Last updated on July 4th, 2023 at 12:50 am
আজকের Heart Touching Story “ভালোবাসায় বলিদান” গল্পের প্রধান চরিত্রে উজান ও নদী, গল্পের বিষয় – একটি প্রেমের গল্প, আরও Short love story এবং Romantic short stories পড়ার জন্য আমাদের ব্লগ টিকে সাবস্ক্রাইব করে আমাদের সাথে থাকুন, গল্পটি পড়িয়া যদি আপনার ভালো লাগিয়া থাকে তাহলে অবশ্যই কমেন্ট এবং শেয়ার করিতে ভুলিবেন না।
Heart Touching Story in Bengali Language
উনত্রিশে জুলাই। আজ নদীর জন্মদিন। ঘন বৃষ্টিতে মাঠ ঘাট ধুয়ে যাচ্ছে বেবাক। উদ্দাম জলের ধারা আছড়ে পড়ছে বাড়ির ছাদে, ছাদের পাইপ বেয়ে ভলকে ভলকে নেমে আসছে নিচে, প্লাবিত করছে বাঁধানাে নালা, ভাসিয়ে দিচ্ছে রাস্তা, জনমানবহীন ধু ধু সাদা রাস্তা। উজানের মনটা হু হু করে উঠছে এই নদীই তাে তার জীবনের…হ্যা নদীকে ছাড়া সে কিছুই ভাবতে পারত না। তার হাসি-কান্না রাগ-অনুরাগের সঙ্গে ওতপ্রােতভাবে জড়িয়ে গিয়েছিল এই নদী। মাত্র ক’টা বছর তাতেই সব ওলট-পালট হয়ে গেল কেমন! কোথায় নদী! উজানের জীবনে নদীর অস্তিত্বই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। আজ। বিছানা থেকে কষ্ট করে নেমে উজান দক্ষিণ দিকের জানলাটা খুলে দেয়। এই নামা-ওঠা করতে এখনও বড্ড লাগে উজানের, কিন্তু কী করবে? তার তো তিনকুলে কেউ নেই। রবীন বলে যে ছেলেটা দেখাশােনা করে ওর, তাকেও তাে সব সময় পাওয়া যায় না হাতের কাছে। হয়ত পাশের বাড়ির সমরের সঙ্গে লুডাে খেলছে সে এখন, কিংবা টিভিতে নাচ দেখছে দু’চোখ ভরে। ছােট ছেলে তাে, উজান মনে মনে ক্ষমা করে দেয়। মাস শেষ হওয়ার দু-এক দিন আগে থেকেই রবীনের বাবা এসে হাজির হয় ছেলের মাইনে নিতে। সে-ই বা কী করবে, অভাবের সংসার। উজান বােঝে সব, আর বােঝে বলেই রাগ করতে পারে না ছেলেটার ওপর। দক্ষিণের জানলা দিয়ে মােটা মােটা জলের ফোটা ঢুকছে ঘরের ভেতর, সঙ্গে হু হু হিমেল হাওয়া। ভিজতে বেশ লাগছে। উজানের। উনত্রিশে জুলাইয়ের বৃষ্টি তার একটা অন্যরকম আবেদন আছে উজানের কাছে। উজান এখনও বিশ্বাস করতে পারে না কোথা থেকে কীরকম হয়ে গেল জীবনটা!
