Bengali Love Story in Bengali Font | পত্নীহারা একটি প্রেমের গল্প

WhatsApp Channel Follow Now
Telegram Group Follow Now

Last updated on August 18th, 2023 at 03:59 pm

Rate this post
আজকের bengali love story টির নাম – “পত্নীহারা” গল্পের প্রধান চরিত্রে সুবোধ ও সুনীতি, বিষয় – রোমান্টিক প্রেম, love story in bangla এবং bangla love stories অথবা bangla jokes আরও পাওয়ার জন্য আমাদের ব্লগ টিকে সাবস্ক্রাইব করে আমাদের সাথে থাকুন, গল্পটি পড়িয়া যদি আপনার ভালো লাগিয়া থাকে তাহলে অবশ্যই কমেন্ট করিয়া জানাইতে ভুলিবেন না।
Bangla love story - love story in bengali - valobashar golpo

 

Herat Touching Bengali love story – হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া একটি প্রেমের গল্প!

আজকের গল্প – পত্নীহারা

 
চুঁচুড়া গঙ্গাতীরে একটি সুন্দর ত্রিতল অট্টালিকা। তাহার একটি সুসজ্জিত কক্ষে সেই গৃহের অধিষ্ঠাত্রী দেবী সপ্তদর্শবর্ষীয়া যুবতী। শ্রীমতি সুনীতিবালা বসিয়া কবিতা পাঠ করিতেছেন। তাঁহার মুখখানি অতি সুন্দর। চোখে এখনাে বালিকাসুলভ চপলতা পূর্ণ মাত্রায় বিরাজ করিতেছে। স্নান সমাপ্ত হইয়াছে, চুল এখনাে ভাল শুকায় নাই, তাই সেগুলি খােলা অবস্থায় পিঠের কাপড়ের উপর পড়িয়া আছে। 
 
জানালা দিয়া গঙ্গার বায়ু আসিয়া সেগুলি শুকাইয়া দিবার চেষ্টা করিতেছে। বেলা ক্রমে বাড়িয়া উঠিল, নয়টা বাজিয়া গেল। কাব্য আর সেই সুন্দরী পাঠিকার মন তেমন বাঁধিয়া রাখিতে পারিল না। বাহির হইতে পদশব্দের আভাষমাত্র কানে আসিলেই তিনি চমকিত হইয়া উঠিতে লাগিলেন। গঙ্গার ঘাটে বিস্তর স্নানার্থীর সমাগম হইয়াছে, সুনীতি মাঝে মাঝে গবাক্ষপথে তাহাদের প্রতিও দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলেন। 


তাহার এই মানসিক চঞ্চলতা শীঘ্রই বিদূরিত হইল। একখানি দৈনিক সংবাদপত্র হাতে করিয়া সহাস্যমুখে সুনীতির স্বামী প্রবেশ করিলেন। সুনীতির স্বামী সম্পূর্ণভাবে সুনীতির উপযুক্ত। বিধাতা যােগ্যকে যােগ্যের সহিতই যােজনা করিয়াছেন ; ইহার অপেক্ষা সুবােধচন্দ্র’র আর বেশী বর্ণনা নিষ্প্রয়ােজন। কবিতা পুস্তকখানি পার্শ্বস্থ টেবিলের উপর ফেলিয়া সুনীতি জিজ্ঞাসা করিলেন অত। হাসি কেন?

সুবােধ হাসিয়া বলিলেন সহ্য হয় না নাকি?
না।
কেন?


তুমি বাইরে থেকে হাসতে হাসতে এসেছ। তা ত হবে না আমার কাছে এসে আমাকে দেখে তবে তুমি হাসবে।
তুমি কি শুধু ঘরে আছ। তুমি কি বাইরে নেই?
সুনীতি হাসিয়া বলিলেন আচ্ছা, পরাজয় স্বীকার করলাম। রাজন। তােমারি আমি অন্তরে বাহিরে। এখন ব্যাপারখানা কি, বল দেখি শুনি।
দেখবে আবার শুনবে?
চালাকি রাখ। কাগজে তােমার বৌয়ের সুখ্যাতি বেরিয়েছে নাকি?
আমার বউয়ের।
কি জ্বালা! তােমার কেতাবের গাে মশাই কেতাবের। তােমার ফুলহারের সুখ্যাতি করে কাগজে কেউ সমালােচনা করেছে বুঝি?
যদি বলি তাই!
তবে আমি রাগ করব।
অপরাধ ?

তােমার বউ যখন তােমার বরের সুখ্যাতি করছে, তখন আর কারুর প্রশংসা তােমাকে স্পর্শ করবে কেন?
সুবােধ হাসিয়া বলিল তবে না হয়।
তবে কি?
আন্দাজ কর।
সুনীতি তাহার সেই হাসিমাখা চক্ষু দুটি উল্টাইয়া উল্টাইয়া তিনবার ঢােক গিলিয়া শেষকালে বলিল বুঝেছি।
কি বল দেখি? 
দুষ্টুমির হাসি হাসিয়া সুনীতি বলিল বলব কেন ?
সুবােধ বলিল না তােমায় বলতেই হবে।
সুনীতি চক্ষু ঘুরাইয়া বলিল ই হুকুম নাকি ?
নয়ত কি?
বটে! জান না, আমি রাণী, তুমি মাের প্রজা।’
তবে তােমার সখীদের ডাক। আমায় ফুলপাশে বেঁধে ফেলুক। দুটো গান শুনে নিই বলিয়া সুবােধ সুর করিয়া আরম্ভ করিল-“যদি আসে তবে কেন যে-এ-তে চায়।

সুনীতি রাগ করিয়া বলিল রঙ্গ রাখ। কি হয়েছে বল।
তুমি কি আন্দাজ করেছ সেইটে আগে বল।
সে আমি বলব না। তুমি বল চাই নাই বল।
সুবােধ বলছিলেন না সে আমি শুনব না। তােমায় বলতেই হবে। সুনীতি মুখখানি গম্ভীর করিয়া বলিল নাঃ যদি না মেলে তবে তুমি ভারি হাসবে।
হাসলামই বা?
আমি যে ভারি অপ্রতিভ হয়ে যাব।
হলেই বা?
আমার চক্ষু যে ছল ছল করবে।
তােমার চোখে একটি ওষুধ দিয়ে ছলছল ভাব ভাল করে দেব।
এই বলিয়া সুবােধ স্নেহভরে প্রিয়তমার চক্ষু দুটিতে দুটি চুম্বন মুধিত করিল।
সুনীতি বলিল একি, রােগ না হতেই ওষুধ!


