ছোটদের কবিতা অর্থাৎ শিশুসাহিত্য বাংলা ভাষায় শুরু হয় ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুকুমার রায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য এবং আরও বিখ্যাত কবিদের রচনার মাধ্যমে।
ছোটদের কবিতা অথবা ছড়া সাধারণত অল্প বয়সী শিশুদের মনস্তত্ত্ব বিবেচনায় রেখে রচনা করা হয়। ছোট ছেলমেয়েদের শিক্ষামূলক অথচ মনোরঞ্জক গল্প, ছড়া, কবিতা, উপন্যাস ইত্যাদিকেই সাধারণভাবে শিশুসাহিত্য বলে। যারা শিশুসাহিত্য রচনা করেন তাদের শিশুসাহিত্যিক বলা হয়।
ছোটদের কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য এর বিশেষ বক্তব্য, ভাষাগত সারল্য, চিত্র ও বর্ণের সমাবেশ, হরফের হেরফের প্রভৃতি কলাকৌশলগত আঙ্গিক। শিশুসাহিত্যের বিষয়বৈচিত্র্য অফুরন্ত। এতে থাকে কল্পনা , জ্ঞান-বুদ্ধির উপস্থাপনা।
বিদ্যাসাগরের ছোটদের কবিতা
কবিতা – অদ্ভুত আতিথেয়তা
একদা আরব জাতির সহিত মুরদিগের সংগ্রাম হইয়াছিল। আরবসেনা বহুদূর পর্যন্ত এক মুরসেনাপতির অনুসরণ করে। তিনি অশ্বারােহণে ছিলেন, প্রাণভয়ে দ্রুতবেগে পলায়ন করিতে লাগিলেন। আরবেরা তাহার অনুসরণে বিরত হইলে, তিনি স্বপক্ষীয় শিবিরের উদ্দেশে গমন করিতে লাগিলেন। কিন্তু তাঁহার দিকভ্রম জন্মিয়াছিল, এজন্য, দিকনির্ণয় করিতে না পারিয়া, তিনি বিপক্ষের শিবিরসন্নিবেশস্থানে উপস্থিত হইলেন। সে সময়ে তিনি এরূপ ক্লান্ত হইয়াছিলেন যে, আর কোনাে ক্রমেই অশ্বপৃষ্ঠে গমন করিতে পারেন না।
কিয়ৎক্ষণ পরে, তিনি, এক আরবসেনাপতির পটমণ্ডপদ্বারে উপস্থিত হইয়া, আশ্রয়-প্রার্থনা করিলেন। আতিথেয়তা বিষয়ে পৃথিবীতে কোনাে জাতিই আরবদিগের তুল্য নহে। কেহ অতিথিভাবে আরবদিগের আলয়ে উপস্থিত হইলে, তাঁহারা সাধ্যানুসারে তাহার পরিচর্যা করেন; সে ব্যক্তি শত্রু হইলেও, অণুমাত্র অনাদর, বিদ্বেষপ্রদর্শন বা বিপক্ষতাচরণ করেন না।
আরবসেনাপতি তৎক্ষণাৎ প্রার্থিত আশ্রয় প্রদান করিলেন এবং তাহাকে নিতান্ত ক্লান্ত ও ক্ষুৎপিপাসায় একান্ত অভিভূত দেখিয়া, আহারাদির উদ্যোগ করিয়া দিলেন।
মুরসেনাপতি ক্ষুন্নিবৃত্তি পিপাসাশান্তি ও ক্লান্তি পরিহার করিয়া উপবিষ্ট হইলে, বন্ধুভাবে উভয় সেনাপতির কথােপকথন হইতে লাগিল। তাহারা, পরস্পর স্বীয় ও স্বীয় পূর্বপুরুষদিগের সাহস, পরাক্রম, সংগ্রামকৌশল প্রভৃতির পরিচয় প্রদান করিতে লাগিলেন। এই সময়ে, সহসা আরবসেনাপতির মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল।