নদীকে নিয়ে সুখের বসত গড়তে চেয়েছিল সে একটা ছােট্ট বসত, সারাদিনের কাজকর্মের পর সেখানে এসে দু’জনে দু’জনকে আঁকড়ে একটুখানি অবসর যাপন করবে। চাদের সমীপে। নদী উজানকে শােনাবে ভালবাসার গান, উজান কবিতা লিখবে নদীকে নিয়ে। বাগান ভরে হাসনুহানা ফুটবে তখন। এই হাসনুহানার গন্ধটা উজান পাগলের মতাে পছন্দ করে। নিজের হাতে এই গাছ লাগিয়ে ছিল সে বাড়ির বাগানে। তার নদীকে হাসনুহানার হাসিতে ভরিয়ে দেবে বলে।
বাইশে সেপ্টেম্বর। সেই অভিশপ্ত দিনটার কথা মনে পড়লে এখনও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে উজানের। তখন সবে মাত্র ভােরের আলাে ফুটেছে। ল্যান্ড ফোনটার কর্কশ চিৎকারে ঘুম ভেঙে যায় উজানের। ও প্রান্ত থেকে উদ্বিগ্ন গলায় বল্লরী বলছে, ‘উজানদা সর্বনাশ হয়ে গেছে, নদী খুব বড় অ্যাক্সিড্রেন্ট করেছে।
–“মানে? কী হয়েছে নদীর? ও কোথায় আছে?
–‘কাল ইউনিভার্সিটি যাওয়ার সময় ওর বাইকে একটা লরি ধাক্কা মারে। সঙ্গে সঙ্গে সেন্সলেস…কত রক্ত…সেই থেকে হসপিটাল, ব্লাড ব্যাঙ্ক…বাঁ পা-টা হাঁটুর নিচে থেকে কাটা পড়েছে। তােমাকে জানাবারও অবসর পাইনি উজানদা…’
বল্লরী খুব কাদছে। কাঁদতে কাঁদতে বলে চলেছে—‘সরি উজানদা, তােমার নদী প্রাণে বেঁচে গেছে, কিন্তু বাঁ পা-টা…’
আরও পড়ুন গল্পঃ একান্ত গোপনে
বল্লরী সম্পর্কে নদীর বােন হয়। কয়েক মাসের ছােট সে। একবারই তাকে দেখেছে। উজান। তিনজনে একটা রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়েছিল। কত হাসি ঠাট্টা, গল্পগাছা…। উজানের বেশ লেগেছিল বল্লরীকে। যথেষ্ট মিশুকে, ব্যক্তিত্বসম্পন্না, বুদ্ধিমতী। শ্যালিকা-সুলভ আদিখ্যেতা নেই একেবারেই, অথচ দিদির প্রতি যথেষ্ট কেয়ারিং। এই একটা কারণেই বল্লরীকে এত ভাল লেগেছিল উজানের। সেই বল্লরীর কাছ থেকে এরকম একটা ফোন আসতে পারে কল্পনাও করতে পারেনি উজান কোনওদিন। সে থরথর করে কাঁপছে। গলা শুকিয়ে কাঠ, মুখ দিয়ে কথা বেরােচ্ছে না। তবে কি নদী…ও বাঁচবে তাে? না না এ হয় না, এ হতে পারে না। নদী ছাড়া উজানের জীবন অন্ধকার। যে-কোনও মূল্যে নদীকে বাঁচাতেই হবে। দাঁতে দাঁত চেপে উজান কোনওরকমে উচ্চারণ করে—‘নদী কোন হসপিটালে আছে?’ বল্লরী চাপা গলায় উত্তর দেয় ‘উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। উজান ফোনটা নামিয়ে রেখে উভ্রান্তের মতাে পায়চারি করতে থাকে।
