কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা ২০২৩ পদ্ধতি, মন্ত্র, ফর্দ, উপকরণ ও নিয়ম: মা লক্ষ্মী হলেন সৌভাগ্য এবং শান্তির প্রতীক। দুর্গোৎসবের পর আশ্বিন মাসের শেষ পূর্ণিমা তিথিতে কোজাগরী লক্ষ্মী মায়ের আরাধনা করা হয়। বাঙালির প্রতিটি ঘরে এই দিন কোজাগরী লক্ষ্মী পুজো করা হয়।
বেশিরভাগ বাঙালির ঘরে বছর ভর প্রতি বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীর পুজো করে থাকেন। এছাড়াও লক্ষ্মী শস্য সম্পদের দেবী বলে ভাদ্র সংক্রান্তি, পৌষ সংক্রান্তি ও চৈত্র সংক্রান্তিতে এবং আশ্বিন পূর্ণিমা ও দীপাবলীতে লক্ষ্মীর পুজো করা হয়।
কিন্তু আশ্বিন মাসের শেষ পূর্ণিমা তিথিতে যে কোজাগরী লক্ষ্মীর পুজো করা হয় তাতে কী কী মন্ত্র, ফর্দ, উপকরণ, পদ্ধতি ও নিয়ম প্রয়োজন এবং কীভাবে এই পুজো করবেন জানেন? এই নিবন্ধে আপনার সঙ্গে লক্ষ্মী পূজা কি ভাবে করবেন এবং মা লক্ষ্মী কে কি ভাবে সন্তুষ্ট করবেন তার সমস্ত বিষয় তুলে ধরা হলো।
কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা পদ্ধতি
প্রথমে মাথায় একটু গঙ্গাজল নিয়ে নারায়ণকে স্মরণ করে নিন। পূজার আগে মাথায় জল নিয়ে দেহ ও নারায়ণকে স্মরণ করে মন শুদ্ধ করে নেবেন। তারপর সূর্যের উদ্দেশ্যে একটু জল দিন। যে কোনো পূজার আগে আমাদের প্রাণশক্তির উৎস সূর্যকে জল দেওয়ার নিয়ম; কেন না, তিনিই সকল প্রাণশক্তির উৎস। এমনকী, সূর্যালোক ছাড়া শস্যও উৎপন্ন হবে না ! তাই জল দেওয়ার জন্য ঠাকুরের সিংহাসনে একটি ছোটো তামার পাত্র সর্বদা রাখবেন। সূর্যের নাম করে সেই কুশীতে জল নিয়ে সেই তামার পাত্রে দেবেন। তারপর সংসারের সকলের মঙ্গলকামনা করবেন।
এরপর একটু গঙ্গাজল আপনার পূজার আসন, পূজার ফুল- নৈবেদ্য ইত্যাদি উপকরণের উপর ছিটিয়ে দেবেন। এইভাবে পূজাদ্রব্যগুলিকে শুদ্ধ করে নিতে হয়। এরপর লক্ষ্মীর সামনে সামান্য ধান ও এক চিমটি মাটি ছড়িয়ে দিয়ে তার উপর জলভরা ঘট স্থাপন করবেন। ঘটের গায়ে সিঁদুর দিয়ে মঙ্গলচিহ্ন বা স্বস্তিকাচিহ্ন এঁকে নিতে ভুলবেন না। ঘটে একটি আমপল্লব (যাতে বিজোড় সংখ্যায় আমপল্লব থাকে) ও তার উপর একটি কলা বা হরীতকী দিয়ে উপরে একটি ফুল দেবেন। ইচ্ছা করলে ঘটে ও লক্ষ্মীকে একটি করে মালাও পরাতে পারেন।
- আরও পড়ুন:
- 👉 কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার পাঁচালী ও ব্রতকথা
- 👉 শুভ কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা শুভেচ্ছা বার্তা, কবিতা ও ছবি
কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার মন্ত্র
শ্রী শ্রী লক্ষীদেবীর আহ্বান
এস মা লক্ষ্মী, কমল বরণী, কমলালতিকা দেবী কমলিনী-
কমল আসনে, বিরাজ কমলা, কমলময়ী ফসলবাসিনী।।
কমল বসন, কমল ভূষণ, কমনীয় কান্তি অতি বিমোহন।
কোমল করে, শোভিছে কমল, ধাল সিঁদুরে শোভে দেখি শিরে।
কোমল কন্ঠে কমল হারে, কোমল বদন দেখি যে সুন্দরে।।
কমল চরণে কমল নূপুর, কমল অলক্ত মরি কি সুন্দর।
দীন মধুসূদনের সন্তাপ হর তুমি নারায়ণী শান্তিপ্রদায়িনী।।
শ্রী শ্রী লক্ষীদেবীর বরণ
তুমি মাগো লক্ষ্মীদেবী কমল বরণী।
কমললতিকা কৃপা কর নারায়ণী।।
