Last updated on July 4th, 2023 at 12:50 am
আজকের Bangla sad premer golpo টির নাম – “জতুগৃহ” গল্পের প্রধান চরিত্রে শতদল দত্ত ও মাধুরী রায়, গল্পের বিষয় – অসম্পূর্ণ ভালোবাসা, Bangla love story এবং Bengali jokes আরও পড়ার জন্য আমাদের ব্লগ টিকে সাবস্ক্রাইব করে আমাদের সাথে থাকুন, গল্পটি পড়িয়া যদি আপনার ভালো লাগিয়া থাকে তাহলে অবশ্যই কমেন্ট এবং শেয়ার করিতে ভুলিবেন না।
Bangla Sad Romantic Love Story – ব্যর্থ প্রেম
আজকের গল্প – জতুগৃহ
এত রাত্রে এটা কোন ট্রেন ? এই শীতার্থ বাতাস, অন্ধকার আর ধোঁয়া ধোঁয়া বৃষ্টির মধ্যে যে ট্রেনটা ক্লান্তভাবে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে রাজপুর জংশনের প্ল্যাটফর্মের গায়ে লাগলাে?
খুব সম্ভব গঙ্গার ঘাটের দিক থেকেই ট্রেনটা এসেছে। এখনাে অদূর গঙ্গার বুকে সেই স্টিমারের চিমনি বাঁশির শব্দ শােনা যায়, যে স্টিমারটা একদল যাত্রীকে ঘাটে নামিয়ে দিয়ে একটু হালকা হয়ে আর হাঁপ ছেড়ে আবার ওপারে চলে যাচ্ছে। প্ল্যাটফর্মের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ট্রেনের ইঞ্জিন আস্তে আস্তে হাঁপাতে থাকে। ফাস্ট ক্লাস ওয়েটিং রুমে বয়টা একটু ব্যস্ত হয়ে ওঠে। টেবিল চেয়ার বেঞ্চ আর আয়নাটার ওপর ঝটপট তােয়ালে চালিয়ে একটু পরিচ্ছন্ন করে ফেলে। জমাদার এসে রুমের টুকিটাকি আবর্জনা বড়াে বড়াে ঝাটার টান দিয়ে সরিয়ে নিয়ে যায়। ঘাটের ট্রেনটা ছােট হলেও এবং যাত্রীর সংখ্যা কম হলেও ফার্স্ট ক্লাসের যাত্রী দু-একজন তার মধ্যে পাওয়াই যায়। হয়তাে কাটিহারের কোনাে চিনিকলের মহাজন, অথবা দার্জিলিং-ফেরত কোনাে চা-বাগানের সাহেব, এই ধরনেরা কুলীন শ্রেণির যাত্রীও থাকেন, শুধু সাঁওতাল কুলির দলই নয়।
কিন্তু যারা এই ক্লান্ত ট্রেন থেকে নেমে ব্যস্তভাবে এসে ফার্স্ট ক্লাস ওয়েটিং রুমে আশ্রয় নিলেন, তাঁদের সঙ্গে চিনিকল অথবা চা-বাগানের কোনাে সম্পর্ক নেই। কুলির মাথায় বাক্স বেডিং চাপিয়ে প্ল্যাটফর্মের ওপর দিয়ে গুঁড়াে গুঁড়াে বৃষ্টির মধ্যে তর তর করে হেঁটে ওয়েটিং রুমে প্রথম এসে ঢুকলেন এক বাঙালী মহিলা। গায়ে কাশ্মীরী পশমে তৈরি একটা মেয়েলী আস্টার, কানে ইহুদী প্যাটার্নের ছােট ফিরােজার দুল, খোঁপা বিলিতী ধাঁচে কাপানাে।
তারপরেই যিনি এসে ঢুকলেন, তারও সঙ্গে কুলি, আর তেমনি বাক্স বেডিং-এর বহর। চোখে চশমা, গায়ে শাল, দেশী পরিচ্ছদে ভূষিত এক বাঙালী ভদ্রলােক। এক ভদ্রলােক আর এক মহিলা, একই ট্রেনের যাত্রী হয়ে এক ওয়েটিং রুমে আশ্রয় নিয়েছেন। এই মাত্র সম্পর্ক, যদি নেহাৎই একে সম্পর্ক বলা যায়। ইনি হয়তাে ঘণ্টা দুয়েক, আর উনি হয়ত ঘণ্টা তিনেক পথ প্রান্তের এই শিবিরে ট্রেনের প্রতীক্ষায় থাকবেন, তারপর চলে যাবেন যার যার পথে।
ওপর রাখা জিনিসপত্রগুলি সরিয়ে একটু জায়গা করে নিয়ে বেঞ্চের উপরেই চুপ করে বসে থাকে।
শতদল দত্ত আর মাধুরী রায়। দু’জন ট্রেন-যাত্রী মাত্র, রাজপুর জংশনের ওয়েটিং রুমে বসে থাকে ট্রেনের প্রতীক্ষায়। এ ছাড়া দু’জনের মধ্যে আজ আর কোনাে সম্পর্ক নেই।
শুধু আজ নয়, আজ প্রায় পাঁচ বছর হল দু’জনের মধ্যে কোনাে সম্পর্ক নেই। কিন্তু তার আগে ছিল, সেও প্রায় একটানা সাত বছর ধরে। সম্পর্কের লক্ষণ দেখা দিয়েছিল প্রায় বারাে বছর অতীতে, যে অতীতে মাধুরী মিত্র নামে দেখতে বড়াে সুন্দর এক অনূঢ়া তরুণী শতদলের মেজবৌদির বান্ধবী মাত্র ছিল। আর স্থানটা ছিল ঘাটশিলা, সময়টা ফাল্গুন, মধুদ্রমের বীথিকার যখন সৌরভের উৎসব জাগে। তারই মধ্যে আকস্মিক এক অপরাহ্নের আলােকে শুধু একটি বেড়াতে যাবার ঘটনা, তাই তাে মাধুরী মিত্রের সঙ্গে শতদল দত্তের, সম্পর্কের আরম্ভ।
এক বছরের পরিচয়েই দু’জনে দু’জনকে যে খুবই বেশি ভালবেসেছিল তাতে সন্দেহ নেই। সে ভালবাসা আইনমতাে রেজিস্টারীও করা হয়, তার মধ্যেও কোনাে ভুল ছিল । কিন্তু বিয়ের পর সাতটি বছর পার হতে না হতে মাধুরী দত্ত আর শতদল দত্তের মধ্যে সে ভালবাসার জোর আর রইল না। তাই আবার দু’জনেই স্বেচ্ছায় এবং আইনমতাে আদালতের শরণ নিল, রেজিস্টারী করা সম্পর্ক বাতিল করে দিয়ে দু’জনের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল।
কে জানে কেমন করে যেন দু’জনেই বুঝতে পেরেছিল, ভালবাসার জোর আর নেই। মনের দিক থেকে দুজনে দুজনের কাছে যখন পর হয়েই গেল, তখন লােকচক্ষুর সম্মুখে অনর্থক আর থিয়েটারের স্বামী-স্ত্রীর মতাে দাম্পত্যের অভিনয় না করে দু’জনেই দু’জনের কাছ থেকে বিদায় নিল। কেউ কাউকে বাধা দিল না।
ফাল্গুনের ঘাটশিলায় মধুদুমের সৌরভে যে প্রেমের আবির্ভাব, মাত্র সাতটি নতুন ফাল্গুনও তার গায়ে সহ্য হল না। এত জোর ভালবাসার পর বিয়ে, তবু বিয়ের পর ভালবাসার জোরটুকুই ভেঙে যায় কি করে?
