদি থাকলে শৈলকে আনিয়ে উভয়ে গােপনে দেখে। মধুরেণ’ নাটকখানির খাতা তাকে দিয়ে লুকিয়ে পড়িয়ে শােনে। আজও তাকে আনিয়েছে। শৈলরও অভিনয়াদি দেখবার শখ স্বাভাবিক। বিশেষ, লেখাপড়া-জানা মেয়ে, নিজেও ভালাে-মন্দ বুঝতে আরম্ভ করেছে। কি হলে বা কি করলে স্বাভাবিক ও ঠিক হয়, সে সম্বন্ধেও আলােচনা করে। কুমকুম নাম্নী যে সুন্দরী তরুণীটি পাত্রী’র মহলা দিতে আসে, তার দোষগুণ সমালােচনা করে। বলে, ‘ও ভাবে দাঁড়ানােটা ভুল, ও কথাটি ও সুরে বলাটা মানায় না ইত্যাদি। শুনে রুক্মিনী হাসতে হাসতে বলে, ‘একদিন তুমিই করে আমাকে দেখাও না ভাই। আমি কসম খেয়ে বলতে পারি, কুমকুমের চেয়ে তােমাকে ঢের বেশি মানাবে, ভালাে দেখাবে। ওরা কেবল সেলাবতে থাকে, ঘষে-মেজে চটক রাখে। সত্যি বলতে, না আছে। সৌষ্ঠব, না সাইজ। শরম রাখে না বলেই পুরুষদের অত ভালাে লাগে। রুক্মিণীর কথা শৈল উপভােগ করে, হাসে। বলে, ‘ওইটাই ঠিক বলেছ, আমাদের শরমে বাধে, আড়ষ্ট হয়ে পড়বার ভয় থাকে। নইলে শক্তটা আর কি, অনায়াসেই পারা যায়। ইত্যাদি শুনলে মনে হয়, ভদ্রঘরের লেখাপড়া-জানা মেয়েদের অভিনয়ের সাধ যে হয় না, এমন কথা বলা যায় না। আজ সারাদিন কাকারিয়ার স্টুডিও-কম্পাউন্ডে উৎসবের সাড়া পড়ে গিয়েছে। গেট, মঞ্চ, উদ্যান, লতামণ্ডপ সবই জীবনে যৌবনে যেন স্পন্দিত হচ্ছে, অপূর্ব শ্রী ধারণ করেছে। বিচিত্রবর্ণের আধার বিদ্যুতালােক-দীপ্তি বিচ্ছুরিত করবার অপেক্ষা করছে। কর্মীরা উত্তেজনা-চঞ্চল। আজ ‘মরীচিকা-মঞ্চের উদ্বোধন বললে হয়। আজকের সাফল্যের উপর কাকারিয়ার এই ব্যয়বহুল প্রচেষ্টার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। উৎসাহ-উত্তেজনার অন্ত নেই। এইরূপ আসন্ন সময়ে শেঠজীকে না দেখতে পেয়ে কর্মচারীরা চল ও চিন্তিত হয়ে এদিক ওদিক চাইছিলেন। কাকাবাবু হঠাৎ নিজের কোয়ার্টার থেকে বিশৃঙ্খল এলােমেলাে বেশে, অবিন্যস্ত কেশে, চিন্তামাখা মুখে তারিণীবাবুর সঙ্গে বেরিয়ে এলেন।–“চলাে, একবার বম্বে থিয়েটারের মালিকের কাছে যেতে হবে, তাদের ‘ফিমেল-ড্রেসার’ আছে। এই বলতে বলতে তারিণীবাবুকে মােটরে তুলে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। তার চাঞ্চল্য দেখে সকলে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলে। এ আবার কেন? ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তারা ফিমেল-ড্রেসার রেশমিবাঈকে নিয়ে স্বচ্ছন্দভাবে ফিরলেন ও তাকে নিয়ে বাড়ি ঢুকলেন। এদিকে সময়ের কিছু পূর্বেই বিশিষ্ট দর্শকেরা আসতে আরম্ভ করেছিলেন। কাকাবাবু সহাস্য উৎফুল্ল মুখে স্বয়ং উপস্থিত হয়ে সকলকে অভ্যর্থনা ও আদর-আপ্যায়নে পরিতুষ্ট করতে লাগলেন। রৌপ্যধারে আতর, গােলাপ, পান, জর্দা, এলাচ, ফুলের মালা, ফুলের তােড়া ঘুরতে লাগল। মঞ্চ পুষ্পলতার পারিপাট্যে মালঞ্চে পরিণত ও আলােকোজ্জ্বল। 
বরাসনে বর ও সভাশােভনবেশে বরযাত্রীরা উপবিষ্ট, কন্যাযাত্রীরাও উপস্থিত। উভয়পক্ষের গুণী গায়কদের সঙ্গীতালাপাদি ও নর্তকীদের নৃত্য, পর্যায়ক্রমে শ্রোতা ও দর্শকদের নয়ন-মন-রঞ্জনে সচেষ্ট। দেব-দর্শন বরের মুখশ্রী, দেহসৌষ্ঠব ও সজ্জা, সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ ও মহিলাদের চিত্ত হরণ করছে। লগ্ন উপস্থিত। বিবাহকার্য একে একে যথারীতি পর্যায়ক্রমে চলল, উৎসর্গ, স্ত্রী-আচার, কন্যা-সম্প্ৰদানাদি। তন্মধ্যে স্ত্রী-আচার দৃশ্য বিশেষ উপভােগ্য ও উল্লেখযােগ্য। বিজলী-জ্যোতি-সমুজ্জ্বল প্রাঙ্গণে নানা বর্ণের বিদ্যুতের মতাে সুবেশা, পুলক-চলা তরুণী ও যুবতীরা কলহাস্যে রহস্যমুখরা ও সুযােগমতাে বরের কর্ণমর্দন-তৎপরা। নিরীহ বর আজমৃদুহাস্যে সবই সইছেন। অলংকার ও বেনারসির বিজ্ঞাপনের মতাে প্রৌঢ়া সুন্দরীর সুকোমল হস্তের বরণ-বৈচিত্র ও বরকে চিরতরে ইঙ্গিতানুগামী পােষা পশুটি বানিয়ে রাখবার প্রক্রিয়া ও প্রবচন, সকলের পরিজ্ঞাত হলেও বেশ উপভােগ্য হল। কনেকে সাতপাক ঘােরাবার পর শুভদৃষ্টি। বর ও কন্যা উভয়ে উভয়ের সুপরিচিত, রিহার্সেল-ক্ষেত্রে নিত্য দেখা, সুতরাং পরস্পরের মেক-আপ চাতুর্য দেখার ঔৎসুক্য ছাড়া, শুভদৃষ্টির আগ্রহ বড়াে ছিল না। উভয়েই ভাবলে, বাঃ, কী সুন্দর দেখাচ্ছে! কনের ঘােমটা খুলে দেওয়ায়, দেখে মেয়ে পুরুষ সবাই রূপমুগ্ধ হলেন। কেউ কেউ ভাবলেন, বাংলা দেশ সজ্জা-শিল্পে কী অভাবনীয় উন্নতিই করেছে, কুমকুমকে তাে পূর্বেও দেখেছি, আজ যেন নতুন দেখছি। এইবার হাফ-টাইমের অবকাশে, বরযাত্রী ও কন্যাত্রীদের রাজসূয়ের ব্যবস্থা-মতাে ভূরিভােজন আরম্ভ ও সমাপ্ত হল। পরে কয়েকটি ছােটখাট আচার উপভােগ্যভাবে শেষ হলে বরবধূর ‘উজ্জ্বলিত নাট্যশালাসম’ বাসরঘরে প্রবেশ। রমণীকণ্ঠের সুমধুর রহস্যালাপ, নৃত্যগীত। বরকে মধুর পীড়ন ও যুগলকে মধুর নির্যাতন চলল। এই একটিমাত্র ক্ষেত্রে রমণীরা বাধাহীন, স্বাধীন বা উচ্ছল—যা ইচ্ছে বলতে পারেন। বরের অঙ্কে বধুকে তারা বসাবেনই, বধু কিন্তু নারাজ, লজ্জানত। বধুকে বর চুপি চুপি বললেন, “ও কি করছ রিহার্সেল-মতাে হচ্ছে না যে, এসাে। বলে হাত ধরে টানতেই একেবারে গায়ে গায়ে! অবগুণ্ঠিতা বধূ ধীর কাতর অথচ বিরক্তিব্যঞ্জক কণ্ঠে বললেন, ‘পায়ে পড়ি ছাড়ুন, বড় মাথা ঘুরছে। বর চমকে গেল, ‘এ কার কণ্ঠস্বর!’ পরে রমণীদের প্রতি একটু বাতাস করুন, শুতে দিন শরীর ভালাে নয়- শুনে কেউ হাসলেন, কেউ অবাক হয়ে বললেন, এর মধ্যে এত! খুব মায়ার শরীর যে। কেউ বললেন, এরপর আর সাধাসাধি করতে হবে না, মাথাও ঘুরবে না। মাথা ঘােরাবার জন্যে নিজেই ঘুরঘুর করে ঘুরবেন। পরক্ষণেই সুন্দরীদের নৃত্যগীতে বাসর জমে উঠল। ও-সব ক্ষণিকের বিঘ্ন ফিল্মের কোনাে অনিষ্টই করলে না, বাসরের স্বাভাবিক অঙ্গ বলেই লােকে বুঝলে। সুন্দরী নির্বাচন ও অর্থব্যয় সার্থক ভেবে শেঠ কাকারিয়া উৎফুল্ল। বরের মন কিন্তু নৃত্যগীতাদিতে ছিল না। তিনি ভাবছিলেন, এ তাে কুমকুম নয়, কুমকুম নির্দিষ্ট অভিনয়ে এত আপত্তি করবে কেন? একটু আপত্তির ভাব থাকবে বটে, তারপর তাে-। তবে এ সুন্দরী কে? পদস্থ অভিজ্ঞ দর্শকেরা কাকারিয়ার পিঠ চাপড়ে প্রশংসাবাদ শােনাতে শােনাতে রাত তিনটের পর সব ফিরলেন।
ফিল্ম-ক্রেতা নিজে উপস্থিত থেকে সবই দেখলেন শুনলেন। কুশণ্ডিকা বা বাসী-বিয়ে শেষ করলে, বিষয়টি সম্পূর্ণ হবে। সকালে আবার কাজ চলল। বর্তমানে রুচি-বিরুদ্ধ হলেও তার আনুষঙ্গিক সব খুঁটিনাটিই তােলা হল। নচেৎ কন্ট্রাক্ট খারিজ হয়ে যাবে। ক্রেতা উচ্চ বর্ণের হিন্দু বিবাহের নিখুঁত চিত্র চায়। কিন্তু দু-একটি স্থলে অসহায়া বধূ দর্শকদের লক্ষ্য বাঁচিয়ে চাপা গলায়, বরকে সংযত হতে বলতে বাধ্য হন। স্বর শুনে বিস্মিত বর বধূর দিকে চমকে চাইলেন। দিনের আলােয় চিনতে আর বাধল না। অশ্রুসিক্ত পল্লবে বধুকে কী সুন্দরই দেখাচ্ছে! বর মুগ্ধবৎ বলে ফেললেন, ‘তুমি! অশু কেন? দুঃখের কারণ কি? কেন? অভিনয় সার্থক হয়েছে শৈল, তাই তাে বলি, এত রূপ আর কার ? ছবি তােলা সুচারুভাবে শেষ হয়ে গেল। শেঠজীর আনন্দের সীমা নেই। শৈলকে খুঁজতে লাগলেন। দেখলেন মঞ্চের বাইরে গাঁটছড়া বাঁধা অবস্থায় বরবধূ কথাবার্তায় মগ্ন। তিনি কন্যা রুক্মিণীকে দেখাবার জন্য ডাকতে গেলেন। রুক্মিনী প্রচ্ছন্ন থেকে শুনলে : শৈল বরকে বলছে, এখন আমায় এই বেশেই আপনাদের বাড়ি নিয়ে চলুন, নেপেনবাবু। আমি আর এখন বাপের বাড়ি যেতে পারি না, যাব না। সে যেমন নিয়ম আছে, সেই মতাে হবে।’ নেপেন ঠাট্টা ভেবে কথা কইতে গেল। শৈল তাকে দৃঢ়ভাবেই বুঝিয়ে দিলে, ‘ঠাট্টা নয়। আপনি জানেন, বাবা সরল সাধাসিধে লােক, গরিব। কুমকুমের হঠাৎ কলিক চাগায়, কাকাবাবু বিপন্নভাবে বাবাকে বিপদ জানিয়ে তাকে সাহায্য করতে অনুরােধ করেন। কন্ট্রাক্ট’ যায়, মান-সম্রম যায়, ভবিষ্যৎ যায়, মুখ রক্ষা করুন। শৈলকে মাত্র সেজে দাঁড়াতে দিন, মেয়ে-ড্রেসার সাজিয়ে দেবে, কেউ চিনতে পারবে না। ‘বিপদের সময় ব্যাপারটার গুরুত্ব কেউ ভাববার অবকাশ পাননি। বড়ােলােকের অনুরোধ গরিবদের এড়ানাে যে কত কঠিন তা আপনি জানেন, বাবাকেও জানেন তিনি অতশত ভাবেননি। অভিনয় হলেও সর্বসমক্ষে বিধিব্যবস্থা-মতাে মন্ত্রপুতবিবাহ আমাদের যখন হয়ে গিয়েছে, আর ছবিও তার সাক্ষী হয়ে রইল, তখন আমায় আর বিবাহ করবে কে? ওঁরা কেউ তলিয়ে ভাবেননি পতিতা নিয়ে তাে এ কাজ করা হয়নি! একে আমার বাবা গরিব, অর্থাভাবে আমার বিবাহ দিতে পারছিলেন না। এখন দশগুণ দিলেও কেউ আমাকে বিবাহ করবে কি? আপনি জ্ঞানবান গ্র্যাজুয়েট হয়ে আমার দশা কি করলেন? ‘আমি কিছু জানতাম না’ এই সাফায়ে নিজেকে বাঁচার পথ পেতেও পারেন ; কিন্তু আমাকে এভাবে ডুবিয়ে আত্মপ্রসাদ পাবেন কি? শুনে নেপেনের জিভ শুকিয়ে গেল। শৈলর কথা তাে একটুও মিথ্যে নয়! সে চিন্তিতভাবে বিমর্ষ মুখে বললে, আমরা নিজেরাই খেতে পাই না, নচেৎ এখানে বিশ-পঁচিশ টাকার লােভে, সেজে অভিনয় করতে আসব কেন? তােমাকে সুখী করা দূরে থাক, খেতে-পরতে দেওয়াও যে আমার অবস্থায় অসম্ভব। ‘শৈল বললে, “দুঃখের সংসারে আমি আজ তিন-চার বছর অনেক দুঃখ-কষ্টের কথাই শুনে আসছি, আর তা বুঝতেও হয়েছে। তার মধ্যে একটা কথা, সংসারে সকলেই নিজের নিজের ভাগ্য নিয়ে আসে। আমি কি কোনাে ভাগ্যই নিয়ে আসিনি? নেপেন নীরব। শৈল শেষে বললে, ‘অভিনয়ের মধ্যে অনুচিত ও অভব্য ব্যাপারও বাদ যায়নি, যা অসারণ অভিনেত্রীদের সঙ্গই সাজে। এর পরেও কি আপনি গরিব হিন্দুর মেয়েকে ঘরে না নিয়ে, মরণের পথে ঠেলে দিতে চান? তা ভিন্ন এখন আর আমার কোন পথ রইল? একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে শৈল নীরব হল। দৃঢ় স্বরে, ‘চলাে, বাড়ি চলো শৈল’, বলে নেপেন তার হাত ধরলে। রুক্মিণী গােপনে থেকে শঙ্খধ্বনি করলে।
       
                             (সমাপ্ত)

Leave a Comment

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now