সাজায়ে রেখেছি মাগো ধান্য-গুয়া-পান।
আসিয়া মাগো কর ঘটেতে অধিষ্ঠান।।
ঘরেতে ধূপ ধূনা আর ঘৃতবাতি।
হৃদয় কমলে ওমা করহ বসতি।।
পদ্মাসনে পদ্মদল রাখি থরে থরে।
শঙ্খ বাদ্যে বরণ করি তোমা ছরে।।
সবে করি লক্ষ্মীপূজা অতি সযতনে।
আশিস করহ মাতঃ আমা সব জনে।।
শ্রী শ্রী মা লক্ষ্মীর স্তোত্র
লক্ষ্মীস্তং সর্বদেবানাং যথাসম্ভব নিত্যশঃ।
স্থিরাভাব তথা দেবী মম জন্মনি জন্মনি।।
বন্দে বিষ্ণু প্রিয়াং দেবী দারিদ্র্য দুঃখনাশিনী।
ক্ষীরোদ সম্ভবাং দেবীং বিষ্ণুবক্ষ বিলাসিনীঃ।।
শ্রী শ্রী লক্ষ্মীর ধ্যান মন্ত্র
ওঁ পাশাক্ষমালিকাম্ভোজ সৃণিভির্যাম্য সৌম্যয়োঃ।
পদ্মাসনাস্থাং ধায়েচ্চ শ্রীয়ং ত্রৈলোক্য মাতরং।।
গৌরবর্ণাং স্বরূপাঞ্চ সর্বালঙ্কারভূষি তাম্।
রৌক্নোপদ্মব্যগ্রকরাং বরদাং দক্ষিণেন তু।।
শ্রী শ্রী লক্ষ্মীর পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্র
নমস্তে সর্বদেবানাং বরদাসি হরিপ্রিয়ে।
যা গতিস্তং প্রপন্নানাং সা মে ভূয়াত্বদর্চবাৎ।।
শ্রী শ্রী লক্ষ্মীর প্রণাম মন্ত্র
ওঁ বিশ্বরূপস্য ভার্যাসি পদ্মে পদ্মালয়ে শুভে।
সর্বতঃ পাহি মাং দেবী মহালক্ষ্মী..
শ্রী শ্রী লক্ষ্মীর স্তোত্রম্
ত্রৈলোক্য পূজিতে দেবী কমলে বিষ্ণুবল্লভে।
যথাস্তং সুস্থিরা কৃষ্ণে তথা ভবময়ি স্থিরা।।
ঈশ্বরী কমলা লক্ষ্মীশ্চলা ভূতি হরিপ্রিয়া।
পদ্মা পদ্মালয়া সম্পদ সৃষ্টি শ্রীপদ্মধারিণী।।
দ্বাদশৈতানি নামানি লক্ষ্মীং সম্পূজ্য যঃ পঠেত।
স্থিরা লক্ষ্মীর্ভবেৎ তস্য পুত্রদারারদিভিংসহ।।
বিশেষ দ্রষ্টব্য:- অবশ্যই তিন বার পাঠ করতে হবে।
কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার ফর্দ
সিঁদুর, অধিবাস ডালা, তিল, হরিতকী, ঘট, একসরা, আতপ চাল, ঘটাচ্ছাদন গামছা ১টি, কুণ্ডহাঁড়ি ১টি, তেকাঠা ১টি, দর্পণ ১টি, পঞ্চগুঁড়ি, পঞ্চগব্য, পঞ্চরত্ন, সশীষ ডাব ১টি, তীর ৪টি, পুষ্প, দূর্ব্বা।
এছাড়া লাগে, আসনাঙ্গুরীয়ক ৩টি, মধুপর্কের বাটী ৩টি, দই, মধু, গব্যঘৃত, চিনি, নৈবেদ্য ৩টি, কুচা নৈবেদ্য ১টি, লক্ষ্মীর শাটী ১টি, নারায়ণের ধূতি ১টি, পেচক পূজার ধূতি ১টি, লোহা, শঙ্খ, সিঁদুরচুবড়ি, বালি, কাষ্ঠ, খোড়কে, ঘৃত এক পোয়া, হোমের বিল্বপত্র ২৮টি, ভোগের দ্রব্যাদি, কর্পূর, চিপিটক (চিঁড়া), নারকোল, পান, চানের মশলা, থালা ১টি, ঘটি ২টি, রচনা, ফুলমালা ১টি, চন্দ্রমালা ১টি, পূর্ণপাত্র ১টি এবং অবশ্যই দক্ষিণা।
কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোয় যা কিছু করা নিষিদ্ধ
লক্ষ্মীপূজায় ঘণ্টা বাঁজাতে নেই। লক্ষ্মীকে তুলসীপাতা দিতে নেই। কিন্তু লক্ষ্মীপূজার পর একটি ফুল ও দুটি তুলসীপাতা দিয়ে নারায়ণকে পূজা করতে হয়। লক্ষ্মীপূজা সাধারণত সন্ধ্যাবেলা করে, তবে অনেকে সকালেও করে থাকেন। সকালে করলে সকাল ন-টার মধ্যে করে নেওয়াই ভাল। পূজার পর ব্রতকথা পাঠ করতে হয়। লক্ষ্মীপূজায় লোহা বা স্টিলের বাসন-কোসন ব্যবহার করবে না। লোহা দিয়ে অলক্ষ্মী পূজা হয়।