সুবােধ হাসিয়া উত্তর করিল–Prevention is better than cure-সুনীতি অল্প ইংরাজি জানিত।
সুনীতি বলিল-ধন্যবাদ, ডাক্তার মশাই।
শুধু ধন্যবাদে ডাক্তার সন্তুষ্ট হয় না, ভিজিট চাই বলিয়া ডাক্তার মহাশয় রােগিণীর ওষ্ঠাধর হইতে ভিজিট আদায় করিয়া লইলেন। তখন সুবােধ সুনীতির স্কন্ধে, হস্তযুগল অৰ্পণ করিয়া বলিল আন্দাজটা তুমি কি করেছ, বল সত্যি। আমার ভারী কৌতূহল হচ্ছে। সুনীতি বলিল বিলক্ষণ, নিজের কথা যা বলবার আছে তা বলবেন না, আমায় খালি খালি জেরা করবেন। ভারী মজার লােক ত! তুমি বল আর না বল, আমি সে কথা বলছিনে। সুবােধের কৌতূহল উত্তরােত্তর বৃদ্ধি করিতে সুনীতি সম্পূর্ণ কৃতকার্য হইল। শেষে সুবােধ বলিল আচ্ছা, আমিই আগে বলি, কিন্তু তুমি বলবে বল?
বলব।

আমার শুনে শুনে যদি বল যে আমিও তাই মনে করেছিলাম।
আচ্ছা, আমি কাগজে লিখে রাখি। বলা হলে তুমি খুলে দেখাে।
সুনীতি হাসিতে হাসিতে একখানি কাগজে কয়েকটি কথা লিখিল। লিখিয়া বলিল বল এইবার।
সুবােধ বলিল আজ সন্ধ্যেবেলা বহুকাল পরে আবার স্টারে চন্দ্রশেখর। অনেকদিন থেকে তােমার চন্দ্রশেখর অভিনয় দেখবার সাধ, আজ দুজনে যাই চল।
সুনীতি ভারি খুশি। লিখিত কাগজখানি হাতে লইয়া মাথা ঘুরাইয়া বলিল আচ্ছা, এতে কি লিখেছি এবার তুমি আন্দাজ কর।
বাঃ সে কথা ত ছিল না।
নাই বা ছিল, তবু বল না।
আমি যদি আন্দাজ করি, তবে কি আন্দাজ করলাম সেটা ফের তােমায় আন্দাজ করে বলতে হবে কিন্তু।