তাও দু’জনেই বাস্তব আর চাক্ষুষ প্রমাণ দেখেই বুঝেছিল, একদিন এই ঘরে বসে একমনে বই পড়ছিল মাধুরী, আর ও-ঘরে একা একা নিজের হাতেই কাপড়-চোপড় গুছিয়ে বাক্সে ভরছিল শতদল। এক সপ্তাহের জন্য ভুবনেশ্বর থাকতে হবে, প্রত্নবিভাগের একটা সার্ভে তদারকের জন্য। শতদলের রওনা হবার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত মাধুরী একবার এসে চোখের দেখা দিয়েও যেতে পারলাে না। সেদিনই মনে হয়েছিল শতদলের, এই যে পৌষের প্রভাতে জানালা দিয়ে এত আলাে ঘরের ভেতর এসে লুটিয়ে পড়েছে, নিতান্ত অর্থহীন, কোনাে প্রয়ােজন ছিল না।
পৌষের সকাল বেলাটাই শুধু অন্যায় করেনি। সেই বছরেই চৈত্রের একটা রবিবারের কিন্তু আশ্চর্য, ঘরে ঢােকামাত্র দুজনেই দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রথমে চমকে ওঠেন। তারপরেই চিত্রবৎ মতাে স্তব্ধ হয়ে থাকেন। দুজনে যেন অপ্রস্তুত ও লজ্জিত, বিরক্ত ও বিড়ম্বিত এবং একটু ভীতও হয়ে ওঠেন। যেন কাঠগড়া থেকে পালানাে ফেরারী আসামীর মতাে বহুদিন পরে এবং নতুন করে এক আদালত ঘরের মধ্যে দুজনে এসে পড়েছেন। মাধুরী রায়ের আস্টারে কুচি কুচি জলের ফোটা নিঃশব্দে চিক চিক করে। শতদল দত্ত জলে-ভেজা চশমার কাচ মুছে নিতে এটা রাজপুর জংশনের ওয়েটিং রুম, আদালত ঘর নয়, জজ নেই, উকিল নেই, সাক্ষী নেই, সারি সারি সাজানাে কতগুলি নিষ্পলক লােকচক্ষু নেই। প্রশ্ন করে লজ্জা দিতে, স্বীকৃতি বা স্বাক্ষর আদায় করতে তৃতীয় কোনাে ব্যক্তি নেই। তবু এই নিভৃত সান্নিধ্যই দুজনের কাছে বড় বেশি দুঃসহ বলে মনে হয়। সরে পড়তে পারলে ভালাে, সরে যাওয়ই উচিত। শতদল দরজার কাছে এগিয়ে গিয়ে ডাক দেয় কুলি !
মাধুরীর জিনিসপত্র ছড়িয়ে পড়ে আছে এই বেঞ্চের ওপর। শতদলের জিনিসপত্র স্তুপীকৃত হয়ে রয়েছে ঐ টেবিলটার ওপর।
এক্ষুনি জিনিসপত্র আবার কুলির মাথায় চপিয়ে শতদল দত্তকে চলে যেতে হবে। কিন্তু কোথায়, তা সে জানে না। শুধু অদৃশ্য লজ্জায় অভিভূত এই ওয়েটিং রুম ছেড়ে অন্য কোনােখানে, হয়তাে ঐ মুসাফিরখানায়, যেখানে এরকম আলাে নেই, আসবাবও নেই, কিন্তু অতীতের এক অস্পষ্ট ছায়াকে এত জীবন্ত মূর্তিতে মুখােমুখি দেখে বিব্রত হওয়ার শঙ্কাও সেখানে নেই। শতদলের ডাকে সাড়া দিয়ে কুলিদের কেউ এল না, এল ওয়েটিং রুমের বয়।
হুজুর।
বয়কে উত্তর দিতে হবে। শতদল দত্ত আর একবার দরজা পর্যন্ত পায়চারি করে এগিয়ে যায়, বাইরে উঁকি দিয়ে তাকায়, গুঁড়াে বৃষ্টির একটা ঝাপ্টা মুখে এসে লাগে। ফিরে এসে আবার টেবিলটার পাশে দাঁড়ায়, যেন নিজেরই চিন্তার ভেতর পায়চারি করে উত্তর সন্ধান করছে শতদল।
আরও পড়ুনঃ Latest Bengali Jokes for Whatsapp
চুপ করে দাঁড়িয়ে কি ভাবতে থাকে শতদল, বােধহয় এতক্ষণে নিজের মনের অবস্থাটার ওপরেই রাগ করে একটু শক্ত হয়ে উঠেছে। এভাবে বিচলিত হওয়ার কোনাে অর্থ নেই। ওয়েটিং রুমের মধ্যে মাত্র একজন যাত্রীকে দেখে এভাবে পালিয়ে যাওয়ার অর্থ, একটা অর্থহীন, দুর্বলতার কাছে হার মেনে যাওয়া।
বয় বলে ফরমাইশ করুন হুজুর।
বেশ স্বচ্ছন্দভাবে শতদল দত্ত টেবিলের কাছে একটা চেয়ার টেনে বসে, স্বচ্ছন্দস্বরে বয়কে নির্দেশ দেয় চা নিয়ে এসাে।
আর ওদিকে, কাশ্মীরী পশমের আস্টার গা থেকে নামিয়ে মাধুরী রায় বেঞ্চের বিকালবেলাও ভয়ানক এক বিদ্রুপ করে দিয়ে চলে গেল। প্রতি রবিবারের মতাে সাজসজ্জা করে বেড়াতে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে বসেছিল মাধুরী, এই ঘরে। আর পাশের ঘরেই গভীর মনােযােগ দিয়ে চালুক্য স্টাইলের মন্দিরভিত্তির একটা স্কেচ আঁকছিল শতদল, বেড়াতে যাবার কথা একটি বারের জন্যও তার মনে হল না, কোনাে সাড়াও দিল না। জানালা দিয়ে বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়ে মাধুরীর শুধু মনে হয়েছিল, অস্তাচলের মেঘে এই ক্ষণিকের রক্তিমা নিতান্ত অর্থহীন, একটা অলক্ষুণে ইঙ্গিত, আর একটু পরেই তাে সব অন্ধকারে কালাে হয়ে যাবে। এই ছলনার খেলা আর না করে সূর্যটা যদি একটু তাড়াতাড়ি ডুবে যায়, তবেই ভালাে।
একে একে এইরকম আরও লক্ষণ দেখে দু’জনেই বুঝেছিল, ভালবাসা আর নেই। কিম্বা ভালবাসা ছিল না বলেই এই সব লক্ষণগুলি একে একে দেখা দিচ্ছিল। কে জানে কোন্টা সত্য! হয়তাে চেষ্টা করলে দু’জনেই জানতে পারতাে, হয়তে জেনেছিল, হয়তাে জানেনি। যাই হােক, জানা না জানার ব্যাপারে কেউ কাউকে দোষ দিতে পারে না। হয় দু’জনে জেনে-শুনেই চুপ করেছিল, কিম্বা দুজনে ইচ্ছে করেই জানতে চেষ্টা করেনি। এও হতে পারে, দু’জনেই নতুন করে আর গােপন করে কোনাে নতুন জনের ভালবাসায় পড়েছিল। তাই মিথ্যে হয়ে গেল ঘাটশিলার পুরাতন ফাল্গুন। কিম্বা সে ফাল্গুন নিজেই সৌরভহীন হয়ে গিয়েছিল, তারই বেদনা দু’জনকেই নিয়ে চলে গেল দুই দিকে। একজনকে একটি হেমন্তের সন্ধ্যায়, আর একজনকে একটি আষাঢ়ের পূর্ণিমায়। যা-ই হােক না কেন দু’জনের মনে সেজন্য আর কোনাে ক্ষোভ বা দুঃখ ছিল না। হয় দু’জনেই ভুল করেছে, নয় দু’জনেই ঠিক করেছে। কেউ কাউকে দোষ দিতে পারে না। কেউ কাউকে দোষ দেয়ওনি। ঘৃণা করেছিল, মার্জনা করতে পারেনি দু’জনেই দু’জনকে। কিন্তু মনে মনে। যেদিন এই মনের বিদ্রোহ মনের মধ্যে পুষে রাখা দুঃসহ হয়ে উঠলাে, সেদিন থেকেই সরে গেল দু’জনেই। কেউ কাউকে অবিযােগ আর অপবাদের আঘাত না দিয়ে ভদ্রভাবে আদালতে আবেদন করে সাত বছরের সম্পর্ক নিঃশেষে চুকিয়ে দিল। ছাড়াছাড়ি হবার পর, বছর দেড়েক যেতে না যেতেই শতদল শুনেছিল, মাধুরী বিয়ে করেছে অনাদি রায় নামে এক ইঞ্জিনিয়ারকে। মাধুরী খবরের কাগজে পড়েছিল, অধ্যাপক শতদল দত্ত আবার বিয়ে করেছে। নব জীবনসঙ্গিনীর নাম সুধাকণা, কলকাতারই একটা সেলাই স্কুলের টিচার।