কলকাতার উপকণ্ঠে এই মফস্বল শহর থেকে একদিনে উত্তরবঙ্গ পৌঁছানাে যায় না। সে কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না, মাথা কাজ করছে না একেবারেই। উজান খানিকটা জল খেয়ে নেয়, বাথরুমে গিয়ে গায়ে মাথায় জল বুলিয়ে নেয় খানিকটা। কোনওরকমে একটা জামাপ্যান্ট গলিয়ে নিয়ে কালাে ব্যাগটা হাতে করে বেরিয়ে আসে রাস্তায়। মােবাইল আর মানিব্যাগটা নিতে ভোলে না সে। রাস্তায় বেরােতেই গলির মুখে কালাে বেড়াল। আগুনে চোখে তাকাচ্ছে সে। সে কি উজানকে সাবধান করে দিচ্ছে? সে কি বলছে দিনটা শুভ নয় তােমার জন্য? উজানের বুকটা ছাত করে ওঠে। কিন্তু দুর্বলতাকে কোনওরকম প্রশ্রয় দেয় না সে। দ্রুত গতিতে রাস্তা ক্রস করে বাসে উঠে পড়ে। বাসটা বেশ যাচ্ছিল, কিন্তু শেষরক্ষা হল না তাে-মাঝরাস্তায় টায়ার ফেটে বিপত্তি। উজানের বুকের ভেতর রােলার চলছে যেন! হাতে সময় খুব কম—পাঁচ মিনিট এদিক ওদিক হলে উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস মিস করবে সে। মােবাইল টিপে সে আবার যােগাযােগ করার চেষ্টা করে স্টেশনে না ট্রেন লেট নেই।
এর পর নদীর মােবাইলটা লাগায় আবার–নাঃ গত দুদিন ধরেই মােবাইলটা টানা সুইচ অফ বলে চলেছে। এবার ল্যান্ডফোনে চেষ্টা করে। ল্যান্ডও বলছে ‘আউট অফ অর্ডার। ইতিমধ্যে বাসের চাকা সারিয়ে ফেলেছে বাসের লােক। ফের চলতে শুরু করেছে গাড়ি। তবে কি ট্রেন পাবে না? উৎকণ্ঠায় কেটে যায় সময়। ইতিমধ্যেও গাড়ি যখন ঢুকছে স্টেশন চত্বরে, তখন ট্রেনও ঢুকছে, ঘােষণা হচ্ছে। উজান পাগলের মতাে ছুটছে। ছুটতে ছুটতেই দেখতে পাচ্ছে পতাকা উচিয়ে ডিপার্চার সিগন্যাল দিচ্ছে গার্ড। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে, উজানও প্ল্যাটফর্ম ছুঁয়ে ফেলেছে। গাড়ি গতি বাড়াচ্ছে। এই মুহূর্তে ট্রেনের পাদানি ছুঁয়ে ফেলেছে উজান। হুইলার স্টল থেকে এক কাগজ বিক্রেতা চিৎকার করে মানা করছে উজানকে। কিন্তু কে কার কথা শােনে? উজানকে যে ট্রেন ধরতেই হবে। হাসপাতালের বেডে একটা পা নিয়ে ছটফট করছে নদী তার কাছে পৌঁছতেই হবে উজানকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যে-কোনও মূল্যে। কিন্তু সে কি পৌঁছতে পারল?
উজান দুরন্ত গাড়ির প্রচণ্ড ঝটকা খেয়ে আছড়ে পড়ল এদিকে। একটা পা চাকার তলায়। যখন স্টেশন চত্বরের লােকেরা ধরে তুলে আনল তার নির্বাক নিথর শরীরটা তখন চাপ চাপ রক্ত চারিধারে। বাঁ পা-টা হাঁটু থেকে কাটা। কাটা অংশটা পাঁচ ফুট দূরে একাকী গড়াগড়ি খাচ্ছে নিঃশব্দে। বাইশে সেপ্টেম্বরের সেই অভিশপ্ত সকালটা উজান কি পারে মেমোরি থেকে ডিলিট করতে? বারবার সে মনে মনে সঙ্কল্প করে ওই দিনটার কথা ভাববে না কখনও। কিন্তু পারে কি? আজ এই উনত্রিশে জুলাইয়ের বৃষ্টিস্নাত বিকেলেও তার মনে সেই অভিশপ্ত দিনটার স্মৃতি বারবার ঘুরে ঘুরে আসছে।