আরও পড়ুনঃ গল্পঃ সতী 

বেশ, আমিও তােমায় আবার সেটা আন্দাজ করাব।

তা হলে আন্দাজ করতে করতে চিরটা জীবন কেটে যাক আর কি!–আচ্ছা, তুমি আমায় যে রকম খুশী করেছ, তােমাকে আর কষ্ট দেওয়া উচিত নয়। 
এই দেখ সুবােধ কাগজ খুলিল। তাহাতে লিখা আছে হিজি বিজি কি লিখি ছাই আমি ত কছুই আন্দাজ করিতে পারিতেছি না। তােমার মনে কৌতূহল সার করিবার চেষ্টা করিতেছি মাত্র।
পড়িয়া সুবােধ হাসিয়া উঠিল। বলিল তুমি ভারি দুষ্টু। 
কি সাজা দেবে?
সাজা দেব? সাজা দিয়েছি! আসল কথা এখনও বলিনি। তােমাকে মেম সাজাব।
সে আবার কি কথা!
সুবােধ বলিল-না, সত্যি। অনেক দিন থেকে আমার সাধ, মেমের পােশাকে। তােমাকে কেমন দেখায় দেখব। তােমার জন্যে একটি পােষাক আনিয়ে রেখেছি থিয়েটারে যাব, দুজনে আলাদা বসে দেখলে কি সুখ হয়? বক্স রিজার্ভ করে দুজনে একত্ৰ বসতে হবে। পােড়া বাঙালীর পরিচ্ছেদে ত সে হবার যাে নেই দুজনে সাহেব মেম সেজে যাই চল।
সুনীতি বলিল আ সর্বনাশ! সে আমি পারব না। হাজার লােকের সম্মুখে কি আমি বেরুতে পারি?
ছদ্মবেশে আর লজ্জা কি? যে তােমাকে দেখবে সে তাে আর তােমাকে তুমি বলে চিনতে পারবে না। 
তােমাকে সকলে খাঁটি বিলিতি মেম মনে করবে, আমাকে বরং  ট্যাস ফিরিঙ্গির মত দেখাবে। সাহেবরা হিংসেতে ফেটে মরবে আর ভাববে, ‘বিধাতা বানর গলে দিল মােতির হার।
সুনীতি বলিল যাও যাও ভারি ঠাট্টা শিখেছ। তােমার আর পাগলামি করতে হবে না। সে সব হবে টবে না।
অনেক মিনতি, অনেক সাধাসাধি, অনেক মান অভিমানের পর সুনীতি বলিল, আচ্ছা, ঘরে পরে দেখি কেমন দেখায়, তারপরে বলব। আহারাদির পর সুবােধ দুইটা তােরঙ্গ শয়নকক্ষে আনাইয়া লইল। সে দুইটার ভিতর সুনীতি সুবােধের দুই সুট সাহেবী পরিচ্ছদ।
সুনীতি বলিল—তুমি আগে সাহেব সাজ। সুবােধ বলিল আমার সাহেবী বেশ তুমি কখনও দেখনি না কি? সুনীতি বলিল—না, তবু সাজ। দেখে আমার ভরসা হােক।
সুবােধ সাহেব সাজিল। এইবার সুনীতির পালা। সুনীতি অনেক মেম দেখিয়াছিল। বটে, এবং মেম শিক্ষয়িত্রীর কাছে কিছুদিন লেখাপড়াও শিখিয়াছিল, কিন্তু কোথায় কি পরিতে হয়, তা অত লক্ষ্য করে নাই! যাহা হউক তথাপি পাশের ঘরে গিয়া আন্দাজ এক রকম করিয়া পরিয়া আসিল। যাহা কিছু ভুল চুক ছিল সুবােধও আন্দাজ সংশােধন করিয়া দিল।
সুনীতি সজ্জা সম্পূর্ণ হইলে, সুবােধ সসম্ভ্রমে তাহাকে বলিল গুড মর্নিং মেমসাহেব। সুনীতি হাসিয়া আকুল। সেও বলিল গুডমর্নিং সাহেব। তাহার পর দুজনে দর্পণের সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইল। সােনার জলকরা ফ্রেম আঁটা প্রশস্ত মুকুর ভিত্তিগাত্রে লম্বিত ছিল। তাহাতে সুনীতির প্রতিবিম্ব দেখিয়া সুবােধ হা হা করিয়া হাসিয়া উঠিল। সুনীতিও হি হি করিয়া তাহার সহিত যােগ দিল। মানুষকে যেমন ভূতে পায়, আজ সকালে তেমনি এই দুটা প্রাণীকে যেন হাসিতে পাইয়াছে। সুনীতি হাসিয়া হাসিয়া বলিল-এ বেশে আমি বাইরে যেতে পারব না। তুমি যাই বল। ঝি চাকরেরাই বা কি মনে করবে।
সুবােধ বলিল এক কাজ করা যাবে। বাড়ি থেকে শাড়ি পরে বেরুবে। ট্রেনে পােশাক বদলে নিলেই হবে। একটা কামরা রিজার্ভ করে নেব এখন।
সুনীতি বলিল সে পরামর্শ মন্দ নয়। কিন্তু আমার ভারি লজ্জা করছে। কাজ নেই।
আমার থিয়েটারে গিয়ে, যেমন আছি তেমনি থাকি।
সুবােধ স্ত্রীর চিবুক ধরিয়া আদর করিয়া বলিল আমার এতদিনের সাধ তুমি পূর্ণ  করবে না।
দুই ঘণ্টা পরে হুগলি স্টেশনে আসিয়া সুনীতি ও সুবােধ রিজার্ভ করা সেকেন্ড ক্লাস কক্ষে আরােহণ করিল। গাড়ি ছাড়িয়া দিল। সুবােধ গৃহ হইতেই সাহেবী পােষাক পরিয়া আসিয়াছিল। গাড়ি ছাড়িবামাত্র সুনীতিকে সে স্বহস্তে বিবি সাজাইয়া দিল। কেবল জুতার লেস সুনীতি নিজে বাঁধিল, সুবােধকে কিছুতেই বাধিয়া দিতে দিল না। সুনীতির শাড়ি ও বাহুল্য অলঙ্কারাদি তােরঙ্গে বন্ধ রাখিল। সেখানা প্যাসেঞ্জার গাড়ি। প্রত্যেক স্টেশনে থামিয়া থামিয়া চলিতেছে। গাড়ি ছাড়িয়া দিলে সুনীতি স্বামীর পার্শ্বে বসিয়া বাহিরের দৃশ্য অবলােকন করে, স্টেশনের নিকটবর্তী হইলেই পলাইয়া ও-কোণে গিয়া বসে, সুবােধ কিছুতেই তাহাকে ধরিয়া রাখিতে পারে না।
গাড়ির ছাদে যেখানে লণ্ঠনের গহ্বর সেখানে চারিপাশে চারিখানা আর্শির টুকরা আঁটা আছে, সেই আর্শিতে সুনীতি নিজের প্রতিবিম্ব দেখে আর সুবােধের পানে চাহিয়া  ফিক ফিক করিয়া হাসে। এক একবার বলে খুব সং সাজালে যা হােক….মাগাে-মাগাে!
এও তােমার আসে!
যখন হাওড়ায় আসিয়া গাড়ি থামিল, তখন ঠিক সন্ধ্যা হইয়াছে। আধ ঘণ্টার মধ্যে।
থিয়েটার আরম্ভ হইবে!
সুবােধ সুনীতির হাত ধরিয়া চলিল, একটা কুলী তােরঙ্গটা মাথায় লইয়া অগ্রসর হইল! সুবােধ সুনীতির পানে চাহে আর হাসে। সুনীতির কপালে ঘর্ম ও মুখ লাল হইয়া উঠিয়াছে।
ছেলেবেলায় যা জুতা পায়ে দিয়েছিল, জুতা পায়ে দিয়া চলিতে পারিবে কেন? দুই পা তিন পা চলিয়াই হোঁচট খাইয়া পড়িবার উপক্ৰম করিতেছে।
সুবােধ গাড়ি ভাড়া করিল। গাড়ােয়ান জিজ্ঞাসা করিল কোথায় যাইতে হইবে।
সুবােধ বলিল স্টার থিয়েটার, হাতিবাগান।
সুনীতিকে গাড়ীতে তুলিয়া দিয়া, সুবােধ বাহিরে দাঁড়াইয়াই তাহাকে বলিল তােরঙ্গটা সঙ্গে নিয়ে গিয়ে আর কি হবে, থিয়েটারের বাইরে গাড়িতে পড়ে থাকবে, যদি কেউ উঠিয়ে নিয়ে যায় কিংবা গাড়ােয়ানটাও চম্পট দিতে পারে, ভিতরে ঢের জিনিস রয়েছে, স্টেশন মাস্টারের জিম্মায় রেখে আসি।
সুনীতি সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়িল। সুবােধ কুলীটাকে লইয়া প্রস্থান করিল।
সুবােধকে চলিয়া যাইতে দেখিয়া গাড়ােয়ান হাঁকিয়া জিজ্ঞাসা করিল-কাহা যানে হােগা হুজুর? সুবােধ মুখ ফিরাইয়া বলিল-হাতিবাগান-স্টার থিয়েটার।
সুবােধ গিয়া স্টেশন মাস্টারের সন্ধান করিল, স্টেশন মাস্টার নাই। কিয়ৎক্ষণ অপেক্ষা করিতেই স্টেশন মাস্টার আসিল! সে বলিল-প্যাসেঞ্জারগণের জিনিসপত্র আমি রাখি না, হেড পার্শেল ক্লার্কের কাছে যান, চারি আনা ফি লাগিবে, রসিদ পাইবেন!
সুতরাং সুবােধ হেড পার্শেল ক্লার্কের সন্ধানে চলিল। অনেক কষ্টে তবে তাহাকে আবিষ্কার করিতে সমর্থ হইল। তিনি একটি বাঙালীবাবু চক্ষু দেখিলে মনে হয় বিলক্ষণ অহিফেন সেবন করা অভ্যাস আছে।
অত্যন্ত ধীরভাবে সে ব্যক্তি সুবােধের প্রস্তাব শ্রবণ করিল। শেষে বলিল চার আনা লাগিবে। এই বলিয়া রসিদের বহি বাহির করিল। পেন্সিলটা খুঁজিতে কিয়ৎক্ষণ গেল।
পেন্সিল যদি মিলিল, তবে কার্বন কাগজ আর পাওয়া যায় না।
এ দেরাজ সে দেরাজ, এ আলমারি সে আলমারি বহু অনুসন্ধানেও যখন কালা কাগজ পাওয়া গেল না, তখন সুবােধ বলিল মহাশয়! আমার সময় নাই, না হয়।
হাতেই লিখিয়া দেন না!
সুবােধের অঙ্গে ইংরেজ-বেশ ছিল, সুতরাং অনুরােধটা উপেক্ষিত হইল না। রসিদ লইয়া কুলীকে বিদায় দিয়া, সুবােধ তাড়াতাড়ি গাড়ির কাছে ছুটিয়া গেল। গিয়া দেখিল, যেখানে সুনীতির গাড়ি ছিল, সেখানে নাই।
মুহুর্তের মধ্যে পৃথিবীখানা বিদ্যুত্মণ্ডিত বলিয়া মনে হইল। কিন্তু সুবােধ তৎক্ষণাৎ আত্মসম্বরণ করিয়া ভাবিল, এইখানে কোথাও নিশ্চয়ই সরিয়া গিয়া দাঁড়াইয়াছে! সে স্টেশনের অঙ্গনে তখনও বহুসংখ্যক গাড়ি দণ্ডায়মান। সুবােধ প্রত্যেক গাড়ির কাছে গিয়া উকি মারিয়া দেখিতে লাগিল।