এই নতুন দুটি বিয়েও নিশ্চয় দেখে-শুনে ভালবাসার বিয়ে। যে যাই বলুক, মাধুরী জানে, অনাদি রায়কে স্বামীরূপে পেয়ে সে সুখী হয়েছে। বাইরে থেকে না জেনে শুনে যে যতই আজে-বাজে মন্তব্য করুক না কেন, শতদলও জানে, সুধাকে পেয়ে সে সুখী হয়েছে।
তাই আজ রাজপুর জংশনের এই ওয়েটিং রুমে, এই শীতার্ত মাঝরাত্রির নিঃশব্দ মুহূর্তগুলির মধ্যে মাধুরী রায় আর শতদল দত্তের সম্পর্ক নিয়ে এসব প্রশ্ন আর গবেষণা নিতান্ত অবান্তর ও নিষ্প্রয়ােজন। সে ইতিহাস ভালাে ভাবেই শেষ করে দিয়ে ওরা দু’জনেই একেবারে ভিন্ন হয়ে গেছে, কোনাে সম্পর্ক নেই। অতীতের প্রশ্ন নয়, প্রশ্নটা ছিল বর্তমানের।
এমন করে একটা অযথা সময়ে পথের প্রতীক্ষা-ঘরে সেই দুটি জীবনেরই মুখােমুখি সান্নিধ্য দেখা দেয় কেন, যারা প্রতিদিন মুখােমুখি হবার অধিকার আদালতের সাহায্যে পাঁচ বছর আগেই নিয়ম-বহিভূর্ত করে দিয়েছে? এই আকস্মিক সাক্ষাৎ যেন একটা বিদ্রুপের ষড়যন্ত্র। যেমন অবৈধ, তেমনি দুঃসহ। ঘটনাটাকে তাই যেন মন থেকে কেউ ক্ষমা করতে পারে না, অথচ আপত্তি বা প্রতিবাদ করারও কোনাে যুক্তি নেই। মাধুরী না হয়ে আর শতদল না হয়ে, যদি অন্য কোনাে মহিলা যাত্রী ও পুরুষ যাত্রী এভাবে এই প্রতীক্ষাগৃহে আজ আশ্রয় নিত, এ ধরনের অস্বস্তি নিশ্চয় কারও হত না। বরং স্বাভাবিকভাবে দু-একটা সাধারণ সৌজন্যের ভাষায় দু’জনের পক্ষে আলাপ করাও সম্ভব হত, কিন্তু মাধুরী আর শতদল দত্ত, পরস্ত্রী আর পর-পুরুষ, কোনাে সম্পর্ক নেই, তবু মন ভরা সঙ্কোচ আর অস্বস্তি নিয়ে ওয়েটিং রুমের নিঃশব্দতার মধ্যে অসহায়ভাবে যেন বন্দী হয়ে বসে থাকে।
এই মৌনতার মধ্যে শতদল দত্তের ভারাক্রান্ত মন কখন যে ডুবে গিয়েছিল, তার একটু ক্লান্তিহরণ আরামে দুই চোখ বুজে গিয়েছিল, তা সে বুঝতে পারেনি। চোখ খুলে প্রথমেই বুঝতে পারে এটা ওয়েটিং রুম। একটু দূরেই বেঞ্চের ওপর বসে রয়েছে মাধুরী, দেয়ালের দিকে মুখ ঘুরিয়ে, কৌতূহলহীন এবং নিষ্পলক এক জোড়া চোখের দৃষ্টি।
শতদল কিন্তু মুখ ফিরিয়ে নিল না। তার দু-চোখে একটা লুকিয়ে দেখার কৌতূহল যেন চঞ্চল হয়ে ওঠে। কিন্তু কি এমন দেখবার আছে? আর, নতুন করেই বা দেখবার কি আছে?
আছে। এমন মেঘ রঙের ক্রেপেরা শাড়ী তাে কোনাে দিন পরেনি মাধুরী, এমন করে এত লম্বা আঁচলও মাধুরীকে কখনাে লুটিয়ে দিতে দেখেনি শতদল। বেড়াতে যাবার সময় মাধুরীকে অবশ্য পরতে হত তাঁতের শাড়ী, ঢাকাই বা অন্য কিছু চলতে গেলে যে শাড়ীর ভাঁজে ভাঁজে ফিফিস্ করে অদ্ভুত এক শব্দের সুর শিহরিত হয়। আঁচলে অবশ্যই মাখতে হত এক ফোটা হাসুনা-হানার আরক। এইভাবে সুর ও সৌরভ হয়ে শতদলের পাশে চলতে হত মাধুরীকে, নইলে শতদলের মন ভরতাে না। সেই সুর আর সৌরভের কোনাে অবশেষ আজ আর নেই। মাধুরী বসে আছে এক নতুন শিল্পীর রুচি দিয়ে গড়া মুর্তির মতাে, নতুন রঙে আর সাজে। এমন করে সন্তর্পণে অনধিকারীর অবৈধ লােভ নিয়ে এবং লুকিয়ে লুকিয়ে কোনােদিন মাধুরীকে দেখেনি শতদল। আজ দেখতে পায়, আর বুঝতে পারে, এ মূর্তি সে মূর্তি নয়। একেবারে নতুন, আর বেশ একটু কঠিন, ইঞ্জিনিয়ার অনাদি রায়ের স্ত্রী মাধুরী রায়। অবান্তর চিন্তা আর অস্বস্তি থেকে মুক্তি পায় শতদল। বেশ স্বচ্ছন্দভাবেই এবার নিজের প্রয়ােজনের দিকে মন দেয়। ছােট একটা চামড়ার বাক্স খুলে ভােয়ালে আর সাবান বের করে। হােল্ড-অল খুলে তার ভেতর থেকে একটা বালিশ আর চাদর বের করে অর্ধশয়ান লম্বা চেয়ারটার ওপর রাখে।
শতদলের দিকে তাকিয়ে দেখার কোনাে প্রয়ােজন ছিল না মাধুরীর। সে তাকিয়ে ছিল আয়নার প্রতিবিম্বিত শতদলের দিকে। ইচ্ছে করে নয়, আয়নাতে শতদলকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল, তাই। এবং ইচ্ছে না থাকলেও লুকিয়ে দেখার এই লােভটুকু সামলাতে পারেনি মাধুরী।
আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় মাধুরী, বেশ স্বচ্ছন্দভাবেই কাজ করছে শতদল। হাত ঘড়িটাকে খুলে নিয়ে একবার দম দিয়ে টেবিলের ওপর রাখে শতদল। মাধুরী বুঝতে পরে, এ ঘড়িটা সেই ঘড়ি নয়। ঘড়ির ব্যান্ডটাও কালাে চামড়ার, যে কালাে রঙ কোনােদিন পছন্দ করতাে না মাধুরী। এবং মধুরীর রুচির সম্মান রেখে শতদলও কোনােদিন কালাে ব্যান্ড পরতাে না। আরও চোখে পড়ে আংটিটা নতুন। বালিশের ঢাকার মধ্যেও বৈশিষ্ট্য আছে, রঙীন আর ফুল-তােলা। মাধুরীই তাে জানে, সাদা প্লেন আর মােলায়েম কাপড়ের ঢাকা ছাড়া এসব রঙ-চঙ আর কাজ-করা জিনিস কোনােদিন পছন্দ করতাে না শতদল। বুঝতে পারে মাধুরী, সেলাই স্কুলের টিচার সুধা ভালাে করেই সব বলে দিয়েছে। সাবান আর তােয়ালে নিয়ে স্নানের ঘরে চলে গেল শতদল। আয়নার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে এবার টেবিলের ওপরেই স্তুপীকৃত শতদলের সংসার সামগ্রীর দিকে তাকিয়ে দেখতে থকে মাধুরী। এতক্ষণে যেন প্রত্যক্ষভাবে তদন্ত করার একটা সুযােগ পাওয়া গেছে।