মনে পড়ে যাচ্ছে সেই বনহুগলির এন আই ও এইচ-এর দিনগুলি। এখানেই তাকে সুদীর্ঘ দিন চিকিৎসাধীন থাকতে হয়েছিল। স্টেশন চত্বরের লােকজন স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করে দেওয়ার পর মােবাইলের কল লিস্ট ঘেঁটে তারাই ফোন করেছিল প্রায় সমস্ত নম্বরে। এভাবেই খবর চলে যায় পাড়াভুতাে কাকা, ক্লাবতুতাে দাদা, অফিসের সহকর্মী, দূর সম্পর্কের আত্মীয় মায় কবিবন্ধু পর্যন্ত। এদেরই মধ্যে ঘনিষ্ঠ কয়েকজন যেমন বাবলুদা, বিপ্রকাকু, অভিষেক আর পাপু এসে ওর দায়িত্ব নেয়। এই পাপু ছেলেটা উজানের খুব কাছের। রক্তের সম্পর্ক ছাড়াও যে এমন ঘনিষ্ঠতা হয় তা বােধহয় পাপুই বুঝিয়েছে উজানকে। সারা শরীরে ব্যান্ডেজ বাঁধা, পা কাটা উজানকে দেখে কঁকিয়ে কেঁদে উঠেছিল সে। তার পর গায়ে হাত রেখে বলেছিল “হার রে উজান, কোথা থেকে কী হয়ে গেল বল তাে?’ উজানও ওই অবস্থায় মাথাটা সামান্য সামনের দিকে তুলে, ডান পা-টা ঈষৎ হেলিয়ে আর্তস্বরে পাপুকে বলেছিল, ‘তুই তো আছিস…’। এর পরেই তার দ্বিতীয় প্রতিক্রিয়া ছিল ‘নদী কেমন আছে রে? নদীর খোঁজ নে পাপু…’
নদী কেমন আছে? এটাই তাে লাখ টাকার প্রশ্ন।
আরও পড়ুন গল্পঃ মুন্নির লাভ স্টোরি
সে কি উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বেডে একটা পা নিয়ে সত্যিই ছটফট করছে এখন? অ্যাম্পিউটেশন হয়ে গেছে তার? তার মােবাইল না হয় সুইচ অফ, কিন্তু ল্যান্ডফোনও অচল কেন? এখন ঢােকা যাক উত্তরবঙ্গের বাড়িতে। ওই তাে সােফার ওপর বল্লরী বসে। সে বাড়িতে বসে কী করছে? হাসপাতালে যায়নি? নদীর বাবা মা কোথায়? ওঁরা তাে গেছেন মন্দারমণি বেড়াতে, আজ তিনদিন হল। ওঁরা তবে ফেরেননি মেয়ের খবর পেয়ে ? না না, মেয়ের তাে হয়নি কিছুই সত্যি সত্যি ! আসলে ওর বাবা মা যেদিন বাইরে বেড়াতে গেলেন, সেদিনই বল্লরী এসেছে এ বাড়িতে। এসে সে খবর নিয়েছে উজান-নদীর প্রেম কতদূর। জেনেছে, যদিও দু’জনের ভৌগােলিক দূরত্ব যথেষ্টই, সম্পর্কে আর কোনও দূরত্বই নেই। এমনকী নদীর বাবা মা-ও মেনে নিয়েছেন এই সম্পর্ক। এখন শীঘ্রই দু’পক্ষ বসে চারহাত মেলাবার একটা দিন স্থির করলেই হয়। এ-সব শুনেটুনে বল্লরী বলেছে, –আচ্ছা নদী, উজানদা তাের বিয়ে করার যােগ্য তাে?
–এরকম কথা কেন বলছিস?
-“না, মানে…
–‘উজানের সঙ্গে সম্পর্কের কথা তুই আজ জানছিস?”
–‘সম্পর্ক আর বিয়ে এক নয় নদী।
–“মানে?
–‘মানে উজানদা প্রেমিক হিসেবে খুব ভাল, চোখ বুজে প্রেম করা যায়। কিন্তু বিয়ের জন্য যােগ্য তাে? অন্তত তাের মতাে মেয়ের সঙ্গে?
‘আমি ওকে ভালবাসি বল্লরী।
—“আমি জানি। তাের ভালবাসাটাকে আমি অনার করি। কিন্তু তুই এত সচ্ছল পরিবারের মেয়ে, উজানদা খুব সাধারণ। সামান্য একটা চাকরি করে। উপরন্তু কেউ কোথাও নেই। এইরকম বাউন্ডুলে ভবঘুরে একটা ছেলে তাের দায়িত্ব নিতে পারবে তাে?