আরও পড়ুনঃ Bangla Funny Jokes

সেই গাড়ির নম্বরটা কেন দেখিয়া রাখে নাই, কেন এমন মূর্খতা করিল, এই ভাবিয়া নিজবুদ্ধিকে অত্যন্ত ধিক্কার দিতে লাগিল।
কিন্তু অনুশােচনার সময় নাই। ক্রমেই অন্ধকার বাড়িতেছে। একে একে গাড়িগুলিও বাহির হইয়া যাইতেছে। সহসা একটা কথা সুবােধের মনে হইল। যখন গাড়ােয়ান জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, কোথায় যাইতে হইবে, তখন সে বলিয়াছিল স্টার থিয়েটারে।
গাড়ােয়ান সুনীতিকে লইয়া যদি স্টারে উপস্থিত হইয়া থাকে?
এই কথাটা মনে হইবামাত্র সুবােধ একখানা গাড়ি ভাড়া করিয়া স্টার থিয়েটারে ছুটিল। গাড়িতে বসিয়া ভাবিতে লাগিল, নিশ্চয়ই তাহাই হইয়াছে। সে যখন কুলী সঙ্গে করিয়া স্টেশন মাস্টারের নিকট বাক্স রাখিতে গেল, তখন তাে গাড়ােয়ানকে অপেক্ষা করিতে বলিয়া যাই নাই। মেমসাহেবেরা একাকীও ভ্ৰম করিয়া থাকেন, গাড়ােয়ান কোনও সংশয় না করিয়া আপন মনে হাঁকাইয়া গিয়াছে আর কি। সুনীতি কি আর মুখ বাড়াইয়া চিৎকার করিয়া তাহাকে নিষেধ করিতে পারিয়াছে। এই ঘটনায় সে ভয়ে বিস্ময়ে ভ্যাবাগঙ্গারাম হইয়া গাড়ির ভিতর বসিয়া কাপিতেছে হয়ত কাঁদিতেছে, নয়ত মুছা গিয়াছে।
স্টার থিয়েটারের সম্মুখে গাড়ি পৌছিল। মহাসমারােহে চন্দ্রশেখরের অভিনয় আরম্ভ হইয়াছে। জনতা অত্যন্ত অধিক। বহুলোেক স্থানাভাবে টিকিট পাইতেছে না, ফিরিয়া যাইতেছে। সুবােধ লম্ফ দিয়া গাড়ি হইতে অবতরণ করিল। দণ্ডায়মান সমস্ত গাড়িগুলি একে একে অন্বেষণ করিল। কোনও খানিতে সুনীতি নাই। তাহার মাথা ঘুরিতে লাগিল।
বুদ্ধিসুদ্ধি লােপ হইবার উপক্রম হইল।
ফিরিবার সময় প্রত্যেক গাড়ির গাড়ােয়ানকে জিজ্ঞাসা করিলতুম কোই মেমসাহেবকে লায়া? সকলেই বলিল না। একজন বলিল হাঁ হুজুর লায়া।
সুবােধের বুকের ভিতরটা ধড়াস্ করিয়া উঠিল। মনে হইল এইবার যেন অকুল সমুদ্রে কুল পাইয়াছি। 