কিন্তু এমন কি বহুমূল্য নিদর্শন দেখার জন্য মাধুরীর দৃষ্টি টেবিলের ওপর স্তুপীকৃত জিনিসপত্রের মধ্যে তল্লাশি করে ফিরছে, তা বােধহয় সে নিজেই জানে না। অনেকক্ষণ ধরে, দৃষ্টি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সব কিছুই দেখলাে মাধুরী। সবই নতুন, পঁচ বছর আগের কোনাে স্মৃতির চিহ্ন নেই। এমন কৌতূহল না হওয়াই উচিত ছিল। এখন একবার আয়নার দিকে তাকালে দেখতে পেত মাধুরী, তুলির টানের মতাে আঁকা তার ভুরু দুটি যেন একটা ঈর্ষার স্পর্শে শিউরে সর্পিল হয়ে উঠেছে। কিন্তু আয়নার দিকে নয়, দৃষ্টি ছিল সােজাসুজি শতদলের জিনিসপত্রগুলির দিকে। তিন তিনটে বাক্স খােলা পড়ে রয়েছে, ঘড়ি, মনিব্যাগ ও চশমাটা টেবিলের ওপরেই, ছাই রঙের ফ্লানেলের জামাটা ব্র্যাকেটে দুলছে, সােনার বােতামগুলাে আলােয় চিকচিক করছে। নিঃসম্পর্কিত এক মহিলার সম্মুখে সব ফেলে রেখে চলে গেছে ভদ্রলােক। চুরি হয়ে যেতে পারে, সে ভয় নেই। ভদ্রলােকের এই বিশ্বাসটা যেমন অস্বাভাবিক, তেমনি অস্বাভাবিক মাধুরীর আচরণ। এত সতর্ক দৃষ্টি দিয়ে শতদলের জিনিসপত্র পাহারা দিতে তাে কেউ তাকে বলেনি। শতদল আবার ঘরে ঢুকতেই মাধুরী অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। হােক না দর্পণের প্রতিচ্ছায়া, একটু স্পষ্ট করেই এবার দেখতে পায় মাধুরী শতদল আগের চেয়ে অনেক রােগা হয়ে গেছে। সেলাই স্কুলের মাস্টারিনীর এদিকে বিশেষ কিছু যত্ন নেই বলেই মনে হয়। হােক না পাঁচ বছরের অদেখা, আজও দেখে বুঝতে পারে মাধুরী, খুব খিদে না পেলে শতদলের মুখটা ঠিক এরকম শুকনাে দেখাতাে না। মাধুরীর অনুমান মিথ্যে নয়। শতদল একটা টিফিন কেরিয়ার খুলে খাবারের বাটিগুলি বের করে টেবিলের ওপর রাখে। খেতে বসে। হাত তুলতে গিয়েই কি ভেবে হাত নামিয়ে নেয়। ঘরের কোণে রাখা জলের কুঁজোটার দিকে একটা গেলাস হাতে নিয়ে এগিয়ে যায়।
দৃশ্যটা মাধুরীর চোখে আঘাতের মতাে বেজে উঠবে, কল্পনা করতে পারেনি মাধুরী এবং তার জন্য প্রস্তুত ছিল না। হঠাৎ হয়ে গেল। আয়নার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে সােজা শতদলের দিকে হঠাৎ ক্ষুব্ধভাবে তাকায় মাধুরী। এই চকিত গ্রীবাভঙ্গি, মৃদু ভূকুটি আর চোখের কূপিত দৃষ্টি তার এতক্ষণের গম্ভীরতার চেয়ে বেশি স্বাভাবিক দেখায়।
মাধুরী বলে ওকি হচ্ছে?
আকস্মিক প্রশ্নে শতদল একটু চমকে উঠেই মাধুরীর দিকে তাকায়। মাধুরী আবার বলে একটা মুখের কথা বললে এমন ভয়ানক দোষের কিছু হত না। শতদলের গম্ভীর মুখ হঠাৎ সুস্মিত হয়ে ওঠে। হেসে হেসেই বলে না, দোষ আর কি?
মাধুরী উঠে দাঁড়ায় এবং এগিয়ে আসে। নিস্তব্দ ওয়েটিং রুমের দুঃসই মুহূর্তগুলির পেষণ থেকে যেন তার আত্মা এতক্ষণে মুক্তি পেয়েছে। শতদলের স্বচ্ছন্দ হাসির শব্দে মাধুরীর ক্লিষ্ট মনের গাম্ভীর্য ভেঙে যায়। শতদলের হাত থেকে গেলাসটা নিয়ে হাসিমুখেই তুমি বলাে।
এটা ওয়েটিং রুম। কর্ণওয়ালিস স্ট্রীটের বাড়ি নয়, আর মাধুরীর জন্মদিনের উৎসবও আজ নয়, যেদিন উৎসবের শােরগােল থেকে শতদলকে এমনই একটি ঘরের নিভৃতে নিয়ে গিয়ে সেই যে জীবনে-প্রথম নিজের হাতে খাবার পরিবেশন করে খাইয়েছিল মাধুরী।
কুঁজো থেকে জল ঢেলে নিয়ে গেলাসটা টেবিলের ওপর রেখে খাবারগুলাে একটা ডিশের মধ্যে সাজিয়ে দিতে থাকে মাধুরী। কাচের গেলাসে আর মাধুরীর হাতের চুড়িতে অসাবধানে সংঘাত লাগে, শব্দ হয়, পাঁচ বছর আগের নিস্তব্দ’অতীত সে নিকণে যেন চমকে জেগে ওঠে। দুই ট্রেনযাত্রী নয়, দেখে মনে হবে, ওরা এই সংসারেই দুটি সহ জীবনযাত্রী, আর সে জীবনযাত্রায় কোনাে খুঁত আছে বলে তাে মনে হয় না। মাধুরীর হাতের আঙুলগুলি দেখতে যদিও একটু রােগা রােগা হয়ে গেছে, কিন্তু খাবারগুলােকে বলে- সেই রকমই আলগােছে যেন চিমটি দিয়ে তােলে, সেই পুরনাে অভ্যাস। শতদলের পাশেই প্রায় গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে, নিস্তদ্ধ ঘরে মাধুরীর ছােট ছােট নিঃশ্বাসের শব্দ মাঝে মাঝে বেশ স্পষ্ট করেই শােনা যায়। আঁচলটা কাধ থেকে খসে গিয়ে শতদলের একটা হাতের ওপর লুটিয়ে পড়েছে। লক্ষ্য করে না মাধুরী। এমন বিসদৃশ বা অপার্থিব কিছু নয় যে লক্ষ্য করতেই হবে।
সবই দেখছি বাজারের তৈরি খাবার।
মাধুরীর কথার মধ্যে একটা আপত্তির আভাস ছিল যার অর্থ বুঝতে দেরি হয় না শতদলের। বাজারের তৈরি খাবারের বিরুদ্ধে, মাধুরীর মনে যে চিরন্তন বিদ্রোহ আছে, তা শতদলের অজানা নয়। তাই যেন দোষ স্থালনের মতােই সুরে সঙ্কুচিত ভাবে বলে–হ্যা, কাটিহার বাজারে ওগুলি কিনেছিলাম।
মাধুরী – যাচ্ছ কোথায় ?