তিনি তৎক্ষণাৎ গাত্রোত্থান ও তথা হইতে প্রস্থান করিলেন, এবং কিঞ্চিৎ পরেই মুরসেনাপতিকে বলিয়া পাঠাইলেন আমার অতিশয় অসুখবােধ হইয়াছে, এজন্য আমি উপস্থিত থাকিয়া, আপনকার পরিচর্যা করিতে পারিলাম না; আহারসামগ্রী ও শয্যা প্রস্তুত হইয়াছে।
আপনি আহার করিয়া শয়ন করুন। আর, আমি দেখিলাম, আপনকার অশ্ব যেরূপ ক্লান্ত ও হতবীর্য হইয়াছে, তাহাতে আপনি কোনােক্রমেই নিবৃদবেগে ও নিরুপদ্রবে স্বীয় শিবিরে পঁহুছিতে পারিবেন না। অতি প্রত্যুষে, এক দ্রুতগামী তেজস্বী অশ্ব, সজ্জিত হইয়া, পটমণ্ডপের দ্বারদেশে দণ্ডায়মান থাকিবেক; আমিও সেই সময়ে আপনকার সহিত সাক্ষাৎ করিব এবং যাহাতে আপনি সত্বর প্রস্থান করিতে পারেন, তদবিষয়ে যথােপযুক্ত আনুকুল্য করিব।
কী কারণে আরবসেনাপতি এরূপ বলিয়া পাঠাইলেন, তাহার মর্মগ্ৰহ করিতে না পারিয়া, মুরসেনাপতি, আহার করিয়া, সন্দিহানচিত্তে শয়ন করিলেন। রজনীশেষে, আরব সেনাপতির লােক তাঁহার নিদ্রাভঙ্গ করাইল, এবং কহিল, আপনার প্রস্থানের সময় উপস্থিত, গাত্রোত্থান ও মুখপ্রক্ষালনাদি করুন, আহার প্রস্তুত।
সেনাপতি শয্যা পরিত্যাগ পূর্বক, মুখপ্রক্ষালনাদি সমাপন করিয়া, আহারস্থানে উপস্থিত হইলেন, কিন্তু সেখানে আরবসেনাপতিকে দেখিতে পাইলেন না; পরে, দ্বারদেশে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, তিনি সজ্জিত অশ্বের মুখরশ্মি ধারণ করিয়া দণ্ডায়মান আছেন।
আরবসেনাপতি দর্শনমাত্র, সাদর সম্ভাষণ করিয়া, মুরসেনাপতিকে অশ্বপৃষ্ঠে আরােহণ করাইলেন, এবং কহিলেন, আপনি সত্বর প্রস্থান করুন; এই বিপক্ষশিবির-মধ্যে, আমা অপেক্ষা আপনকার ঘােরতর বিপক্ষ আর নাই। গত রজনীতে, যৎকালে, আমরা উভয়ে, একাসনে আসীন হইয়া, অশেষবিধ কথােপকথন করিতেছিলাম, আপনি, স্বীয় ও স্বীয় পূর্বপুরুষদিগের বৃত্তান্তবর্ণন করিতে করিতে, আমার পিতার প্রাণহত্যার নির্দেশ করিয়াছিলেন।
আমি শ্রবণমাত্র, বৈরসাধন বাসনার বশবর্তী হইয়া, বারংবার এই শপথ ও প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, সূর্যোদয় হইলেই প্রাণপণে পিতৃহন্তার প্রাণবধসাধনে প্রবৃত্ত হইব। এখন পর্যন্ত সূর্যের উদয় হয় নাই, কিন্তু উদয়েরও অধিক বিলম্ব নাই; আপনি সত্বর প্রস্থান করুন।
আমাদের জাতীয় ধর্ম এই, প্রাণান্ত ও সর্বস্বান্ত হইলেও, অতিথির অনিষ্টচিন্তা করি না। কিন্তু আমার পটমণ্ডপ হইতে বহির্গত হইলেই, আপনকার অতিথিভাব অপগত হইবে এবং সেই মুহূর্ত অবধি, আপনি স্থির জানিবেন, আমি আপনকার প্রাণসংহারের নিমিত্ত প্রাণপণে যত্ন ও অশেষ প্রকারে চেষ্টা পাইব।