ঘােড়া দুইটা দেখিল, গাড়ােয়ানের পানে চাহিল, ঠিক যেন সেই ।
ঘােড়া সেই গাড়ােয়ান বলিয়াই মনে হইল।
এক মুহূর্তের মধ্যে এ সমস্ত ঘটিয়া গেল! দ্বিতীয় মুহূর্তে সুবােধ গাড়ােয়ানকে জিজ্ঞাসা করিল কাহাসে লায়া? হাওড়া স্টেশনসে?
হাঁ হুজুর, হাওড়া স্টেশনসে লায়া।
হামকো দেখা থা?
কোচ বাক্সে বসিয়া মুখ বুকাইয়া সেই অল্পালােকে গাড়ােয়ান সুবােধের মুখ নিরীক্ষণ করিল। ভাবিয়া চিন্তিয়া বলিল, হাঁ হুজুর আপকো মাফিক একঠো সাহেবকো দেখা থা।
সুবােধ তখন অত্যন্ত আগ্রহের সহিত বলিল মেমসাহেব কী ধর গিয়া? মেমসাহেব ভিতর মে তামাসা দেখিরহিহে! শুনিয়া সুবােধ ভারি নিরাশ হইল।
ভাবিল তবে এ তাে সুনীতি নহে। সুনীতি হইলে সে কখনাে গাড়ি ত্যাগ করিয়া টিকিট কিনিয়া থিয়েটারের ভিতর প্রবেশ করিত না। তাহা একান্তই অসম্ভব! তথাপি ভাবিল একবার দেখা যাউক। ভিড় ঠেলিয়া ফটক পার হইয়া সুবােধ থিয়েটারের অঙ্গনের ভিতরে প্রবেশ করিল।
যে ব্যক্তি টিকট বিক্রয় করে, তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল ইংরাজি বেশধারিণী কোনও বঙ্গ।
মহিলা টিকিট ক্রয় করিয়াছেন কি?
সে ব্যক্তির নাম ভবচরণ ; বলিল মহাশয়, এত লােক টিকিট লইয়াছে, এই ভীড়ে কাহারাে মুখের পানে চাহিয়া দেখিবার অবসর পাইয়াছি! তবে মনে হইতেছে যেন।
একজন লইয়াছেন।
সুবােধ লােকটার হাতে একখানা নােট দিয়া বলিল মহাশয়, একবার বাহিরে আসুন। চরণ সসস্ত্ৰমে বাহির হইয়া আসিল। ঔৎসুক্যের সহিত বলিল কি মহাশয়? সুবোধ বলিল–আমাকে একটু সাহায্য করিতে হইবে। আপনাদের কোনও লােক দিয়া একবার সেই মহিলাটিকে সংবাদ দিতে হইবে। যদি আমার কার্য সফল হয়, তবে আর একখানি নােট দিব। ভবচরণ হাসয়া বলিল তা মহাশয় নিশ্চয়ই করিব। একজন ভদ্রলােকের যদি উপকার করিতে পারি, তবে তা না করিব কেন? আপনি একটু অপেক্ষা করুন আমি এখনি আসিতেছি।
বলিয়া ভবচরণ একটু অভূতপূর্ব রকম আচরণ করিল। একটা গােলােযােগের ব্যাপার সন্দেহ করিয়া, থিয়েটারের কোন ঝিকে ডাকিয়া তাহার দ্বারা উপরে সুবােধের বার্তা না পাঠাইয়া, ইহা নির্বিবাদে হাসিল করা কোন ঝির কর্ম নয় মনে করিয়া, সে পশ্চাৎদিক দিয়া থিয়েটারের সাজঘরে উপস্থিত হইল। 
দেখল তাহার পরিচিতা রােহিণী নাম্নী নটী দলনী বেগমের পরিচ্ছদ পরিয়া চেয়ারে বসিয়া তামাক খাইতেছে।
তাহাকে গিয়া চুপি চুপি বলিল একটা কাজ করবে?
কি?
ভবচরণ সংক্ষেপে ব্যাপারখানা রােহিনীকে বুঝাইয়া দিল। রােহিণী বলিল কি দেবে?
একটা ফোর ক্রাউন হুইস্কি।
আরে রামঃ– গলা জ্বলে। গ্রীন শীলিং।
আচ্ছা তাই, এস তবে।
বেগমের পরিচ্ছদ পরিত্যাগ না করিয়া বাহিরে যাওয়া চলে না অথচ ছাড়িলে আবার পরতে অনেক কষ্ট ও সময় নষ্ট হবে সুতরাং রােহিণী একখানা বিলাতী শালে আপাদমস্তক।
আবৃত করিয়া চটি জুতা পায়ে দিয়া ভবচরণের পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিল। ভবচরণ সুবােধ বাবুকে দেখাইয়া বলিল এরি কথা বলছিলাম। সুবােধ কার্ডকেস হইতে নিজের একখানি কার্ড বাহির করিয়া রােহিণীর হাতে দিল।
বলিল যদি কোন ইংরাজিবেশধারিণী বঙ্গ মহিলাকে ভিতরে দেখেন, তবে এই কার্ড দেখিয়ে অনুগ্রহ করে তাকে ডেকে আনবেন। রােহিণী সুবােধের পানে চাহিয়া একটু মুচকি হাসি হাসিল। কার্ডখানি লইয়া, হেলিয়া দুলিয়া সিঁড়ি ভাঙিয়া উপরে উঠিল। সুবােধ দাঁড়াইয়া অপেক্ষা করিতে লাগিল।
পাঁচ মিনিট পরে কার্ডখানি হাতে করিয়া নামিয়া আসিয়া বলিলভিতরে “ইংরাজিবেশধারিণী’ আপনার কোন মহিলা নেই। একজন আছেন তিনি আপনার আত্মীয়তা অস্বীকার করলেন।