শতদল – কলকাতায়।
মাধুরী তুমি কি এখন কলকাতাতেই…।
শতদল-হা তুমি ?
একথাগুলি না উঠলেই বােধহয় ভালাে ছিল। হাত কাঁপে, কাজের স্বাচ্ছন্দ্য হারায় মাধুরী। শতদলের প্রশ্নে যেন নিজের পরিচয় হঠাৎ মনে পড়ে গেছে মাধুরীর। কুণ্ঠিতভবে একটু তফাতে সরে গিয়ে মৃদুস্বরে মাধুরী উত্তর দেয়—রাজগীর। এই পর্যন্ত এসেই প্রসঙ্গ ফুরিয়ে যায়। আর প্রশ্ন করে জানবার মতাে কিছু নেই। একজন কলকাতা, আর একজন রাজগীর। দু’জন দুই ট্রেনযাত্রী মাত্র। আর এক ট্রেন নয়, এক লাইনের ট্রেনও নয়। তবু মনের ভুলে দু’জনে যেন বড়াে কাছাকাছি হয়ে গিয়েছিল। যা নিতান্ত অশােভন ও অসঙ্গত, তাই দিয়ে দু’জনে যেন কিছুক্ষণের মতাে বড় শােভন ও সঙ্গত হয়ে উঠেছিল।
হয়তাে কোনাে প্রসঙ্গ না পেয়েই শতদল বলে—তােমাকে তাহলে বােধ হয় পাটনার ট্রেন ধরতে হবে?
হ্যা। তুমি খেয়ে নাও।
এক নিঃশ্বাসে যেন জোর করে কোনােমতে কথাগুলি উচ্চারণ করেই মাধুরী সরে যায়। সত্যিই তাে, পাটনার ট্রেনেই তাকে চলে যেতে হবে, চিরকালের মতাে এখানে বসে থাকবার জন্য সে আসেনি। নিজের হাত ঘড়িটার দিকে সন্ত্রস্তভাবে তাকায় মাধুরী ; তারপর আবার আগের মতােই বেঞ্চের ওপর গিয়ে বসে থাকে।
আরও পড়ুনঃ গল্পঃ রহস্যময়ী
খাবারগুলাে শতদলের সম্মুখে সাজানাে, কাচের গেলাসের গায়ে বিদ্যুতের বাতিটার আলাে ঝঙ্কায় জলটাকে তরল আগুনের মতাে মনে হয়। আবার বােধহয় অপ্রস্তুত ও লজ্জিত হয়েছে শতদল। কিন্তু বড়াে শ্লেষ, বড়াে জ্বালা আছে এ লজ্জায়। সব জেনেশুনেও হঠাৎ লােভের ভুলে এক প্রহেলিকার মায়াকে কেন সত্য বলে বিশ্বাস করেছিল শতদল?
ছটফট করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় শতদল, চাদরটা গায়ে জড়িয়ে লম্বা চেয়ারের ওপর শুয়ে পড়ে সিগারেট ধরায়।
খাবার-খেতে পারলাে না শতদল। কিন্তু কেন? এ প্রশ্নের উত্তর আজ নিজের মনের মধ্যে খুঁজে পাওয়ার জন্য কোনাে চেষ্টাও করে না শতদল।
ওয়েটিং রুম আবার ওয়েটিং রুম হয়ে ওঠে। দুই সম্পর্কহীন অনাত্মীয়, ভিন্ন ভিন্ন ট্রেনের দুই যাত্রী প্রতীক্ষার মুহূর্ত গুনছে। কিন্তু ট্রেনও আসে না, তৃতীয় কোনাে যাত্রীও এসে এ ঘরে প্রবেশ করে না। আসে বয়, হাতে একটি ট্রে, তার ওপর চায়ের সরঞ্জাম সাজানাে। একটি টি-পট, একটি দুধের জার, একটি চিনির পাত্র, কিন্তু পেয়ালা দুটি। টেবিলের ওপর ট্রে-সমেত চায়ের সরঞ্জাম রেখে বয় চলে যায়। তৃষ্ণার্থ দৃষ্টি তুলে চায়ের পাত্রের দিকে একবার তাকায় শতদল, কিন্তু পরমুহূর্তে যেন একটা বাধা পেয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়।
ট্রের ওপর দুটি চায়ের পেয়ালা। কী ভয়ানক বিদ্রুপ! কোন্ বুদ্ধিতে বয়টা দুটি পেয়ালা দিয়ে গেল কে জানে? সে-রকম কোনাে নির্দেশ বয়কে তো দেয়নি শতদল। চা-খাওয়াও আর সম্ভব হল না।
সােজাসুজি তাকিয়ে না দেখুক, মাধুরী যেন মনের চোখ দিয়ে স্পষ্ট করেই দেখতে পাচ্ছে, খাবার স্পর্শ করছে না শতদল, চা-ও বােধহয় খাবে না। বয়টা এক নম্বরের মূর্খ, চা-টা যদি ঢেলে দিয়ে যেত, তবে ভদ্রলােক বােধহয় এরকম কুণ্ঠিত হয়ে বসে থাকতেন না। কিন্তু এত কুণ্ঠাই বা কেন? এ তাে আর মধুপুর নয়, সেজমামার বাসা নয়, আর সেই বড়ােদিনের ছুটির দিনটাও নয়।
বড়ােদিনের ছুটিতে মধুপুরে সেজমামার ওখানে বেড়াতে গিয়েছিল শতদল আর মাধুরী। প্রথম দিনেই দুর্ঘটনাটা ঘটেছিল, অনেকটা এই রকমই নিঃশব্দ প্রতিবাদের মতাে চা না খেয়ে সারা সকালটা বাগানের একটা ঝাউগাছের নিচে চেয়ার টেনে বসে রইল শতদল। প্রতিবাদের কারণ, বাড়িতে এত লোক থাকতে, আর সবার ওপর মাধুরী থাকতেও শতদলকে চা দিয়ে গেল বাড়ির চাকর! রহস্যটা যখন ধরা পড়লাে, বাড়িসুদ্ধ লােক লজ্জায় অপ্রস্তুত হয়ে গেল। সবচেয়ে বেশি বকুনি খেল মাধুরী। মামীমা বকলেন, সেজমামা বকলেন, এমন কি অল্পভাষী বড়দাও বললেন—যখন জানিস যে, তুই নিজের হাতে চা না এনে দিলে শতদল অসন্তুষ্ট হয়, তখন…।
কিন্তু এটা ওয়েটিং রুম, সেজমামার বাসা নয়। অভিমানী স্বামীর মতাে এমন মুখ ঘুরিয়ে এভাবে পড়ে থাকা আজ আর শতদলকে একটুও মানায় না।
কিন্তু কী আশ্চর্য, এই বিসদৃশ অভিমানের আবেদন ওয়েটিং রুমের অন্তর যেন স্পর্শ করে। রঙ্গমঞ্চের একটি নাট্যর দৃশ্যের মতাে কৃত্রিম হয়েও ঘটনাটা সত্যি সত্যি মান-অভিমানের দাবি নিয়েই যেন প্রাণময় হয়ে ওঠে। মাধুরীকে এখানে ধমক দিয়ে কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দেবার কেউ নেই, তবু নিজের মনের গভীরেই কান পেতে শুনতে পায়, কেউ যেন তাকে কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।
খাবার খাচ্ছ না কেন?
