Bangla Sad Love Story in Bangla Font | Valobashar Golpo

WhatsApp Channel Follow Now
Telegram Group Follow Now

Last updated on July 4th, 2023 at 12:50 am

Rate this post
আজকের bangla sad love story টির নাম – “মণি” গল্পের প্রধান চরিত্রে মণি, বিষয় – অসম্পূর্ণ ভালোবাসা, bengali love story এবং valobashar golpo আর bangla premer golpo অথবা bangla love sms কিংবা bengali love quotes অথবা bangla jokes আরও পাওয়ার জন্য আমাদের ব্লগ টিকে সাবস্ক্রাইব করে আমাদের সাথে থাকুন, গল্পটি পড়িয়া যদি আপনার ভালো লাগিয়া থাকে তাহলে অবশ্যই কমেন্ট এবং শেয়ার করিতে ভুলিবেন না। 

bangla sad love story

Sad Love story in Bengali – বেদনাদায়ক প্রেমের গল্প

আজকের গল্প – মণি 

কাব্যের উপেক্ষিতায় ভারতের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বিশ্বের কবিগুরু বাল্মীকির বিরুদ্ধে অনুযােগ করেছেন, তিনি তাঁর কাব্যে উর্মিলার প্রতি অবিচার করেছেন। তবে সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও বলেছেন, রসসৃষ্টিতে তাবৎ-নায়িকাকে সমান সম্মান, সমান অধিকার দেওয়া সম্ভবপর নয়। তবু তাে উর্মিলার উল্লেখ রামায়ণে আছে। কিন্তু রামচন্দ্র আর সীতাদেবীর কি আরও বহু অনুচর সখা বান্ধবী পরিচারিকা ছিলেন না, যাঁদের উল্লেখ আদিকবি আদপেই করেন নি? 

তাঁদের জীবনে সুখ-দুঃখ উৎসব-ব্যসন বিরহ-বেদনা মিলনানন্দ সবকিছুই ছিল। এতৎসত্ত্বেও আদিকবি তাঁদের নাম পর্যন্ত উল্লেখ করেন নি। তিনি তাে কিছু নিছক কাল্পনিক চরিত্র সৃষ্টি করেন নি, নির্ভেজাল রূপকথাতে যে-রকম হয়। তিনি তাে লিখেছিলেন ইতিহাস, অবশ্য রসের গামলায় চুবিয়ে নিয়ে, বাটিক প্রক্রিয়ায়। হলই বা। তাই বলে কি শেষমেশ ওইসব আভাগাদের জ্যান্ত পোঁতা হল না? জানি নে, আদিকবিকে এ ফরিয়াদ জানালে তিনি কী উত্তর দিতেন। 




যে চন্দ্ৰবৈদ্য শ্রীরামচন্দ্রের নখ-চুল কেটে দিল, যে শুক্লবৈদ্য মা-জননী জনক তনয়ার দুকূল-কাচুলি কেচে দিত তারা যদি কবিসমীপে নিবেদন করত, তাদেরই বা তিনি ভুলে গেলেন কেন? উর্মিলার মত নিদেন তাদের নামােল্লেখ করলেই তাে তারা আজ অমর হয়ে যেত, তবে তিনি কী উত্তর দিতেন ? অত দূরে যাই কেন। কবিগুরু শ্রী রবীন্দ্রনাথকে যদি জিজ্ঞেস করা হত, বিনয় এবং ললিতার মত দুটি অত্যুত্তর চরিত্র সৃষ্টি করার পর হায়, বাংলার সচ্চরিত্র কী দুর্লভ তিনি সে-দুজনকে পথমধ্যে গুমখুন করলেন কেন, তা হলে তিনি কী উত্তর দিতেন? আমি বাল্মীকি নই, রবীন্দ্রনাথও নই। এমন কি আমার গ্রামের প্রধান লেখক নই। আমার গ্রামের শুকুরুল্ল এবং পাগলা মাধাই যে-সব ভাটিয়ালি রচে গিয়েছে, আমার রচনা তাদের সামনে লজ্জায় ঘােমটা টানে। 

মাধাইয়ের একটি ভাটিয়ালির ভুলে-যাওয়া অন্তরা আমি তিরিশ বছর ধরে চেষ্টা করেও পূরণ করতে পারি নি। মাধাই আমি একই পাঠশালাতে একই শ্রেণীতে পড়েছি। মাধাই ফি বছর ফেল মারত, আমি ফাষ্ট হতুম। তাই, বিশেষ করে তাই, আমি মােক্ষম মনঃস্থির করেছি, আমি আমার সৃজনে যাদের প্রতি অনিচ্ছায় অবজ্ঞা প্রকাশ করেছি, তাদের প্রত্যেককে জ্যান্ত গাের থেকে খুঁড়ে তুলে প্রাণবন্ত করব। অর্থাৎ অর্ধমৃত করব। কারণ, আমি শক্তিমান লেখক নই। অদ্যাবধি বর্ণিত আমার তাবৎ চরিত্রই জীবন্মৃত। অতএব এরাও অমৃত না হয়ে আমৃত হবেন। কিন্তু আমি তাে নিষ্কৃতি পাব আমার জন্মপাপ থেকে। 