সুবােধ কোন কথা না বলিয়া ম্লানমুখে সে স্থান হইতে চলিয়া গেল। রােহিণী তাহার সঙ্গীকে বলিল, আজ ভাল বিপদে ফেলেছিলে ভাই। একটা গ্রীন শীলের লােভে প্রাণটা গিয়েছিল আর কি! খুঁজে খুঁজে ইংরাজি বেশধারিণী মহিলার কাছে উপস্থিত হয়ে বললাম আপনার স্বামী বাইরে অপেক্ষা করছেন আপনি শীঘ্র আসুন।
বলে কার্ড দেখালাম। মাগী কার্ডখানা ছুড়ে আমার গায়ে ফেলে দিলে। চটে লাল আমাকে মারে কি!
তুমি কোন্ সাহসে বললে আমার স্বামী বাইরে অপেক্ষা করছেন? স্বামী কি অন্য কেউ কি করে জানলে? নিশ্চয় স্বামী। দেখছ না, লােকটা মণিহারা ফণি হয়ে বেড়াচ্ছে। স্বাধীনতাওয়ালা আলােকপ্রাপ্ত লােক। স্ত্রীটি হারিয়ে বসে আছেন। অমৃত বােসকে বলব এখন, ভারি একটি মজার নতুন প্রহসন হবে। সুবােধ অঙ্গনের বাহিরে গিয়া কিয়ৎক্ষণ দাঁড়াইয়া ভাবিল। এমন বিপদে সে ইহজন্মে আর কখনাে পড়ে নাই। এই একবার মনে হইতে লাগিল এসকল কি সত্য, না স্বপ্ন দেখিতেছি। যদি ইহা স্বপ্ন হইয়া যায়, যদি ঘুম ভাঙ্গিয়া উঠিয়া দেখি যে এসব কিছু নহে। সুনীতি আমার পার্শ্বে শয়ন করিয়া নিদ্রা যাইতেছে, তাহা হইলে কি সুখ, কি আনন্দ হয়! সুবােধের দুইটি চক্ষু জলপূর্ণ হইল। মনে মনে বলিল সুনীতি, কোথায় তুমি, কি অবস্থায় রহিয়াছ, কোন দস্যুহস্তে, কি মহাবিপদে তুমি পতিত হইয়াছ, আমি ত কিছুই জানিতে পারিতেছি না। হাওড়া স্টেশনের প্লাটফর্মে সুনীতির সেই লজ্জারক্তিম মুখখানি কেবলই সুবােধের মনে পড়িতে লাগিল। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলিয়া ভাবিল, হায় হায়, আমিই তােমার সর্বনাশ করিলাম! কিন্তু এমনভাবে কালক্ষেপ করিয়া কি ফল হইবে! সুবােধ মনে করিল, আর একবার হাওড়ায় গিয়া অনুসন্ধান করি, যদি সে গাড়িখানা এতক্ষণ ফিরিয়া আসিয়া থাকে। 
যে গাড়ি সুবােধ হাওড়া হইতে ভাড়া করিয়া আসিয়াছিল, তাহা এতক্ষণ অপেক্ষা করিতেছিল।সুবােধ তাহাতে আরােহণ করিয়া হাওড়ায় যাইতে কহিল। স্টেশনে পৌছিয়া সুবােধ দেখিল, অঙ্গন বহু শকটে পরিপূর্ণ। পাঞ্জাব ডাকগাড়ি ছাড়িবার সময় উপস্থিত! হতবুদ্ধির মত সকল গাড়িগুলির কাছে এক একবার দাঁড়াইল, কেমন করিয়া সে গাড়ি চিনিয়া বাহির করিবে! ডাকগাড়ি ছাড়িয়া গেল। সুবােধ একটা মতলব স্থির করিয়াছে। স্টেশন মাস্টারের কাছে গিয়া বলিল মহাশয়, আপনার সমস্ত কুলীকে যদি দয়া করিয়া একত্র করেন, তবে অত্যন্ত উপকৃত হই। বৈকালের ট্রেনে যে ব্যক্তি আমার তোরঙ্গা নামাইয়াছিল, তাহাকে আমার বিশেষ প্রয়ােজন।
স্টেশন মাস্টার গম্ভীরমূর্তি ধারণ করিয়া বলিলেন মহাশয়, জি-আর-পুলিশকে আবেদন করুন।
চলিল সুবােধ রেলওয়ে পুলিশের দারােগার সন্ধানে। দারােগা সাহেব মুসলমান, চারপাই পাতিয়া নিদ্রার আয়ােজন করিতেছিলেন। তাহার সমীপে সুবােধ উপস্থিত হইয়া নিজের আবেদন জানাইল। প্রথমে তা দারোগাসাহেব কানেই তােলেন না। অবস্থা বুঝিয়া, প্রাণের দায়ে সুবােধ তাহাকে কিঞ্চিত দক্ষিণান্ত করিল।
তখন দারােগাসাহেব সতেজে উঠিয়া বসিলেন। রাইটার কনষ্টেবলকে হুকুম দিলেন-বােলাও সব শালা কুলী লােগকে।
পুলিশের হাঁকডাকে স্টেশনে প্রকম্পিত হইয়া উঠিল। দলে দলে বহু কুলী আসিয়া সম্মুখে দাঁড়াইল। 
ক্রমে যে ব্যক্তি সুবােধের তােরঙ্গ নামাইয়াছিল, সে উপস্থিত হইল।
সুবােধ তাহাকে চিনিল। জিজ্ঞাসা করিল বিকেলের ট্রেনে নামিয়া, যে গাড়ি আমি ভাড়া করিয়াছিলাম, সে গাড়ির গাড়ােয়ানকে তুমি চেন কি?
সে ব্যক্তি বলিল চিনি বৈকি হুজুর, তার নাম রহিমবক্স।
রহিমবক্সের আড্ডা কোথায় জান?
জোড়াসাঁকো!
সেখানে আমায় লইয়া যাইতে পার? ভাল করিয়া বখশিস দিব।
বখশিসের নাম শুনিয়া কুলিপুঙ্গব অত্যন্ত উল্লসিত হইয়া বলিল চলুন না হুজুর। এখুনি যাচ্ছি।