শােন নদী, আমি খুব বাস্তববাদী আর সর্বোপরি তাের ভাল চাই।…’
—“তুই কি বলছিস সম্পর্ক কাট আপ করতে? ইমপসিবল।
-বােকা মেয়ে! আমি কি তাই বলেছি?
—“তবে?
—“যাকে জীবনসঙ্গী করতে যাচ্ছিস তাকে একবার পরীক্ষা করে দেখে নিবি না সে তােকে কতখানি ভালবাসে?
—কীভাবে?
‘তা ছাড়া তােদের দেখাসাক্ষাৎ-ও তাে খুব বেশিবার হয়নি। মূলত মােবাইল-নির্ভর তোদের প্রেম। আমি একটুও ছােট করছি না এই ভালবাসাকে। কিন্তু তবু…’ ‘আমাদের সম্পর্ক তাে বহুদিনের।
“শুনেছি কবিরা বারবার প্রেমে পড়ে। উজানদার প্রেমটাকে একবার কষ্টিপাথরে যাচাই করে নিলে হয় না?
“কোনও আইডিয়া কি এসেছে তাের মাথায় ?
এসেছে তাে!
এর পর যা হয়েছে সবই বল্লরীর প্ল্যান মতাে। দু’দিন মােবাইল সুইচ অফ রাখা হয়েছে নদীর। আর ল্যান্ডফোনের রিসিভার নামিয়ে রাখা হয়েছে। তার পর আজ বাইশে সেপ্টেম্বর খুব ভােরে ল্যান্ডফোন থেকে উজানকে কাদো কাদো গলায় বল্লরী ফোন করে অ্যাক্সিডেন্ট আর পা কাটা যাওয়ার গল্প বলেছে। উদ্দেশ্য একটাই—উজানের প্রেম যদি মেকি হয়, সে আস্তে আস্তে সরে যাবে—‘অন্তত কিছুতেই আসবে না এখানে আর। আর যদি খাঁটি হয় তার ভালবাসা। তবে ফোন পেয়েই সে উন্মাদের মতাে ছুটে আসবে। নিখাদ ভালবাসা ছাড়া পৃথিবীর কোনও পুরুষই সম্ভবত এইরকম একজন প্রতিবন্ধী নারীকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করতে চাইবে না, নাটকে নভেলে হতে পারে, তবে বাস্তবে অন্তত নয়।
আরও পড়ুন গল্পঃ কেষ্ট নগরের পুতুল
তাই অধীর আগ্রহে দুই বােন উজানের ভালবাসার পরীক্ষায় মেতে উঠেছে। আর উজানের গতি প্রকৃতির ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখতে লাগানাে হয়েছে অবীনকে। অবীন বল্লরীর ভাইয়ের বন্ধু, সে ইকনমিক্সে অনার্স নিয়ে পড়ছে। ডিটেকটিভ ব্যাপার স্যাপারে তার অপরিসীম আগ্রহ। শখের গােয়েন্দাগিরি সে অনেকদিন থেকেই করে, এ ব্যাপারে বেশ নাম ডাকও হয়েছে তার। তাই বল্লরী যখন ফোন করে অবীনকে সব কিছু বলে, সে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে লুফে নেয় প্রস্তাবটা। উজানের ডিটেলস্টা সে সংগ্রহ করে নিয়েছে। দিদিদের কাছে—মানে ওর ল্যান্ড নম্বর, মােবাইল নম্বর, বাড়ির ঠিকানা, চাকরির জায়গা ইত্যাদি ইত্যাদি। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও সে সকাল সকাল পৌঁছে যাবে, কারণ উজান এলে তাে সেখানেই প্রথম আসবে।