এই যে অপর অশ্ব সজ্জিত হইয়া দণ্ডায়মান আছে দেখিতেছেন, সূর্যোদয় হইবামাত্র, আমি উহাতে আরােহণ করিয়া, বিপক্ষভাবে আপনকার অনুসরণে প্রবৃত্ত হইব। কিন্তু আমি আপনাকে যে অশ্ব দিয়াছি, উহা আমার অশ্ব অপেক্ষা কোনাে অংশেই হীন নহে; যদি উহা দ্রুতবেগে গমন করিতে পারে, তাহা হইলে আমাদের উভয়ের প্রাণরক্ষার সম্ভাবনা।
এই বলিয়া, আরবসেনাপতি, সাদর সম্ভাষণ ও করমর্দন পূর্বক, তাহাকে বিদায় দিলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ প্রস্থান করিলেন। আরবসেনাপতিও, সূর্যোদয়দর্শনমাত্র, অশ্বে আরােহণ করিয়া, তদীয় অনুসরণে প্রবৃত্ত হইলেন। মুরসেনাপতি কতিপয় মুহূর্ত পূর্বে প্রস্থান করিয়াছিলেন, এবং তদীয় অশ্বও বিলক্ষণ সবল ও দ্রুতগামী। এজন্য, তিনি নির্বিঘ্নে স্বপক্ষীয় শিবিরসন্নিবেশস্থানে উপস্থিত হইলেন।
আরবসেনাপতি, সবিশেষ যত্ন ও নিরতিশয় আগ্রহ সহকারে, তাহার অনুসরণ করিতেছিলেন; কিন্তু তাহাকে স্বপক্ষশিবিরে প্রবিষ্ট হইতে দেখিয়া, এবং অতঃপর আর বৈরসাধন সংকল্প সফল হইবার সম্ভাবনা নাই বুঝিতে পারিয়া, স্বীয় শিবিরে প্রতিগমন করিলেন।
- আরও পড়ুন:
- 👉 ১০টি সেরা শিশু সাহিত্য
- 👉 সত্যজিৎ রায়ের ভূতের গল্প
- 👉 ঝিঙে ফুল বাংলা কবিতা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটদের কবিতা
কবিতা – আমাদের ছোট নদী
আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।
পার হয়ে যায় গোরু, পার হয় গাড়ি,
দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি।
চিক্ চিক্ করে বালি, কোথা নাই কাদা,
একধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা।
কিচিমিচি করে সেথা শালিকের ঝাঁক,
রাতে ওঠে থেকে থেকে শেয়ালের হাঁক।
আর-পারে আমবন তালবন চলে,
গাঁয়ের বামুন পাড়া তারি ছায়াতলে।
তীরে তীরে ছেলে মেয়ে নাইবার কালে
গামছায় জল ভরি গায়ে তারা ঢালে।
সকালে বিকালে কভু নাওয়া হলে পরে
আঁচল ছাঁকিয়া তারা ছোটো মাছ ধরে।
বালি দিয়ে মাজে থালা, ঘটিগুলি মাজে,
বধূরা কাপড় কেচে যায় গৃহকাজে।
আষাঢ়ে বাদল নামে, নদী ভর ভর
মাতিয়া ছুটিয়া চলে ধারা খরতর।
মহাবেগে কলকল কোলাহল ওঠে,
ঘোলা জলে পাকগুলি ঘুরে ঘুরে ছোটে।
দুই কূলে বনে বনে পড়ে যায় সাড়া,
বরষার উৎসবে জেগে ওঠে পাড়া।।
সুকান্ত ভট্টাচার্যের ছোটদের কবিতা
কবিতা – ছাড়পত্র
যে শিশু ভূমিষ্ঠ হল আজ রাত্রে
তার মুখে খবর পেলুম:
সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক,
নতুন বিশ্বের দ্বারে তাই ব্যক্ত করে অধিকার