আরও পড়ুনঃ গল্পঃ প্রেম 

কুলী সুবােধের সঙ্গে চলিল। পুলিসের সেই রাইটার কনষ্টেবল অর্থাৎ ‘মুন্সীজি’ সুবােধের সম্মুখে দাঁড়াইয়া, তাহার মুখের পানে সহাস্যে কটাক্ষপাত করিয়া বলিল- বাবু-সাহেব।
সুবােধ বলিল বখশিস?
সে-ব্যক্তি গর্বিতভাবে বলিল বাবুজি, আমি চাপরাশি না দারােয়ান যে বকশিস দিবেন? তবে পান খাইবার জন্য যদি কিছু দেন ত আলবৎ লইতে পারি।
সুবােধ মনে মনে বলিল বাধিত করিতে পার। সুবােধের মন তখন উদভ্রান্ত।
টাকার প্রতি মায়া-মমতা সম্পূর্ণভাবে তিরােহিত হইয়াছিল। ঠন করিয়া একটা টাকা ফেলিয়া দিল।
টাকাটা কুড়াইয়া লইয়া মুন্সী বলিল-বন্দেগী বাবুসাহেব।
কুলীকে সঙ্গে লইয়া গাড়ী করিয়া সুবােধ জোড়াসাঁকোর এক অন্ধকার গলিতে উপস্থিত হইল। পথে বারবার শঙ্কা করিতে করিতে আসিয়াছিল, হয়ত গাড়ােয়ানের।
দেখা পাওয়া যাইবে না। কিন্তু সে আশঙ্কা অমূলক হইল। গাড়ি আছে। গাড়ােয়ান পার্শ্বে খাটিয়াই শুইয়া ঘুমাইতেছে।
কুলী তাহাকে জাগাইল-রহিম- রহিম-ওঠ ওঠ। রহিম ঘুমের ঘােরে। বলিল—আজ আর আমি ভাড়া যাব না। আজ দাও মেরে নিয়েছি। শুনিয়া সুবােধের মনটা ছনাৎ করিয়া উঠিল! ভাবিল কি অমঙ্গলের কথাই শুনিব না জানি।
কুলী তাহাকে আশ্বাস দিল-ওঠ, ভাড়া যেতে হবে না। শীঘ্র ওঠ। রহিম কোন মতে উঠিল। মুখে ভয়ানক মদের গন্ধ । বিড়বিড় করিয়া কি বকিতে লাগিল কিছুই বােঝা গেল না। বকিতে বকিতে আবার ধপাস করিয়া খাটিয়ায় বসিয়া পড়িল।
কুলী তখন গাড়ির জ্বলন্ত লণ্ঠনটা খুলিয়া আনিয়া সুবােধের মুখে আলােক ধরিল।
জিজ্ঞাসা করিল এঁকে চিনতে পারিস?
সুবােধকে দেখিবামাত্র গাড়ােয়ান উঠিয়া দাঁড়াইল। হাত দুইটি জোড় করিয়া অত্যন্ত করুণস্বরে বলিল, হুজুর আপনার মেমসাহেব আমাকে আজ দশ টাকা বখশিস দিয়েছেন।
সুবােধ যেন হাতে স্বর্ণ পাইল। জিজ্ঞাসা করিল আমার মেম সাহেবকে কোথায় রেখে এসেছিস?
দারােয়ানের মাথার ঠিক ছিল না। একে মদ্যের প্রভাব, তাহার উপর একদমে দশ টাকা লাভ করিয়াছে। কিয়ৎক্ষণ ভাবিল। ভাবিয়া পূর্ববৎ করুণস্বরে বলিল হুজুর,
ভবানীপুর।
কোন্ স্থান?
চক্রবেড়িয়া।
সুবােধের দেহে প্রাণ আসিল? ভবানীপুর চক্রবেড়িয়া সুবােধের ভায়রাভাই অবিনাশচন্দ্রের বাড়ি। সুনীতি নিশ্চয়ই সেখানে গিয়াছে। আর কোন ভাবনা নাই। তবু সুবােধ জিজ্ঞাসা করিল কত নম্বর ?
নম্বর ত মনে নাই হুজুর। বারম্বার এই কথা বলিতে বলিতে লােকটা হাউ মাউ করিয়া কাদিতে লাগিল।
তাহার কান্না দেখিয়া সুবােধ অত্যন্ত বিস্মিত হইল। কুলীকে জিজ্ঞাসা করিল এ কাদে কেন?
কুলী জিজ্ঞাসা করিল রহিম! কাদিস কেন রে? 