তাই লোহা দেখলে লক্ষ্মী সে গৃহ ত্যাগ করে চলে যান। যার যে প্রতিমায় পূজা করার নিয়ম সে সেই নিয়মেই পূজা করবে। পূজার পূর্বে পূজাস্থান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে ধূপ দীপ জ্বালিয়ে দেবে। পূজাস্থানে লক্ষ্মীর পা-সহ আলপনা আঁকবে। ঘটের পাশে একটি লক্ষ্মীর পা অবশ্যই আঁকবে। পূজার সময় অন্য মনস্ক হবে না। মনকে লক্ষ্মীতে স্থির রাখবে।
কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার উপকরণ
কোজাগরী লক্ষী পুজোয় এই উপকরণগুলি লাগে: সিঁদুর, হরিতকী, ঘট, সরা, আতপ চাল, ঘট আচ্ছাদনের গামছা ১, হাঁড়ি ১, দর্পণ, পঞ্চগব্য, পঞ্চরত্ন, সশীষ ডাব ১, পুষ্প, দূর্ব্বো, মধুপর্কের বাটি, দধি, মধু , ফুলমালা ১ , চন্দ্রমালা ১ , গব্য ঘৃত, নারকেল, পান, চিনি, কর্পূর চিঁড়ে, শাড়ি; মূর্তিতে পুজো করলে এ সবের সঙ্গে নারায়ণের ধুতি ১, বালি, কাঠ, ঘৃত, হোমের বেলপাতা ২৮ ইত্যাদি।
কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার নিয়ম
সাধারণত কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে সারা রাত জেগে থাকার বিধি আছে। এই পূজার সঙ্গে কৃষকদের একটা বড় সম্পর্ক রয়েছে। তাই শোনা যায় সারারাত জেগে তারা ওইদিন শস্য পাহারা দেয়। সঙ্গে মার কাছে আশীর্বাদ চেয়ে নেওয়া হয়। আবার অনেকে মনে করেন, লক্ষ্মী দেবী চঞ্চলা তাই সারারাত জেগে তাকে পাহারা দেওয়া হয়, যাতে তিনি পালিয়ে না যান। এই কথা মা ঠাকুমাদের মুখে প্রায়ই শোনা যায়। লক্ষ্মীদেবী ধনসম্পদ তাকেই দেন, যে তার পুরো মর্যাদা দেয়। যে সেই ধনসম্পদ সমাজের কল্যাণে কাজে লাগায়।
তাই লক্ষ্মীদেবীর আরাধনা অত্যন্ত শুদ্ধ মনে করতে হয়। মা লক্ষ্মী অল্পেই খুশী হন। তাই এই পূজায় খুব একটা বাহুল্য নেই। যে যার সাধ্যমতো পূজা করে। তবে পূজার আগে পূজার স্থান একদম পরিষ্কার করে নিতে হবে। তারপর সুন্দর করে আলপনা দিতে হবে। প্রতি ঘরের দরজায়, পূজার স্থানে লক্ষ্মীর পা অবশ্যই আঁকবে। সেইদিন আলপনা মুছবে না। তারপর পূজার জায়গা সুন্দর করে ফুল দিয়ে সাজিয়ে, ধূপ, ধুনো, প্রদীপ জ্বালিয়ে দিতে হয়।
FAQs
কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোয় যা কিছু করা নিষিদ্ধ?
লক্ষ্মীপূজায় ঘণ্টা বাঁজাতে নেই। লক্ষ্মীকে তুলসীপাতা দিতে নেই। লক্ষ্মীপূজায় লোহা বা স্টিলের বাসন-কোসন ব্যবহার করবে না। লোহা দিয়ে অলক্ষ্মী পূজা হয়। তাই লোহা দেখলে লক্ষ্মী সে গৃহ ত্যাগ করে চলে যান। যার যে প্রতিমায় পূজা করার নিয়ম সে সেই নিয়মেই পূজা করবে।
কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার ফর্দে কি কি থাকে?
সিঁদুর, অধিবাস ডালা, তিল, হরিতকী, ঘট, একসরা, আতপ চাল, ঘটাচ্ছাদন গামছা ১টি, কুণ্ডহাঁড়ি ১টি, তেকাঠা ১টি, দর্পণ ১টি, পঞ্চগুঁড়ি, পঞ্চগব্য, পঞ্চরত্ন, সশীষ ডাব ১টি, তীর ৪টি, পুষ্প, দূর্ব্বা।
কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা পদ্ধতি কি?
প্রথমে মাথায় একটু গঙ্গাজল নিয়ে নারায়ণকে স্মরণ করে নিন। পূজার আগে মাথায় জল নিয়ে দেহ ও নারায়ণকে স্মরণ করে মন শুদ্ধ করে নেবেন। তারপর সূর্যের উদ্দেশ্যে একটু জল দিন। যে কোনো পূজার আগে আমাদের প্রাণশক্তির উৎস সূর্যকে জল দেওয়ার নিয়ম; কেন না, তিনিই সকল প্রাণশক্তির উৎস।