আমি কাবুলে ছিলাম, তখন সেখানকার ব্রিটিশ লিগেশনের সঙ্গে আমার কণামাত্র হৃদ্যতা হয়নি। দেশে-বিদেশে যারা পড়েছেন তারা সে-কথা হয়তাে স্মরণ করতে পারবেন। তবে লিগেশনের একজন প্রধান কর্মচারীর সঙ্গে আমার অত্যন্ত হার্দিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ইনি পেশাওয়ারের খানদানী বাসিন্দা। অতিশয় খাস পাঠান। এর চতুর্দশ পুরুষের কেউ কখনও আপন গােষ্ঠীর বাইরে বিয়ে-শাদি করেন নি। পেশাওয়ারের পুলিশ ইন্সপেক্টর আহমদ আলীর অগ্রজ। নাম শেখ মহবুব আলী। ব্রিটিশ লিগেশনে তিনি ছিলেন ওরিয়েন্টাল সেক্রেটারি। এর মত বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ কূটনৈতিক আমি অষ্টকুলাচল সপ্তসমুদ্র পরিক্রম করেও দেখতে পাই নি। 




আমার বিশ্বাস পাঠান-প্রকৃতি ধরে। কথাটা মিথ্যা নয়। কিন্তু এইসব সরল পাঠানদের যাঁরা সর্দার হন, যেমন মনে করুন ইল্লাইয়ের ফকীর, ইংরেজীতে বলে ফকির অব ইপি (Ipi), তাদের মত ধুরন্ধর ইহ সংসারে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। শেখ মহবুর আলীই বলতেন, ‘পাঠানরা হয় গাড়ল, নয় ঘড়েল। মাঝখানে কিছু নেই। পিগমিজ অ্যাণ্ড জাইন্টস, নাে নমেলস্। অধ্যাপক বগদান এবং বেনওয়ার সঙ্গে তার প্রচুর হৃদ্যতা ছিল। বগদানফ গত হয়েছেন। বেনওয়া আছেন, সৃষ্টিকর্তা তাকে শতায়ু দিন, তাকে জিজ্ঞেস করলেই মহবুব আলীর বুদ্ধিমত্তা সম্বন্ধে সত্যাসত্য জানতে পারবেন। মহবুব আলী বিলক্ষণ জানতেন, লিগেশনের ইংরেজ কর্তাদের সঙ্গে আমার অহি-নকুল সম্পর্ক। ওদিকে তিনি যদিও ইংরেজের সেবা করতেন, তবু ভিতরে ভিতরে ওদের তিনি দিলজান দিয়ে করতেন ঘেন্না, ঘৃণা’ নয় ঘেন্না। 

এটা অবশ্য আমার নিছক অনুমান। 
মহবুব আলীর মত ঝাড়ু চাণক্য বাক্য বা আচরণে সেটা প্রকাশ করবেন, সে-চিন্তাও বরাহভক্ষণসম মহাপাপ। বােধ হয় প্রধানত এই কারণেই তিনি আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। তদুপরি আমি আহমদ আলীর বন্ধু। এবং সর্বশেষ সত্য, আমি বহুদূরদেশাগত রােগাপটকা, নির্বান্ধব, দুনিয়াদারি বাবদে-বেকুব বাঙালী। 
এমত অবস্থায় আপনি ভগবানের স্মরণ না নিয়ে পাঠানের শরণ নিয়েই বিবেচকের কর্ম করবেন। তবে এ-কথাও বলব, আমি তার স্মরণ নিই নি। তিনিই আমাকে অনুজরূপে তার হৃদয়ে গ্রহণ করেছিলেন। 

সে-কথা থাক্। আমি আজ তার জীবনী লিখতে বসি নি। আমি লিখতে বসেছি তার স্ত্রীর পরিচারিকা সম্বন্ধে। উল্লিসিত পাঠক বিরক্ত হয়ে আমার বাকী লেখাটুকু পড়বেন না, সে-কথা আমি জানি; কিন্তু তার চেয়েও মােক্ষম জানি, আমি যে গুণীজনের মজলিসে দৈবেসৈবে মুখ খােলার অনুমতি পাই, তাদের পৌনে ষোল আনা সহৃদয় সদাশয় জন। তাদের অকৃপণ হৃদয় জন্মদাসী রাজরানী সবাইকে আসন দিতে জানে। আমার সঙ্গে মহবুব আলীর হৃদ্যতা হওয়ার কয়েকদিন পর আমার ভৃত্য এবং সখা আবদুর রহমান আমাকে যা জানালে তার সারাংশ এই: মহবুব আলীর পরিবার এবং অন্য এক পরিবারের দুশমনী-লড়াই ক্ষান্ত দেবার জন্য একদা স্থিরীকৃত হয়, দুই পরিবার যেন বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হয়। 




মহবুব আলী এ পরিবারের বড় ছেলে। তাই তাকেই বিয়ে করতে হল অন্য পরিবারের বড় মেয়েকে। নবদম্পত্তি গােড়ার দিকে সুখেই ছিলেন। ইতিমধ্যে বলা নেই–কওয়া নেই, হঠাৎ মহবুব আলীর এক অতি দূর চাচাতাে ভাই তাঁর শ্বশুর-পরিবারের ততােধিক দুর এক মামাতাে ভাইকে খুন করে। ফলে মহবুব আলীর স্ত্রী পিতৃগণের আদেশা-নুযায়ী স্বামীগৃহ বর্জন করে পিত্রালয়ে চলে যান। আবদুর রহমানের কাহিনী অনুযায়ী এ-ঘটনা ঘটেছিল বছর দশেক পূর্বে। বলতে গেলে এই অবধি মহবুব আলী অকৃতদার।