ভয় কি তাের ?
রহিম কাদিতে কাদিতে উত্তর করিল–ভয় আবার কি? বেশী দারু পিলেই আমার কান্না পায়। 
মনে হয় আমার বিবি মরে গেছে। শুনিয়া সুবােধ মনে মনে হাসিল। বিবির বিরহে মানুষের অন্তরে যে কি ভাব উপস্থিত হয়, তাহা সে এতক্ষণে বিলক্ষণ হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিয়াছিল।
সুবােধ পকেট হইতে একখানা দশ টাকার নােট বাহির করিয়া দিয়া বলিল তােমরা ঐ দুজনে এই পাঁচ পাঁচ টাকা বকশিস নাও। পরমুহূর্তেই সুবােধের গাড়ী ভবানীপুর অভিমুখে ধাবিত হইল। রাত্রি তখন এগারােটা।
শীতল নৈশ্য বায়ু তাহার ললাটের ঘর্ম অপনােদন করিয়া দিল! সুবােধ মনে একপ্রকার এ অভূতপূর্ব লঘুতা অনুভব করিল। বারংবার অস্ফুটস্বরে বলিতে লাগিল এ কি মুক্তি, এ কি পরিত্রাণ! কি আনন্দ হৃদয় মাঝারে! চক্রবেড়িয়া রােডে অবিনাশচন্দ্রের বাড়ির সম্মুখে সুবােধের গাড়ি দাঁড়াইল। তাড়াতাড়ি গাড়ােয়ানকে বিদায় করিয়া, মুক্ত দুয়ারে বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করিল। একেবারে অবিনাশচন্দ্রের শয়নকক্ষে গিয়া উপস্থিত। কেরােসিনের ল্যাম্প মিটিমিটি করিয়া জ্বলিতেছে। অবিনাশচন্দ্র বিছানায় আড় হইয়া শুইয়া। তাহাকে দেখিবামাত্র সুবােধ রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞাসা করিল-সুনীতি?
অবিনাশচন্দ্র হাই তুলিয়া বলিলেন সুনীতি কি?
সুনীতি এসেছে?
অবিনাশচন্দ্র আবার হাই তুলিয়া ধীরে ধীরে বলিলেন কোথা থেকে নেশা করে এলে। ভুল বকচ যে হে!
সুবােধ হতাশ হইয়া নিকটস্থ চেয়ারে বসিয়া পড়িল।
এই সময় তাহার শ্যালিকা সুমনা প্রবেশ করিলেন। সুবােধকে দেখিয়া হা হা করিয়া হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন কিগাে সাহেব! চন্দ্রশেখর অভিনয়টা কেমন দেখলে ?
অবিনাশচন্দ্র স্ত্রীকে ভর্ৎসনা করিলেন আচ্ছা পাগল! পেটে এক মিনিট কথা থাকে না? আমি ভায়াকে একটু চানকে নিচ্ছিলুম।
সুবােধ বলিল খুব লােক যা হােক! এসব বিষয় নিয়ে ঠাট্টা তামাসা করে!
মহা হাসি পড়িয়া গেল। সুমনা অবিনাশচন্দ্র উভয়ে মিলিয়া সুনীতির দুর্গতির ইতিহাসটা বিবৃত করিলেন। সুবােধ কুলির সঙ্গে স্টেশন মাস্টারের সন্ধানে প্রস্থান করিলেই গাড়ােয়ান গাড়ি হাঁকাইয়া একেবারে স্টার থিয়েটারে হাজির। গাড়িও ছুটিল, সুনীতিও কান্না আরম্ভ করিয়া দিল। থিয়েটারের সম্মুখে গাড়ি দাঁড় করাইয়া গাড়ােয়ান আসিয়া দরজা খুলিয়া দিল। গাড়ােয়ানকে দেখিবামাত্র সাহসে ভর করিয়া সুনীতি বলল চল আবার স্টেশনে চল। আমার স্বামীকে ফেলিয়া আসিলি কেন? গাড়ােয়ান আবার হাওড়া স্টেশনে যায়! অনেক খুঁজিয়া সুবােধকে পাইল না। তখন কি ভাগ্যিস সুনীতির বুদ্ধি যােগাইল। এখানকার ঠিকানা বলিয়া দিল। দশ টাকা বখশিস কবুল করিল। আমরা তাে মেমসাহেব দেখিয়া চিনিতেই পারি না। শেষকালে সুমতি উপসংহার করিলেন আহা।
মরি কি যে ছিরিই বেরিয়েছিল! 
সে বেশ আর সে অবস্থা দেখে হাসব কি কাদব ভেবে ঠিক করতে পারিনি। যদি থিয়েটারের বউ নিয়ে যাবারই সাধ, তবে অমন কিম্ভুতকিমাকার সাজিয়ে, পুজোর সময় সখ করে যে নূতন পােষাক তৈরি করিয়েছ তাই পরালেই ত হত। সেও শাড়ি হােক, কিন্তু এ কালের ছাঁদের, কত সুন্দর! যে সব মেয়েরা বাইরে বেরােন, তাঁরা ত ঐ পরে বেরােন, তারা ত আর গাউন পরতে যান না। এ বুদ্ধিটুকু তােমার ঘটে কেন জোটেনি?
সুবােধ মহা অপ্রতিভ হইয়া ভাবিল তাই ত!
বৃত্তান্ত শেষ হইলে সুমনা সুবােধকে বলিল—এখন এস সাহেব মশাই। তােমার বিবির সঙ্গে দেখা করবে এস। সে ত এসে অবধি জল গেলাসটি অবধি খায়নি, কেঁদে কেঁদে মরছে। এই এতক্ষণে ঘুমিয়ে পড়ল। যাই উঠাইগে চল। তােমার অবস্থাটা কি হয়েছিল বলবে এস।

(সমাপ্ত)

Leave a Comment

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now