বড়াে কোমল ও মৃদু অনুনয়ের সুর ছিল মাধুরীর কথায়।
শতদল শান্তভাবেই উত্তর দেয় না, এত রাত্রে এসব আর খাব না। তবে শুধু চা খাও।
হ্যা, চা অবশ্য খেতে পারি।…তুমি খাবে না?
মাধুরীর মুখে হাসির ছায়া পড়ে।আমার কি চা খাবার কথা ছিল?
শতদল লজ্জিতভাবে হাসে তা অবশ্য ছিল না। কিন্তু বয়টা যখন ভুল করে দুটো পেয়ালা দিয়েই গেছে, তখন…।
তখন এক পেয়ালা চা আমার খাওয়াই উচিত, এই তাে?
মাধুরীর কথার মধ্যে কোনাে সঙ্কোচ বা জড়তা ছিল না। হেসে হেসেই কথাগুলি বলতে পারে মাধুরী।
শতদল বলে আমি তাে তাই মনে করি বয়টার আর কি দোষ বলাে?
মাধুরী না, বয়কে আর দোষ দিয়ে লাভ কি?
দু’জনেই ক্ষণিকের মতাে গম্ভীর হয়। সত্যিই তাে, বয়কে দোষ দিয়ে লাভ নেই। মাধুরীর কথাগুলির মধ্যে কেমন একটা আক্ষেপের সুর যেন মিশে আছে। বােধহয় বলতে চায় মাধুরী, বয়টার দোষ হবে কেন, দোষ অদৃষ্টের, নইলে আজ পাঁচ বছর পরে এমন একটা বিশ্রী রাত্রিতে একটা ওয়েটিং রুমের চক্রান্তে পড়ে কেন এভাবে অপ্রস্তুত হতে হবে?
হয় আর চুপ করে বসে থাকার শক্তি ছিল না, নয় ইচ্ছে করেই এই ওয়েটিং রুমের চক্রান্তে আত্মসমর্পণ করতে চায় মাধুরী। উঠে দাঁড়ায়, টেবিলের কাছে এগিয়ে আসে, চা তৈরি করে সেই হাতে, সেই নিপুণতা দিয়ে, স্বচ্ছন্দে ও সাগ্রহে। শতদলও ওঠে, একটা চেয়ার তুলে নিয়ে এসে টেবিলের কাছে নিজের চেয়ারের পাশে রাখে। মাধুরীর দিকে তাকিয়ে বলে বােস।
মাধুরী আপত্তি করে না। আপত্তি করার মতাে জেদগুলিকে আর মনের মধ্যে খুঁজে পায় না। রাজপুর জংশনের ওয়েটিং রুম দুই অনাত্মীয় নরনারীর মনের ভুলে ধীরে ধীরে দম্পতির নিভৃত তীড়ের মতাে আবেগময় হয়ে উঠছে বুঝতে পারলেও কেউ আর ঘটনাকে বাধা দিতে চায় না। শতদলের পাশের চেয়ারে বসে পড়ে মাধুরী। চায়ে চুমুক দিয়েই একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে শতদল। শুধু চায়ের আস্বাদ পেয়ে নিশ্চয় নয়, চায়ের সঙ্গে মাধুরীর হাতের স্পর্শ মিশেছে, তৃষ্ণা মিটে যাবারই কথা। শতদল হাসিমুখে বলে—তােমার গম্ভীর ভাব দেখে সত্যিই এতক্ষণ বড়াে অস্বস্তি হচ্ছিল।
মাধুরীও হাসে-তােমার তাে অস্বস্তি হচ্ছিল, কিন্তু আমার যা হচ্ছিল তা আমিই জানি। শতদল ভয় করছিল বুঝি?
মাধবী মাথা হেট করে-হ্যা।
শতদল ছি! ভয় করবার কি আছে?
হাসতে হাসতে আলাপটা শুরু হয়েও শেষদিকে কথাগুলি কেমন এক করুণতার ভাবে বিনমিত হয়ে ওঠে। মাধুরীর কথাগুলি বেদনাময় স্বীকৃতির মতাে, শতদলের কথায় আশ্বাসের নিবিড়তা। সে অতীত, অতীত হয়েই গেছে, আজ আর ভয় করবার কি আছে
মানুষ মরে যাবার পর যেমন তার বিষয় মমতা দিয়ে বিচার করা সহজ হয়ে ওঠে, আর ভুলগুলি ভুলে গিয়ে গুণগুলিকে বড়াে করে ভাবতে ইচ্ছে করে, শতদল আর মাধুরী বােধহয় তেমনি করেই আজ তাদের মৃত অতীতকে মমতা দিয়ে বিচার করতে পারছে। অতীতের সেই ভয় ঘৃণা ও সংশয়ের ইতিহাস যেন নিজেরই জ্বালায় ভস্ম হয়ে সংসারের বাতাসে হারিয়ে গেছে চিরতরে। আজ শুধু মনে হয়, সেই অতীত যেন সাত বছরের একটি রাত্রির আকাশ, তার মধ্যে ফুটে উঠেছিল ছােটবড়াে কত তারা, কত মধুর ও স্নিগ্ধ তার আভা। সে আকাশ একেবারে হারিয়ে গেছে, ভাবতে কষ্ট হয়, বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না, ফিরে পেতে ইচ্ছে করে বৈকি।
শতদলের মুখের দিকে তাকিয়ে মাধুরী বলে তুমি অনেক রােগা হয়ে গেছ। শতদল কী বিশ্রী রকমের সরু সরু হয়ে গেছে।
মাধুরী লজ্জিতভাবে হাসে, আঁচলের আড়ালে হাত টা লুকিয়ে ফেলতে চায়। কিন্তু। শতদল যেন এক দুঃসহ লােভের ভুলে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে মাধুরীর হাতটা টেনে নিয়ে দু-হাত দিয়ে চেপে ধরে। মাধুরী আপত্তি করে না।
এ বড়াে অদ্ভুত! সাত বছরের যে জীবনকুঞ্জ একেবারে বাতিল হয়ে গেছে, আজ এতদিন পরে দেখা যায় বাতিল হয়ে গেছে তার কাঁটাগুলি, বাতিল হয়নি তার ছায়া। একটা অজানা সত্য যেন আর হঠাৎ আবিষ্কার করে ফেলেছে শতদল। মাধুরীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, তােমার মুখটি কিন্তু সেই রকমই আছে মাধুরী, একটুও বদলায়নি।
বদলে গেছে সব, শুধু সেই মুখটি বদলায়নি। বাতিল হয়ে গেছে সব, শুধু সেই ভালবাসার মুখটি বাতিল হয়ে যায়নি। এও কি সম্ভব? চোখের ছলনা, নয় কল্পনার বিভ্রম।
সব ছলনা ও বিভ্রমকে মিথ্যে করে দিয়ে মাধুরীর সারা মুখে নিবিড় এক লজ্জায় ছায়া রক্তাভ হয়ে ওঠে। প্রথম ভালবাসার সম্ভাষণে চঞলিতচিত অনুঢ়া মেয়ের মুখের মতাে নয়, বাসর কক্ষে প্রথমা পরিচিতা ব্রীড়াবনত বধূর মুকের মতাে নয়, দীর্ঘ অদর্শনের পর স্বামীর সম্মুখে সমাদর ধন্য নারীর মুখের মতােই।
প্রণয় কুঞ্জ নয়, বাসর কক্ষ নয়, দম্পতির গৃহনিভৃত নয়, রাজপুর জংশনের ওয়েটিং রুম। তবু শতদল আর মাধুরী, দুই ট্রেনযাত্রী বসেছিল পাশাপাশি যেন এইভাবেই তারা চিরকালের সংসারে সহযাত্রী হয়ে আছে। কোনােদিন বিচ্ছিন্ন হয়নি। চা খাওয়া শেষ হয়। মাধুরী জিজ্ঞাসা করে–কাকাবাবু এখন কোথায় আছেন?