আরও পড়ুনঃ গল্পঃ মধুরেন 

 অধুনা অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। তিনি শীঘ্রই হিন্দুস্থান থেকে বিয়ে করে অন্য বিবি নিয়ে আসছেন। সুহৃদ সম্বন্ধে তার অপরােক্ষ আলােচনা করা অসঙ্গত, তা সে ভৃত্যের সঙ্গেই হােক আর পিতৃব্যের সঙ্গেই হােক এই আমার বিশ্বাস। কিন্তু আবদুর রহমান যখন একবার কথা বলতে আরম্ভ করে তখন তাকে ঠেকানাে অসাধ্য ব্যাপার। শেষটায় আমি বিরক্ত হয়ে বলেছিলুম, তােমারই বা এসব বলার কী দরকার? আমারই বা জেনে কী হবে? তিনি তাে আমাকে এসব কিছু বলেন নি? আবদুর রহমান বললে, তিনি কেন বলেন নি সে-কথা আমি কী করে জানব? (পরে মহবুব আলীর কাছে শুনেছিলাম, দুঃখের কথা নাকি বন্ধু বান্ধবকে বলে না) তবে আপনার তাে জানা উচিত। 

আলােচনা এখানেই সমাপ্ত হয়। তবে রাত্রে আমার গায়ে লেপকম্বল জড়িয়ে দেবার সময় আবদুর রহমান বলেছিল, ‘শেখ মহবুব আলী খান বড় ভালাে লােক। আবদুর রহমান সার্টিফিকেট দেবার সময় রবীন্দ্রনাথের পদাঙ্ক অনুসরণ করে না। এ-কথা বলে রাখা ভালাে। শেষ মহবুব আলীর বাসাতে আমি সময় পেলেই যেতুম। তার বাসাটি লিগেশনের প্রত্যন্ত প্রদেশে অবস্থিত ছিল বলে ইংরেজের ছায়া না মাড়িয়ে সেখানে পৌঁছানাে যেত। তিনি দফতরে থাকলে তার ছেলেবেলাকার বন্ধু এবং চাকর গফুর খান তাকে খবর দিতে যেত। আমি ততক্ষণে ড্রইংরুমে বসে আগুন পােয়াতুম আর বাবুর্চিকে সবিস্তর বয়ান দিতুম কোন্ কোন্ বস্তু খাওয়া আমার বাসনা। 

শেখ গফুর ফিরে এসেই আমার পায়ের কাছে বসে ভাঙা ভাঙা উর্দু ফাসী পাঞ্জাবী পশতুতে মিশিয়ে গল্প জুড়ে দিত। পাঠানদের ভিতর জাতিভেদ নেই। শেখ গফুর আর মহবুব আলী খান প্রভূ-ভৃত্য হলেও তাদের সম্পর্ক ছিল সখ্যের। তাই গফুর আমার সঙ্গে গল্প করাটা তার কর্তব্য বলে মনে করত; আমি ‘ভদ্রসন্তান’; আর সঙ্গে গল্প করে যে তাকে ‘আপ্যায়িত করছি সে-কথা তাকে বললে সে নিশ্চয়ই আশ্চর্য হত। আব্দুর রহমান এবং গফুরের সৌহার্দ্য ছিল, সে-কথা বলা বাহুল্য। সচরাচর মহবুব আলীর ড্রইং-রুম খােলাই থাকত। আবদুর রহমান রচিত মহবুব আলীর ‘পারিবারিক প্রবন্ধ’ শােনার কয়েকদিন পর তার বাড়িতে গিয়ে ড্রইংরুমের দরজায় ধাক্কা দিয়ে দেখি, সেটা ভিতর থেকে বন্ধ। দরজার হ্যান্ডেলের কাছে তখন দেখি বিজলির বােতাম, কলিং বেল। 




একটুখানি আশ্চর্য হয়ে ভাবুন, মহবুব আলী আবার কবে থেকে পর্দানশিন হলেন, তাঁর গৃহে মাতা নেই, অপ্রিয়বাদিনী ভার্যা নেই, তার গৃহ তাে অরণ্যসম। অরণ্যকে ছিটকিনি দিয়ে বন্ধ করার কাকস্য প্রয়ােজন? দিলুম বােতাম টিপে, সঙ্গে সঙ্গে ডাকলুম, ‘ভাই গফুর। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দরজা খুলে গেল। ভেবেছিলুম দেখব গাট্টাগােট্টা গাল-কম্বল দাড়ি সম্বলিত বেঁটে কেলে গফুর মহদ খান। দেখি, হকচকিয়ে গেলুম, দেখি, দীর্ঘ এবং তন্বী একটি মেয়ে পরনে লম্বা লিশওয়ার আর হাঁটু পর্যন্ত নেবে-আসা কুর্তা। ওড়না দিয়ে মাথার অর্ধেক অবধি ঘােমটা। শ্যামা এবং সে অতি মধুর শ্যামবর্ণ। পেশওয়ার কাবুলে মানুষের রঙ হয় ফরসা, কিংবা রােদে-পােড়া বাদামী। এ-মেয়ের রঙ সেই শ্যাম, যেটি পর্দানশিন বাঙালী মেয়ের হয়। তার কী তুলনা আছে? বলতে সময় লাগল। 

