ভয়ংকর ভুতের গল্প (Bhayankar Bhuter Golpo) আমরা ছেলেবেলা থেকে শুনছি কত জনের কত রকমের কাহিনি, কারো শোনা কথা আবার কারও-বা নিজের চোখে দেখা। কেউ অপঘাতে মরেছে তারপর ভূত হয়ে দেখা দিয়েছে, গয়ায় পিণ্ডদানের পর আর দেখা যায়নি। কেউ-বা খুন হয়েছে, তারপর হত্যাকারী ফাঁসিতে না ঝোলা পর্যন্ত তার বার বার আবির্ভাব ঘটেছে। কোথাও-বা অতর্কিতে প্রেতাত্মা কারও স্কন্ধে ভর করে অনেক গোপন কথা প্রকাশ করে দিচ্ছে। এমনি কত একক ভূতের কাহিনি। আবার দলবদ্ধ ভূতের আবির্ভাবের কথাও আছে।
বাংলা লোকসাহিত্যে ভূত একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পুরাতন এবং নতুন উভয় বাংলা রূপকথায় প্রায়ই ভূতের ধারনা ব্যবহার করা হয়। আধুনিক বাংলা সাহিত্যেও প্রায়ই ভূতের উদাহরণ পাওয়া যায়। বিশ্বাস করা হয়, ভূত হল সেই সব অশরীরি আত্মা যারা মৃত্যুর পরবর্তী জীবনে শান্তি খুঁজে পায়নি (যাদের অতৃপ্ত আত্মাও বলা হয়ে থাকে) বা পৃথিবীতে অস্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করেছে (যেমন খুন, আত্মহত্যা বা দূর্ঘটনা)। এছাড়াও বিশ্বাস করা হয়, অন্যান্য জীবজন্তু বা প্রানীও তাদের মৃত্যুর পরে ভূতে পরিণত হতে পারে। বাংলায় ভূতকে মাঝে মাঝে প্রেতাত্মা (সংস্কৃত) হিসেবেও উল্লেখ করা হয়। প্রেতাত্মার নারীবাচক শব্দকে পেত্নী হিসেবে এবং পুরুষবাচক শব্দকে প্রেত বলা হয়ে থাকে।
ভয়ংকর ভুতের গল্প
ঠাকুমার পোষা ভূত – মহাশ্বেতা দেবী
ঠাকুমা, এ কথা কি সত্যি, যে তোমার নাম ছিল শুকতারা?
ছিল রে ছিল। শুকতারা আর সন্ধ্যাতারা দুই বোন ছিলাম আমরা। আমার বাবা তো বাংলার মাস্টার ছিলেন। সুন্দর সুন্দর নাম পছন্দ করতেন।
তবে মা বলেন কেন, তোমার নাম নীলতারা?
তবে শোন। আমার বিয়ে তো হল আট বছর বয়সে। তা আমার ভাসুরের নাম ছিল শুককুমার।
আর ঠাকুরদার নাম লালমোহন?
হ্যাঁ রে হ্যাঁ, তা শাওড়ি বললেন, বউয়ের নাম শুকতারা, আর আমার বড় ছেলের নাম শুককুমার। এতে গ্রামে খুব নিন্দে হবে। ওর নাম থাক নীলতারা। তা নাম ধরে তো ডাকত না কেউ। মেজবউ, মেজ বউঠান, মেজকাকী—এ সব বলেই ডাকত।
মা বলেছে তুমি নাকি একবার বাঘ তাড়িয়েছিলে?
তুইও তোর মায়ের মতো হলি যে! বাঘ কি আমি তাড়িয়েছিলাম? তাড়িয়েছিল…..
তোমার পোষা ভূত!
তা, সবই তো জানিস।
তোমার মুখে শুনব।
এ কথাটি শুনলে ঠাকুমা বেজায় খুশি হতেন। আমার ঠাকুরদা চুরুট মুখে দিয়ে কাগজে ‘শব্দ ধাঁধা’ করতেন, বই পড়তেন, ছড়ি হাতের পদ্মার ধারে বেড়াতে যেতেন। রাজশাহী শহর ছিল পদ্শার ধারে। ঠাকুমা সকালে তরকারি কুটতেন। কি রান্না হবে তা বলে দিতেন। ঠাকুমা বেজায় ভালো রান্না করতেন। তবে আমার বাবা, কাকারা জেদ করলে, অথবা আমরা বায়না করলে আশ্চর্য সব রান্না সেরে ফেলতেন।
তরকারি কুটেই স্নান করতেন। তারপর পেয়ারা গাছের নীচে বাঁধানো চাতালে বসে বাংলা কাগজ পড়তেন। কাগজটি পড়া হলে আমরা গল্প বলার জন্যে জেদ করতাম।
বাড়ির ভেতরে কত না গাছ! বাঁধানো চাতাল। রান্নাঘর, খাওয়ার দালান, ভাড়ার ঘর, সে একটা একতলা দালানে।
মুখোমুখি আমাদের থাকার ঘর। তারপর সিঁড়ির ঘর। সেখান দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে ছাতে। ছাতে বসে থাকতে খুব ভালো লাগত।
এত বড় ছড়ানো বাড়ি! থাকেন দুই বুড়ো-বুড়ি। সবাই বলত, “আপনার ভয় করে না?” ঠাকুমা হেসে বলতেন, আমার পোষা ভূতরা আছে না! তারা সব পাহারা দেয়। ওঁর পোষা ভূতই নাকি বাঘ তাড়িয়েছিল। ঠাকুমার বিয়ে হয় আট বছর বয়সে। রাজশাহী শহরের মেয়ে, বিয়ে হল সুদূর গ্রামে। পদ্মানদীতে নৌকো চেপে যেতে হয়। ছোট্ট মেয়ে কাঁদবে বলে সঙ্গে গিয়েছিল ওঁর ঝি মনোরমা। তাকে সবাই মনা মা বলত।
দেশে তো সব অন্যরকম। বাড়ি থেকে অনেক দূরে বাঁশের তৈরি শৌচালয়। ঠাকুমা খুব ভয় পেতেন। তখন মনা মা বোঝালেন, দেখ, তোকে দেখবে শুনবে বলে আমি কয়েকটা বাচ্চ ভূত এনেছি। না না, দেখলে ভয় পাবি না। সব ছোট ছোট ভূত। ওরা তোর কাছেই থাকবে। তোর সঙ্গে খেলবে, গাছ থেকে ফল পেড়ে দেবে, তুই ভয় পেলে তোকে দেখবে।
আমাকে ভয় দেখাবে না?