শতদল তিনি দেরাদুনে বাড়ি করেছেন এবং সেখানেই আছেন।
মাধুরী-পুঁটি ?
শতদল-পুঁটির বিয়ে হয়ে গেছে, সেই রমেশের সঙ্গে। দিল্লী সেক্রেটারিয়েটে ভালােই একটা চাকরি পেয়েছে রমেশ।
মাধুরীর হাতটা বড়াে শক্ত করে ধরেছিল শতদল। পাঁচ বছর অতীতের এক পলাতক মায়াকে অনেক সন্ধানের পর এতদিনে কাছে পেয়েছে। দু-হাত দিয়ে ধরে রেখেছে তার একটি হাত, যেন আবার হারিয়ে না যায়।
তুমি বিশ্বাস করাে, মাধুরী ?
কি?
তােমাকে আমি ভুলিনি, ভুলতে পারা যায় না।
বিশ্বাস না করার কি আছে, চোখেই দেখতে পাচ্ছি।
কিন্তু তুমি ?
কি?
তুমি ভুলতে পেরেছ আমাকে?
দু-চোখ বন্ধ করে মাধুরী, যেন চারিদিকের বাস্তব সংসারের লােকচক্ষুগুলিকে অন্ধ করে দিয়ে উত্তর দেবার জন্য প্রস্তুত হয়। মাথাটা শতদলের বুকের কাছে একটু ঝুকে পড়ে, দু-চোখের কোণে ছােট ছােট মুক্ত কণিকার মতাে দুটি সজলতার বিন্দু জেগে ওঠে। দু-হাতে জড়িয়ে মাধুরীর মাথাটা বুকের ওপর টেনে নেয় শতদল বলতেই হবে মাধুরী, আমি না শুনে ছাড়ব না।
হঠাৎ ছটফট করে উঠল মাধুরী, যেন একটা আগুনের জ্বালা হঠাৎ দু-হাতে জড়িয়ে ধরেছে। শতদলের হাত ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়। বাইরে শীতার্ত রাত্রির স্তব্ধতা চমকে দিয়ে প্রবল শব্দে লােহার ঘণ্টা বাজছিল ঝনঝন করে। ঘরের ভেতর আয়নাটাও কাপছিল। যেন দুটি জীবনের এই দুঃসাহসের ব্যভিচার সইতে না পেয়ে ওয়েটিং রুমটাই আর্তনাদ করে উঠেছে। ধুলিয়ান আপ প্যাসেঞ্জার এসে পড়েছে, ছুটোছুটির সাড়া পড়ে গেছে প্ল্যাটফর্মের ওপর।
এই ট্রেনেই তাে ওর আসবার কথা!
উদভ্রান্তের মতাে কথাগুলি বলতে বলতে দরজার দিকে ছুটে যায় মাধুরী। তৃতীয় যাত্রী এসে ওয়েটিং রুমে প্রবেশ করে। মাধুরীকে দেখতে পেয়েই তার সারা মুখ আনন্দে দীপ্ত হয়ে ওঠে, যেন এই অমাবৃত রাত্রির পথে এক নিঃসঙ্গ পথিক এতক্ষণ পরে পান্থশালার আলােক দেখতে পেয়েছে, মাধুরী রায়ের স্বামী অনাদি রায়। মাধুরীর মুখও পুলকিত হয়ে উঠেছে দেখা যায়, কিন্তু তখনাে যেন একটু বিষন্নতার স্পর্শ লেগেছিল, ক্লান্ত প্রদীপের আলােকে যেমন একটু ধোঁয়ার ভাব থাকে। অনাদি রায় কিন্তু তাতেই বিচলিত হয়ে ওঠেন। মাধুরীর কাছে এগিয়ে এসে ব্যস্তভাবে প্রশ্ন করেন—শরীর-টরীর ভালাে বােধ করছ তাে।
হ্যা, ভালােই আছি।
অনেকক্ষণ ধরে একা একা বসে থাকতে হয়েছে, না?
হ্যা।
কি করবাে বলাে? ট্রেনগুলাে যে রকম বেটাইমে চলছে, নইলে দু-ঘণ্টা আগেই পৌঁছে যেতাম।
অনাদি রায় উৎসাহের সঙ্গে একটা বেডিং খুলতে আরম্ভ করলেন। মাধুরী আপত্তি করে–থাক, ওসব খােলামেলা করে লাভ নেই।
তুমি একটু শুয়ে নাও মাধুরী, রেস্ট পেলে শরীর ভালাে বােধ করবে। থাক, আর কতক্ষণই বা।
অনাদি রায় কিন্তু নিরুৎসাহিত হলেন না। বাক্স খুলে একটা মির্জাপুরী আলােয়ান বের করলেন। দু-ভাঁজ করে নিজের হাতেই আলােয়ানটা মাধুরীর গায়ে পরিপাটি করে জড়িয়ে দিলেন।
এতক্ষণে চেয়ারের ওপর স্থির হয়ে বসে দেখছিল শতদল। একটা প্রহসনের দৃশ্য, নির্মম ও অশােভন। কিন্তু বেশিক্ষণ স্থির হয়ে বসে থাকা আর সম্ভব হল না। একবার ব্যস্ত হয়ে উঠে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে বাইরে উঁকি দিয়ে দেখে। ফিরে এসে জিনিসপত্রগুলি একবার অকারণ টানাটানি করে। যেন একটা শাস্তির কারাগারে বন্দী হয়ে শতদলের অন্তরাত্মা ছটফট করছে। পৃথিবী হাতড়ে একটু সুস্থির হবার মতাে ঠাই অথবা পালিয়ে যাবার পথ খুঁজতে থাকে শতদল।
দৃশ্যটা সত্যিই সহ্য হয় না। মির্জাপুরী আলােয়ান যেন মাধুরীর পথশ্রমক্লান্ত আত্মাকে শত অনুরাগে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। অনাদি রায় নামে এই সজ্জন, কী গরবে গরীয়ান হয়ে বসে আছেন হাসিমুখে। আর ঐ মাধুরী, যেন পৌরাণিক কিংবদন্তীর এক নারী, স্বয়ংবরার অভিনয় মাত্র করে, কিন্তু বরমাল্য দান করে তারি গলায় যে তাকে লুঠ করে রথে তুলে নিয়ে চলে যেতে পারে। এক ভগ্নবাহু প্রতিদ্বন্দ্বীর মতাে সকল পরাভবের দীনতা নিয়ে অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকে শতদল। সহ্য করতে কষ্ট হয়। চলে গেলেই তাে হয়, কেন বসে বসে এত জ্বালা সহ্য করে শতদল?