কিন্তু প্রথম দিন তাকে দেখেছিলুম এক লহমার তরে। আমি তাকে ভাল করে দেখবার পূর্বেই সে দিয়েছিল ভিতরপানে ছুট। তখন লক্ষ্য করেছিলুম, সেই আধ লহমার তরে, গরুগামিনী রমণীর যে যে স্থলে বিধাতা সৌন্দর্য পুঞ্জীভূত করে দেন তথ্বীঙ্গীর ক্ষীণ দেহে তার কিছুমাত্র কার্পণ্য করেন নি; বরঞ্চ বলব, তিনি অজন্তার চিত্রকরের মত একটু যেন বাড়াবাড়ি করেছেন। অথচ বয়স পনের-ষোল হয় কি না হয়। তবে কি বিধাতা মানুষের আঁকা ছবি দেখে তার সৃষ্টির সৌন্দর্য বাড়ান! তা সে যাক গে। তখন কি আর অত করে খুঁটিয়ে দেখেছিলুম না, ওই বিষয়ে চিন্তাই। করেছিলুম। আমি আগুনের কাছে গিয়ে বসলুম। 

খানিকক্ষণ পরে মহবুব আলী এলেন। পাশে বসে ডাক দিলেন, ‘ম-অ-অ-ণি- মণি দোরের আড়ালে দাঁড়ালে দুজনাতে পঙ্গু ভাষায় কথাবার্তা হল। আমি তার এক বর্ণও বুঝতে পারলুম না। মহবুব আলী আমাকে বললেন, ‘মােটা রান্না এখনও বাবুর্চিই করে কিন্তু মণির হাতে তৈরী নাশতা না হলে আমার বিবির চলে না। মণি বললে, আপনি কী খেতে ভালবাসেন সে ইতিমধ্যে জেনে নিয়েছে এবং তৈরী করছে। ভালই হল। ও বড় তেজী মেয়ে। যাকে অপছন্দ করে তার রুটিতে হয়তাে সেঁকো বিষ দেবে।’ দাবা খেলতে বসলুম এবং যথারীতি হারলুম। খেলার মাঝখানে মণি এসে অন্য টেবিলে নাশতা সাজলে। সময় নিয়েছে বটে, কিন্তু বেঁধেছে ভাল। মামলেটের রঙটি সর্বাঙ্গে হলদে। এখানে বাদামী, সেখানে হলদে, ওখানে সাদা নয়। তে-কোণা পরােটাও তৈরি করেছে যেন টিস্কয়ার সেটস্কয়ার দিয়ে। ভিতরে ভাঁজে ভাঁজে কোন জায়গায় কাঁচাও নয়।




খাওয়া শেষ হলে আমি বললুম, ‘আধ ঘণ্টা বসে যাই। সেঁকো বিষ দিয়েছে কি তার ফলাফল দেখে যাই।” মণি দাঁড়িয়ে ছিল। সে মহবুব আলীর মুখের দিকে তাকাল। তিনি পশতুতে অনুবাদ করলেন। মণি ‘যাঃ’ কিংবা ওই ধরনের কিছু একটা বলে চলে গেল। ভবিষ্যৎ দেখতে পেলে তখন ওই কঁচা রসিকতাটুকুও করতাম না। ইতিমধ্যে মহবুব আলী আমার বাড়িতে একবার এসেছিলেন বলে আমি তার বাড়ি, গেলুম দিন পনেরাে পরে। এবারের বাইরের বােতামে চাপ দেওয়া মাত্রেই হুট করে দরজা খুলে গেল। মণি আমাকে দেখে নিঃসঙ্কোচে পশতু ভাষায় কিচির-মিচির করে উঠল। কিছুতেই থামতে চায় না। আমি একবার সামান্য সুযােগ পেয়ে বললুম, পশতু’ তারপর বাঁ হাত উপরের দিকে তুলে ভারতনাট্যম কায়দায় পদ্মফুল ফোটাবার মুদ্রা দেখিয়ে বােঝবার চেষ্টা করলুম, ‘ডডনং। অর্থাৎ আমি পশতু বুঝিনে। 

কিন্তু কে বা শোনে কার কথা! ভারতনাট্যমে আমি যদি হই খুচরাে কারবারী। মণির বেসাতি দেখলুম পাইকিরী লাটের। ডান হাত দিয়ে এক অদৃশ্য ঝাঁটা নিয়ে আকাশের বেশ খানিকটা ঝাঁট দেবার মুদ্রা দেখিয়ে বুঝিয়ে দিলে, কুছ পরওয়া নহী। কিন্তু শুধু মুদ্রা দিয়ে তাে আর বেশীক্ষণ কথাবার্তা চালানাে যায় না। তা হলে মানুষ ভাষার সৃষ্টি না করে শুধু নেচে কুদে ও মুদ্রা দেখিয়েই শঙ্করদর্শনের আলােচনা চালাত, একে অন্যকে এটম বম্ বানাবার কৌশল শেখাত। ইতিমধ্যে গফুর এসে আমার পায়ের কাছে কার্পেটের উপর বসে জানালে মহবুব আলী শহরে গেছেন, ফিরতে দেরি হবে। তবে পই পই করে বলে গিয়েছেন, আমাকে যেন আটকে রাখা হয়। 