জন্মমাত্র সুতীব্র চিৎকারে।
খর্বদেহ নিঃসহায়, তবু তার মুষ্ঠিবদ্ধ হাত
উত্তোলিত, উদ্ভাসিত
কী এক দুর্বোধ্য প্রতিজ্ঞায়।
সে ভাষা বোঝে না কেউ,
কেউ হাসে, কেউ করে মৃদু তিরস্কার।
আমি কিন্তু মনে মনে বুঝেছি সে ভাষা
পেয়েছি নতুন চিঠি আসন্ন যুগের—
পরিচয়-পত্র পড়ি ভূমিষ্ঠ শিশুর
অস্পষ্ট কুয়াশাভরা চোখে।
এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তুপ-পিঠে
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাব— তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি—
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গিকার।
অবশেষে সব কাজ সেরে
আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে
করে যাব আশীর্বাদ,
তারপর হব ইতিহাস।
সুকুমার রায়ের ছোটদের কবিতা
কবিতা – আবোল তাবোল
আয়রে ভোলা খেয়াল খোলা
স্বপনদোলা নাচিয়ে আয়,
আয়রে পাগল আবোল তাবোল
মত্ত মাদল বাজিয়ে আয় ৷
আয় যেখানে ক্ষ্যাপার গানে
নাইকো মানে নাইকো সুর,
আয়রে যেথায় উধাও হাওয়ায়
মন ভেসে যায় কোন্ সুদূর ৷
আয় ক্ষ্যাপা–মন ঘুচিয়ে বাঁধন
জাগিয়ে নাচন তাধিন্ ধিন্,
আয় বেয়াড়া সৃষ্টিছাড়া
নিয়মহারা হিসাব–হীন ৷
আজগুবি চাল বেঠিক বেতাল
মাতবি মাতাল রঙ্গেতে,
আয়রে তবে ভুলের ভবে
অসম্ভবের ছন্দেতে ৷৷
শঙ্খ ঘোষের ছোটদের কবিতা
কবিতা – আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি
আমাদের দেন পাশে ধ্বস
আমাদের বাঁয়ে গিরিখাদ
আমাদের মাথায় বোমারু
পায়ে পায়ে হিমানীর বাঁধ
আমাদের পথ নেই কোনো
আমাদের ঘর গেছে উড়ে
আমাদের শিশুদের শব
ছড়ানো রয়েছে কাছে দূরে !
আমরাও তবে এইভাবে
এ-মুহূর্তে মরে যাব না কি ?
আমাদের পথ নেই আর
আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি।
আমাদের ইতিহাস নেই
অথবা এমনিই ইতিহাস
আমাদের চোখমুখ ঢাকা
আমাদের ভিখারি বারোমাস
পৃথিবী হয়তো বেঁচে আছে
পৃথিবী হয়তো গেছে মরে
আমাদের কথা কে-বা জানে
আমরা ফিরেছি দোরে দোরে।
কিছুই কোথাও যদি নেই
তবু তো কজন আছি বাকি
আয় আরো হাতে হাত রেখে
আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি।
বিখ্যাত কবিদের লেখা ছোটদের কবিতা সমগ্র : গুলি আপনাদের কেমন লাগলো মন্তব্য করে জানাবেন যদি পোষ্টটি ভালো লেগে থাকে তাহলে বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করতে ভুলবেন না আরও নতুন নতুন পোস্ট পেতে পাশে দেওয়া 🔔 ঘণ্টা চিন্হ টি টিপে আমাদের ওয়েবসাইট টি সাবস্ক্রাইব করতে পারেন।