যেতে পারে না একটি লােভের জন্য। মাধুরীর কাছ থেকে সেই প্রশ্নের উত্তরটা শুনে যাবার লােভ। মাধুরী তাকে ভুলতে পারেনি, মাত্র এইটুকু সত্য মাধুরীর মুখ থেকে শুনে যেতে পারলেই জয়ীর আনন্দ নিয়ে চলে যেতে পারবে শতদল।
কিন্তু ইহজীবনে এই উত্তর শুনে যাবার আর সুযােগ হবে কিনা সন্দেহ। অনাদি রায় ঘড়ি দেখলেন, বােধহয় ট্রেনের টাইম হয়ে এসেছে। মাধুরী তার আলস্টার তুলে নিয়ে গায়ে দিল। কুলিও পৌঁছে গেল, পার্টনার ট্রেন আসছে।
স্বামীর পাশেই দাঁড়িয়েছিল মাধুরী। কুলিরা চটপট জিনিসপত্রগুলি মাথায় চাপিয়ে দাঁড়াল। রাজপুর জংশনের ওয়েটিং রুমকে শূন্য করে দিয়ে ওরা এখনই চলে যাবে। শতদলের মনে হয়, মাধুরী যেন যাবার আগে এক জতুগৃহের গায়ে আগুনের জ্বালা লাগিয়ে দিয়ে সরে পড়ছে।
সাত বছরের আকাশ কি নিতান্ত মিথ্যা? তাকে কি ভুলতে পারা যায় ? ছিন্ন করে দিলেই কি ভিন্ন করা যায়। এ প্রশ্নের উত্তর আর দিয়ে যাবে না মাধুরী, উত্তর দেবার আর কোনাে সুযােগও নেই।
কোনাে দিকে না তাকিয়ে শুধু স্বামীর সঙ্গে হাসতে হাসতে এই ঘরের দুয়ার পার হয়ে চলে গেলেই ভালাে ছিল, কিন্তু ঠিক সেভাবে চলে যেতে পারল না মাধুরী। কুলিরা চলে গেল, অনাদি রায়ও চলে গেলেন, কিন্তু দরজার কাছ পর্যন্ত এসেই মাধুরী যেন চরম অন্তর্ধানের আগে এই জতুগৃহের জন্যই একটা অলীক মমতার টানে একবার। দাঁড়ায়। মুখ ফিরিয়ে শতদলের দিকে তাকায়। হাসিমুখেই বিদায় চায় যাই। শতদল হাসতে চেষ্টা করেও পারল না। অনেকগুলি অভিমান আর দাবি একসঙ্গে এলােমেলাে ভাবে তার কথায় ফুটে উঠতে চাইছিল। কিন্তু এত কথা বলার সময় আর কই? শুধু সেই একটি প্রশ্নের উত্তর শুনে চরম জানা জেনে নিতে চায় শতদল। যাচ্ছ, কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তার তাে দিয়ে গেলে না, মাধুরী। হাসি মুছে যায়, বিস্মিতভাবেই তাকিয়ে মাধুরী প্রশ্ন করে কিসের প্রশ্ন ? শতদল বলে সত্যি, ভুলে গেছ?
উত্তর দেয় না মাধুরী। ভুলেই গেছে বােধহয়। সাত বছরের ইতিহাস ভুলতে পরেনি যে মাধুরী, সাত মিনিট আগের কথা, সে কি ভুলে গেল? এরই মধ্যে বিশ্ব-সংসারের নিয়মগুলি কি এমনিই উল্টে গেল যে, সব ভুলে যেতে হবে! বুঝতে পারে না শতদল। মাধুরী বলে যাই, দেরি হয়ে যাচ্ছে।
শতদলের সব কৌতূহলের লােভ যেন একটা রূঢ় আঘাতে ভেঙে যায়। এতক্ষণে মনে পড়ে, মাধুরীর যে একটি পরম গন্তব্য আছে, আর দেরি করতে পারে না। সাত বছর দেরি করিয়ে দিয়েছে শতদল, এখন আর এক মুহূর্তও মাধুরীকে দেরি করিয়ে দেবার কোনাে অধিকার নেই।
শতদল বিমর্ষভাবে বলে বুঝছি, তুমি উত্তর দেবে না।
মাধুরী শান্তভাবেই বলে উত্তর দেওয়া উচিত নয়।
শতদল-কেন?
মাধুরী-বড়াে অন্যায় প্রশ্ন।
বুঝেছি! ছটফট করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় শতদল। তার অন্তরাত্মাই যেন কিসের মােহে অবুঝ হয়ে আছে, যার জন্যে বারবার শুধু বুঝতে হচ্ছে। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে শতদল এক নিঃশ্বাসে এবং একটু রূঢ়ভাবেই বলে-যাও, কিন্তু এরকম একটা তামাসা করে যাবার কোনাে দরকার ছিল না।
আরও পড়ুনঃ গল্পঃ আদিম
বড়াে তিক্ত শতদলের কথাগুলি। মুহূর্তের মধ্যে মাধুরীর মুখটাও কঠিন হয়ে ওঠে, ভূকুঞ্চিত হয়। চুপ করে কি যেন ভেবে নেয়। কিন্তু পরমুহূর্তে আগের মতােই আবার হাস্যময় হয়ে ওঠে। বােধহয় সেই অলীক মমতার টানেই এই জতুগৃহকে যাবার আগে জ্বালিয়ে দিয়ে নয়, একটু বুঝিয়ে দিয়ে আর হাসিয়ে দিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হয় মাধুরী। হাতঘড়ির দিকে একবার চকিতে তাকিয়ে নিয়ে মাধুরী বলে একবার সুধাকে নিয়ে রাজগীরে বেড়াতে এসাে।
শতাদল অপ্রস্তুতভাবে তাকায় তারপর?
তারপর তােমরা দু’জনে যেদিন বিদায় নেবে, আমি এসে ট্রেনে তুলে দিয়ে যাব। -কেন?
আমাকে একটা তামাসা দেখাবার সুযােগ তােমরাও পাবে, এইমাত্র। তাতে তােমার লাভ?
মাধুরী হেসে ফেলে লাভ কিছু নয়, তােমার মতােই হয়তাে এই রকম মিছিমিছি রাগ করে কতগুলি বাজে কথা বলব।
মাত্র কয়েকটি মুহূর্তে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে শতদল। তারপরেই বলে ওঠে বুঝলাম।
কথাটা বেশ জোরে উচ্চারণ করে, এবং সঙ্গে সঙ্গে হাসতে থাকে শতদল। এই বাজে কথার অভিমান আর দাবিগুলি যেন নিজের স্বরূপ চিনতে পেরে অট্টহাস্য করৈ উঠছে। এতক্ষণে সত্যিই বুঝতে পেরেছে শতদল।
হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখতে থাকে এবং দরজার দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারে শতদল, মাধুরী চলে গেছে।
জতুগৃহে আর আগুনের স্ফুলিঙ্গ লাগল না, লাগল উচ্চহাসির প্রতিধ্বনি। রাজপুর জংশনের যেন সুপ্তি ভেঙে গেল। আরেকটি আগন্তুক ট্রেনের সঙ্কেত ধ্বনিও বাজে। কলকাতার ট্রেনও এসে পড়েছে। এদিকের প্ল্যাটফর্মে নয়, উলটো দিকে। কুলির মাথায় জিনিসপত্র চাপিয়ে শতদল দত্তও ব্যস্তভাবে চলে যায়।
দু-দিকের ট্রেন দু-দিকে চলে যাবে। রাজপুর জংশনের শেষরাত্রি ক্ষণিক কলরবের পর নীরব হয়ে যাবে। এরই মধ্যে এক প্রতীক্ষা-গৃহের নিভৃতে দুই ট্রেনযাত্রীর সম্পর্কের ইতিহাস নিয়ে কী যে পরীক্ষা হয়ে গেল, তার সাক্ষ্য আর কিছু থাকবে না। কিন্তু এখন আছে, যদিও দেখে কিছু বােঝা যায় না। ওয়েটিং রুমের টেবিলের ওপর একটি ট্রে, তার ওপর পাশাপাশি দুটি শূন্য চায়ের পেয়ালা। কোথা থেকে কারা দু’জন এসে আর পাশাপাশি বসে তাদের তৃষ্ণা মিটিয়ে চলে গেছে। রাজপুর জংশন আবার ঘুমিয়ে পড়ার আগেই বয় এসে তুলে নিয়ে যাবে, ধুয়ে মুছে সাজিয়ে রেখে দেবে, একটা পেয়ালা কাবার্ডের এই দিকে, আর একটা হয়তাে একেবারে ঐদিকে।
(সমাপ্ত)