মণি ততক্ষণে রান্নাঘরে চলে গিয়েছে। গফুর তার মনিবের সঙ্গে যেরকম ভােলা-দিলে গল্প জমায়, আমার সামনে সেই ভাবেই উজির-নাজির কতল করতে আরম্ভ করল। আসল কথা-পাশকথা বলে সে শুধালে, ‘মণিকে আপনার কী রকম লাগে? আল্লা জানেন, মৌলা আলীর দোহাই, আমি স্লোব নই। দাসী পরিচারিকা সম্বন্ধে আন্তরিকতার সঙ্গে আলােচনা করতে আমার কণামাত্র আপত্তি নেই। আমার সেবক আবদুর রহমানের সঙ্গে আমার যে-ভাবের আদান-প্রদান রস-রসিকতা চলত, সে-রকম ধারা আমি বহু ‘শিক্ষিত’ ‘খানদান’ লােকের সঙ্গে করতে রাজী নই। কিন্তু এখানে তাে ব্যাপারটা অতখানি সরল নয়। 

তাই একটু বিরক্তির সুরে বললুম, ‘আমার লাগা না-লাগার কী আছে? গফুর আমার উত্তর শুনে হতবুদ্ধি হয়ে গেল। খানিকক্ষণ পরে সামলে নিয়ে বললে, “এ আপনি কী বলছেন! আপনি শেখ মহবুব আলীর দোস্ত। তাঁর ইষ্টকুটুম, গােষ্ঠী পরিবারের পাঠান-পখতুনের চেয়ে আপনাকে উনি ঢের ঢের বেশী ভালবাসেন। আর আপনি যেভাবে কথা বললেন, তাতে মনে হল ওঁর পরিবারের জন্য আপনার যেন কোন দরদ নেই। আজ যদি মণির বিয়ের সম্বন্ধ আসে তবে কি মহবুব আলী আপনার সঙ্গে ওই বাবদে শলাপরামর্শ না নিয়ে থাকতে পারবেন?

আরও পড়ুনঃ গল্পঃ রোমান্স 

আমি শুধালুম, এসেছে নাকি?’ সঙ্গে সঙ্গে মনে মনে বললুম, থুড়ি, ভুল করলুম, এতখানি ঔৎসুক্য দেখানাে উচিত হয় নি। শাদির পয়লা রাতে বেড়াল মারবে’, এ যে সেরা রাত খতম হবার উপক্ৰম ! আমার ভাবান্তর লক্ষ্য না করেই গফুর সােৎসাহে বললে, ‘গণ্ডায় গণ্ডায়। সুবে পেশওয়ার-কোহট, বন্ন দেরা-ইসমাইল খান, ইস্তেক জম্মু-জলন্ধর অবধি। লিগেশনের সব কটা পাঠান চাপরাধী-দফতরী, কেরানী খাজাঞ্জী মণিকে শাদি করতে চায়। আমি জানতুম, পাঠানদের আপন গােষ্ঠীর ভিতর জাতবিচার নেই। কিন্তু সেটা ছিল থিয়ােরেটিকল জানা, এখন দেখলুম সেটা কীরকম মারাত্মক প্র্যাকটিকল। লিগেশনের খাজা মেলের লােকও পরিচারিকা মণিকে বিয়ে করতে চায়। 

ইতিমধ্যে মণি দু-তিনবার ঘরে এসে অগ্নিবাণ হেনে গফুরের দিকে তাকিয়েছে। ভাষা না জেনেই বুঝতে পেরেছে, ওর সম্বন্ধেই কথাবার্তা হয়েছে। আমি গতিক সুবিধের নয় দেখে বললুম, “থাক্ থাক্। মণি আমার জন্য এক অজানা পেশাওয়ারী কাবাব বানিয়েছে। ভারীমােলায়েম। দেখে মনে হয় কাঁচা, কিন্তু হাত দিয়ে মুখের কাছে তুলতে না তুলতেই ঝর ঝর করে ঝরে পড়ে। আমি আগের থেকেই হাঁ করে ছিলুম; মুখে কিছু পোঁছল না দেখে মণি খিলখিল করে হেসে উঠল। ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে ভিতরের দরজা দিয়ে অন্তর্ধান মহবুব আলী এলেন। দাবার ফাঁকে বললেন, ‘মণিকে নিয়ে বড় বিপদে পড়েছি। আমি বললুম, ‘কিস্তি সামলান। ঘােড়া উঠে, নৌকা ঘােড়ার ডবল কিস্তি। 

মহবুব আলী বললেন, ‘মণিকে নিয়ে বড় বিপদে পড়েছি। আমি বললুম, হ্যা, আমিও বিপদে পড়েছি। আবদুর রহমান বলছিল, এখন থেকে সবাইকে রাস্তায় দেরেশী পরে বেরুতে হবে। দর্জির দোকানে ভিড় লেগেছে। কী করি, ততক্ষণে খেলা শেষ হয়ে গিয়েছে। 
আমি যথারীতি হেরে গিয়েছি। পূর্বেই বলেছি, মহবুব আলী চাণক্যস্য চাণক্য। তাই এটাও জানেন, কখন সাফসুফা খােলাখুলি কথা কইতে হয়। বললেন, ‘মণিকে বিয়ে করার জন্য সব কটা পাঠান আমার দোরে ধন্না দিচ্ছে। ওদিকে মণি বলে, সে কাউকে বিয়ে করচে চায় না। 
কেন? 
আমার বিবি বললেন, সে নাকি–
আমি অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললুম, বাস, বাস্।
মহবুব আলী আমার উস্মার জন্য তৈরী ছিলেন। 