কখখোন না।
কোথায় তারা?
খড়ের চালে উঠে গেছে। খড়ের মধ্যে ঘুমোচ্ছে।
শুনতে শুনতে বললাম, অ ঠাকুমা! অত দূর দেশে যে গেলে, তুমি কাঁদতে না?
ঠাকুমা হেসে বললেন, আমার শাশুড়ি আমাকে কোলে বসিয়ে ভাত খাওয়াতেন, হাট থেকে খেলনা আনিয়ে দিতেন, পাড়ার ছোট মেয়েদের ডাকতেন। আমার সঙ্গে খেলা করত ওরা। মনখারাপ করার সময় কোথায়?
তোমার ভূতেরা?
দেখতাম গাছের কত উঁচুতে জাম, জামরুল, পেয়ারা, কত কি মনে মনে বলতাম, তোমরা কোথায়? আমি কি ও সব পাড়তে পারি? আর অমনি গাছপালার ভেতর দিয়ে বাতাস বয়ে গেল, আর গাছের নীচে ফলের পাহাড়।
কি ভালো! সে সব ভূতেরা এখন কোথায়?
আমার কাছেই আছে। এতবড় বাড়ি, দালান, গাছপালা! ওরাই সব দেখেশুনে রাখে।
আমি তো দেখিনি?
ওরা তোদের দেখেশুনে রাখে।
যাক গে, বাঘের গল্প বলো।
সে আমার ছোটবেলায়………
গ্রামের বাড়িতে ঠাকুমার আর খারাপ লাগছিল না। শাশুড়ির কোলের কাছে ঘুমোতেন। শাশুড়ি ভোরে পুজোর ফুল তুলতেন, চন্দন ঘষতেন, শাশুড়িকে পুজোর যোগাড় করে দিতেন। তারপর টুকটাক কাজ সেরে বন্ধুদের সঙ্গে খেলতেন। মনে জানেন, ভূতেরা সঙ্গে আছে, তাতেও খুব নিশ্চিন্ত।
তা একদিন সন্ধের মুখে বাইরে যাওয়া দরকার। একটি লণ্ঠন জ্বেলে নিয়ে ঠাকুমা তো চলেছেন। ভূতেদের আগেই ডেকে নিয়েছেন। তারপর পায়খানায় ঢুকতে যাবেন, দেখেন ইয়া বড় কেঁদো বাঘ একটা ছাগল নিয়ে বসে আছে।
ঠাকুমা বলছেন, ও বাবা! বাঘ!
বাঘ বলছে, ঘেঁয়াও !
ঠাকুমা ভাবছেন, এবার গেলাম!
বাঘ সবে ছাগল খাবে, খাওয়ার সময়ে বাঘ কি কোনো উৎপাত বরদাস্ত করে?
ও গো, তোমরা কোথায় গো!—বলেই ঠাকুমা মূৰ্ছা গেলেন। বাড়ির লোকজনও দৌড়ে আসছিল। বাঘের গর্জন শুনে তারাও থতমত। তারপর ওদের সামনেই বাঘকে চার পা ধরে কে যেন চিত করে দিল ও মা! বাঘের চার পা ওপরপানে। বাঘ ভাসতে ভাসতে শূন্যে উঠছে।
বউ কোথায়? বউ কোথায়?
ঠাকুমা কেঁদে বললেন, এই তো এখানে!
শাশুড়ি বললেন, দেখ ওপরে চেয়ে দেখ।
বাঘ চার পা তুলে শূন্যে ভেসে যাচ্ছে দেখে ঠাকুমা অবাক!
গ্রামসুদ্ধ সবাই অবাক। বাঘকে ওরা নাকি সুন্দরবনে পৌছে দিয়ে আসে।
গ্রামে ধন্য ধন্য পড়ে গেল। কাগজেও নাকি এ খবর বেরোয়। কেমন করে এটা সম্ভব হল, তা জানার জন্য ঠাকুমার শ্বশুরবাড়িতে লোকজনের ভিড়।
ঠাকুমা তার শাশুড়ির আঁচলে মুখ গুজে থাকলেন। সবাই বলল, এ কোনো ভৌতিক ব্যাপার নয়। নিশ্চয় দেবদেবীর আশীৰ্বাদ। ঠাকুমার শাশুড়ি ধুমধামে কি যেন পুজো করলেন। অনেক খিচুড়ি, অনেক পায়েস। ওঁর ভূতরাও পেট পুরে খেয়েছিল।
আজ ভাবি, আমারও যদি কয়েকটা ভূত থাকত!
ভয়ংকর ভুতের গল্প টি আপনার কেমন লাগলো মন্তব্য করে জানাবেন যদি পোষ্টটি ভালো লেগে থাকে তাহলে শেয়ার করতে ভুলবেন না।