আমার দুখানা হাত ধরে বললেন, “দোস্ত, আমি জানি, এটা সম্পূর্ণ অসম্ভব। আপনি সৈয়দ-বংশের ছেলে। আপনারা পাঠান-মােগলে বিয়ে শাদি করেন না। যদিও কুরান হদিসের রায়, যে-কোনও মুসলমান যে-কোনও মুসলমানীকে বিয়ে করতে পারে। হক কথা। কিন্তু লােকাচার দেশাচারও আছে। সেগুলাে মানতে হয়। আজ যদি আপনি আমার বােন কিংবা শালীকে বিয়ে করে দেশে ফেরেন তবে আমি কোনও রকম দুশ্চিন্তা করব না। কিন্তু মণিকে বােঝাই কী করে, আপনার সঙ্গে তার বিয়ে সম্পূর্ণ অসম্ভব। সে ছেলেবেলা থেকে দেখেছে। যে-কোনও মেয়ের সঙ্গে যে-কোনও ছেলের বিয়ে হয়। তা যে শুধু পাঠানদের ভিতরেই, সে কী করে জানবে বলুন? 

বাইরের সংসারে যে অন্য ব্যবস্থা, কী করে বুঝবে বলুন? আমি আরও বিরক্ত হয়ে বললুম আঃ! কী এক স্টর্ম-ইন-এ টি-পট! তিলকে তাল! আপনার বাড়ির মেয়ে কাকে বিয়ে করতে চায়, না করতে চায়, তাতে আমার কী? মহবুব শান্ত কণ্ঠে বললেন, হ্যা, আপনার তাতে কী? আবদুর রহমানের উপদেশ স্মরণ এল। বললুম, না, না, আপনি আমাকে এতখানি হৃদয়হীন মনে করবেন না। কিন্তু ভেবে দেখুন, আমাকে যেখানে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে এবং যেস্থলে আমার হাতে কোনও সমাধান নেই, সেখানে আমি উপদেশই বা দিই কী প্রকারে? কাবুলে এপিডেমিক সর্দিকাশি দেখা দিল। ঝাড়া দশ দিন ঘরে বন্ধ থাকতে হল। সেরে উঠে শুনি, মহবুব আলী আমার চেয়েও বে-এক্তেয়ার। 

ভেবেছিলুম কিছুদিন ও-পাড়া মাড়াব না। তবু যেতে হল। এবারে মণি দরজা খুলেই যা পশতুর তুবড়ি বাজি, বিডবিশপ ফ চালালে, তার সামনে আমি একদম হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম। কুমারী পার্বতী কাম্য পতিনিন্দা শুনে ন যযৌ ন তথ্বেী হয়েছিলেন, আমি উলটো অবস্থায়। ফল কিন্তু একই। লক্ষ্য করলুম, মণিকে ভয়ঙ্কর রাগী দেখাচ্ছে। ফার্সীতে শুধালুম, ‘সর্দি হয়েছে। নাকি?’ মণি এক বর্ণ ফার্সী বােঝে না। খলখল করে হেসে বাড়ির ভিতর চলে গেল। মহবুব এলেন লাঠিতে ভর করে। ঠাণ্ডা দেশের সর্দি, যাবার বেলা মানুষকে অর্ধমৃত করে দিয়ে যায়। বিশেষ করে যাদের চর্বি নিয়ে কারবার। আমি জানতুম ওই কথাই উঠবে, যদিও আশা করেছিলুম, নাও উঠতে পারে। মণির বেশ উত্তেজনা থেকে অবশ্য আমেজ বলেছিলুম, আরও কিছু একটা হয়েছে।

বললেন, ‘ওই যে আমাদের ছােকরা চাপরাসী মাহমুদ জান, রাসকেল না ইডিয়েট কী বলব। সে-ই ঘটিয়েছে কাণ্ডখানা। আপনি যখন দিন সাতেক এলেন না, তখন ওই মাহমুদ মনিকে একটা খাসা আরব্য উপন্যাস শােনালে। রাসকেলটা গল্প বানাতে আন্ত পাঠান। সে মণিকে বললে, “বাদশা আনাউল্লা খান সৈয়দ সায়েবকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, এদেশে বিয়ে না করে দামড়ার মত ঘুরে বেড়ানাে অত্যন্ত অনুচিত। লােকনিন্দা হয়, বিশেষ করে আপনি যখন শিক্ষক। তারপর সৈয়দ সায়েবের হাত ধরে তাকে নিয়ে গেলেন তার মেয়ে ইস্কুলে। সেখানে দু’শাে মেয়েকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে হুকুম দিলেন, বেছে নাও। সৈয়দ সাহেব আর কী করেন! শাহানবাদশার হুকুম। না মানলে গর্দান আর মেয়েগুলােই বা কি কম খাপসুরত! 

সৈয়দ সায়েব বিয়ে করে মশগুল। তাই এদিক আসার ফুরসৎ তার আর কই? আমি জীবনে ওই আকবারই গীতাবর্ণিত নিষ্কম্প প্রদীপ-শিখাবৎ ! মহবুব আলী বললেন, ‘মণি তাে চিৎকার করে কান্নাকাটি জুড়ে দিল। তারপর শয্যা নিল, এই ড্রইংরুমের দরজার গােড়ায়। একটানা রােজার উপবাস। রাত্রেও খায় না আমিও শুধালুম, ‘মণি বিশ্বাস করলে ওই গাঁজাখুরি। ‘কেন করবে না? মণি মাঝে মাঝে মােটরে করে আমার বিবির সঙ্গে শহরে যায়। পথে পড়ে মেয়ে ইস্কুল। দেখেছে, মেয়েগুলাের বরফের মত ফরসা রঙ। বেদানার মত ট্যাবাট্যাব লাল গাল, ধনুকের মত ভুরু- আমি বললুম, “থাক্ থাক্। আপনাকে আর কবিত্ব করতে হবে না। 

কিন্তু আমি তাে পছন্দ করি শ্যামবর্ণ- এইবারে মহবুব আলীর মুখে ফুটল মধুর হাসি। নাকরা-গলা আবদেরে-আবদেরে সুরে বললেন, ‘তা হলে মণিকে ডেকে সেই সুসমাচার শুনিয়ে দি এবং ওটাও কি যে, আপনি মণিকে কাবুলী মেয়েদের চেয়ে বেশী খাপসুরত বলে মনে করেন? আমি তাে রেগে টঙ। চিৎকার করে বললুম, বলুন, বলুন, বিশ্বসুদ্ধকে বলুন। আমার কী আপত্তি? মণি যখন বিশ্বাস করে আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে, তখন তাে আপনার বড় সমস্যা সমাধান হয়ে গিয়েছে। মহবুব আলী হাসলেন, আরও মধুর হাসি। আমার গা জ্বলে গেল। আমিয় ছানিয়া বললেন, ‘ওই তাে আপনার ভুল। তাই যদি হত তবে আপনাকে দেখা মাত্রই মণি হাসির বন্যা জাগাল কেন? চিৎকার করে তখন কী বলেছে, শুনেছেন? না, আপনি পশতু বােঝেন না। বলেছে ওঁর হাতে মেহদীর দাগ নেই, উনি বিয়ে করেন নি?”

আমি চুপ। শেষটায় কাতর কণ্ঠে শুধালুম, ‘মেহদীর দাগ ছাড়া কি কখনও বিয়ে হয় না? মহবুব আলী বললেন, ‘বোঝান গিয়ে মণিকে। আপনাকে কতবার বলেছি, ও পাঠান মেয়ে ও বােঝে পাঠানদের কায়দাকানুন। ও শ্বাসপ্রশ্বাস নেয় পাঠান জগতে। বিশ্বভুবনের খবরও রাখে না। আমি শুধালুম, ‘আপনাকে গতবারে দেখেছিলুম, এ-ব্যাপার নিয়ে অত্যন্ত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। সেটা হঠাৎ কেটে গেল কী প্রকারে? আমার তাে মনে হচ্ছে জিনিসটে আরও বেশী প্যাঁচালাে হয়ে যাচ্ছে। তিনি বললেন, ‘পাঠান-মেয়েরা সচরাচর বাপ-চাচার আদেশমত নাক কান বুজে বিয়ে করে। কিন্তু হঠাৎ কখনও যদি পাঠান মেয়ে কাউকে ভালবেসে ফেলে তখন সে আগুনে হাত না দেওয়াই ভাল। ব্যাপারটার গুরুত্ব গােড়ার দিকে আমি বুঝতে পারি নি। তাই তার একটা সমাধান খুঁজেছিলুম। এখন নিরাশ হয়ে অভয় মেনে বসে আছি। আমি আর কি বলব! অত্যন্ত চিন্তিত মনে বাড়ি ফিরলুম। সমস্যার ফয়সালা করে দিল বাচ্চায়ে সকাও কাবুল আক্রমণ করে। 


আমি থাকি শহরের মাঝখানে, ব্রিটিশ লিগেশন শহরের বাইরে মাইল দেড়েক দূরে। বাচ্চা এসেছে। সেদিক থেকেই এবং থানা গেড়েছে লিগেশন আর শহরের মাঝখানে। লিগেশন আর শহর একে অন্য থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। সেখানে যাওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। কয়েকদিন পরে বাচ্চা হটে গেল। 
তখন ব্রিটিশ প্লেন এসে বিদেশী মেয়েদের পেশাওয়ার নিয়ে যেতে লাগল। খবর পেয়ে ছুটে গেলুম আমার বন্ধু মৌলনা জিয়াউদ্দীনের স্ত্রীর জন্য একটা সীট যােগাড় করতে। মহবুব আলীর কলিংবেল টেপা মাত্রই এবারে দরজা খুলল না। তখন হ্যাণ্ডেল। ঘােরাতেই দরজা খুলে গেল। খানিকক্ষণ পর মহবুব আলী এলেন। মুখ বিষগ্ন। কোন ভূমিকা না দিয়েই বললেন, ‘কাবুল নিরাপদ স্থান নয় বলে লিগেশনের সব মেয়েদের পেশওয়ারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। 

আমার স্ত্রী চলে গিয়েছেন। মণিও গেছে। আমি বলতে চাইলুম, ‘ভালই হল, কিন্তু বলতে পারলুম না। তারপর বললেন, আপনাকে বলে কি হবে, তবু বলি। যে কদিন শহর লিগেশন থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল সে কদিন এখানে অনেক রকম গুজব পৌছত, কেউ বলত কাবুলে লুঠতরাজ আরম্ভ হয়ে গেছে, কেউ বলত বিদেশীদের সব খুন করে ফেলা হয়েছে। আর মণি ছুটোছুটি করেছে, এ-চাপরাসী থেকে ও-চাপরাসীর কাছে এ-আরদালীর কাছ থেকে ও-আরদালীর কাছে। টাকা দিয়ে লােভ পর্যন্ত দেখিয়েছে, আপনার কুশল সংবাদ নিয়ে আসবার জন্যে। আমি চুপ। ‘তারপর যখন জানতে পারলে তাকেও আমার স্ত্রীর সঙ্গে পেশওয়ার চলে যেতে হবে তখন এক বিপর্যয় কাণ্ড করে তুললে।

কান্নাকাটি জুড়ে দিয়ে বললে, সে কিছুতেই দেশে ফিরে যাবে না। এক রকম গায়ের জোরে তাকে প্লেনে তুলে দিতে হল।” আমি কিছু বলি নি। একদিন কাবুলে অনেক কষ্ট সওয়ার পর খবর পেলুম, অ্যারােপ্লেনে জিয়াউদ্দীন ও আমার জন্য জায়গা হয়েছে। আগের রাত্রে মহবুব আলী আমাকে গুডজার্নি বাঁভইয়াজ জানাতে এলেন। বিদায়ের সময় আমাকে একটা মােটা খাম দিয়ে বললেন, আপনি পেশওয়ারে পৌঁছে আমার শ্বশুর বাড়ি গিয়ে মণিকে খবর দেবেন। মণি এলে তার হাতে খামটা দিয়ে বলবেন- এটা মহবুব আলীর স্ত্রীর হাতে দিয়াে। আমি বললুম, ‘আমি তাে পশতু বলতে পারি নে। তিনি কটি কথা উর্দু হরফে লিখে বার তিনেক আমাকে দিয়ে পড়িয়ে নিলেন। অ্যারােপ্লেনে বসে পরের দিন অনেক চিন্তা করেছিলুম। কী চিন্তা করেছিলুম, সে কথা দয়া করে জিজ্ঞাসা করবেন না। 

পেশওয়ার পোঁছেই, গেলুম মহবুব আলীর শ্বশুরবাড়ি। বৈঠকখানায় ঢুকে দেখি, দুই বৃদ্ধ মুরুব্বী স্থানীয় লােক বসে আছেন। আমি মহবুব আলীর কুশল সংবাদ জানিয়ে তাদের অনুরােধ জানালুম, মণিকে একটু খবর দিতে। ভদ্রলােকেরা একটু চমকে উঠলেন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই সামলে নিয়ে বললেন, ‘খবর দিচ্ছি। এঁরা চমকে উঠলেন কেন? তবে কি এ-বাড়ির মেয়েরা বৈঠকখানায় আসে না? তাহলে মহবুব আলীর সেটা বােঝা উচিত ছিল। মণি এল। আমাকে দেখে অন্দরের দোরের গােড়ায় স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়াল। মুখে কথা নেই। মুরুব্বীদের দিকে একবার তাকালে। তারা তখন অন্য দিকে ঘাড় ফিরিয়ে নিয়েছেন। মণি মৃদু কণ্ঠে একটি শব্দ শােধলে, ‘সলামত?’ কথাটা ফার্সী! হয়তাে পশতুতেও চলে! অর্থ ‘কুশল ?
আমি ঘাড় নাড়িয়ে বললুম, হ্যা।

তারপর তার কাছে গিয়ে খামটা দিয়ে সেই শেখা বুলিতে পশতুতে বললুম, এটা মহবুব আলীর স্ত্রীর হাতে দিয়াে। মণির মুখ খুশিতে ভরে উঠল। যা বলল সে-ভাষা না জেনেও বুঝতে পারলুম, সে বলছে, ‘পশতু তা হলে শিখেছেন? আমি দুঃখ দেখিয়ে ঘাড় নেড়ে ‘না’ জানালুম। মণি ভিতরে চলে গেল। আমি উঠি উঠি করছিলুম এমন সময় চাকর এসে বললে কিছু খেয়ে যেতে। পাঠানের বাড়িতে না খেয়ে চলে যাওয়া বড় বেয়াদবি। মণি টেবিলে খাবার সাজিয়ে দোরের আড়ালে দাঁড়াল। একটা কথা বলল না। বাড়ি থেকে বেরবার সময় একবার পিছনের দিকে তাকালুম, মণিকে শেষ সেলাম জানাবার জন্য। কোথাও পেলুম না। টাঙ্গাতে উঠে উলটো দিকে মুখ করে বসতেই নজরে গেল দোতলার বারান্দার দিকে। দেখি মণি দাঁড়িয়ে মাথায় ওড়না নেই। আর দু’চোখ দিয়ে অঝােরে জল ঝরছে, লম্বা লম্বা ধারা বয়ে। টাঙ্গ মােড় নিল। সে রাত্রে দেশের ট্রেন ধরলুম।
   
   (সমাপ্ত)

Leave a Comment

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now