বনহুগলির এন আই ও এইচ-এ দেশের বিশিষ্ট অস্থিচিকিৎসক ডাঃ গুপ্তর আন্ডারে উজানের ‘অ্যাম্পিউটেশন’ হয়ে গেছে। এর চোদ্দো দিন পর ‘স্টাম্প’ করা হয়েছে যত্ন করে, হয়েছে সফল ক্লোনিং। তারও এক মাস পর ডাক্তারবাবুর নির্দেশে হয়েছে ‘পাইলন। উঃ কী বীভৎস কেটেছে ওই দিনগুলাে। মনে হত, এর থেকে মৃত্যুও ছিল ভাল। উজান জীবনানন্দের কবিতা থেকে বিড়বিড় করে বলত ‘মনে হয় এর চেয়ে অন্ধকারে ডুবে যাওয়া ভালাে। কিন্তু সবসময় ভাল কি হয় আমাদের? যার জন্য যতটুকু বরাদ্দ তাকে ততটুকু নিয়ে যেতেই হয় এ বিশ্ব সংসারে। এই ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দিত উজান। কিন্তু কতটুকু শান্তি পেত তার আত্মা? ক্রাচে ভর দিয়ে চলতে চলতে তার মনে হত সমস্ত পৃথিবী আজ তার প্রবেশের দুয়ার, যেন বন্ধ করে দিয়েছে। নিজেকে অসহায় ভিখারির মতাে মনে হত তার। ডানা মেলে পাখিরা উড়ে যেত নীল আকাশে, সেই দিকে নিরবকাশ তাকিয়ে থাকত উজান। তার পর আরও তিন-সাড়ে তিন মাস পর ডাঃ গুপ্ত ‘অ্যালিমকো লিম্ব’ দিয়ে প্রস্থেসিস করলেন উজানের বাঁ পায়ে। সেই দিন থেকে আর্টিফিসিয়াল লিম্ব পেল উজান। হােক না আর্টিফিসিয়াল, সে তাে আবার মাটিতে পা ছুঁয়ে দাঁড়াতে পারল মাথা তুলে.। ডাঃ গুপ্ত তাকে নতুন জীবন দান করলেন। সত্যিই কোনও কোনও ডাক্তারবাবু মানুষের জীবনে ভগবানের মতাে আবির্ভূত হন, তার অলৌকিক মহাশক্তি দিয়ে মানুষকে আবার বাঁচবার প্রেরণা জোগান। একটা শেষ হয়ে যাওয়া, ফুরিয়ে যাওয়া মানুষ আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, আবার কবিতা লিখতে পেরেছে, আবার অফিস জয়েন করতে পেরেছে, আবার হাসতে পেরেছে, হাসতে হাসতে মেনে নিতে পেরেছে সত্যকে, বাস্তবকে, মেনে নিয়েও বিছানা ছেড়ে উঠে এসে নিজে হাতে দক্ষিণের জানলা খুলে আজ এই উনত্রিশে জুলাইয়ের বৃষ্টির আস্বাদন নিতে পেরেছে। বুক ভরে, এর থেকে বেশি আর কী আশা করা যায় জীবনের কাছে? একজন বিকলাঙ্গ মানুষকে সারাজীবনের জন্য গ্রহণ করার সামাজিক অসুবিধা যে নদীর কাছে, ইনফ্যাক্ট যে-কোনও মেয়ের কাছেই, কতখানি বিশালাকার তা সে উপলব্ধি করতে পেরেছে, অনুধাবন করতে পেরেছে হৃদয় দিয়ে। এও তাে এক বিরাট প্রাপ্তি জীবনের কাছে। এই উপলব্বির মধ্যে কোনও রাগ নেই, বিদ্বেষ নেই, হিংসা নেই, কোনও প্রতিশােধস্পৃহাও নেই বিন্দুমাত্র। চেতনার এই ব্যাপ্তি, অন্তরের এই প্রসারতাই তাে জীবনের যুদ্ধে তাকে জিতিয়ে দিয়েছে। সে আজও চায়, সবসময় চাইবে, নদীর ভাল হােক, নদীর সমৃদ্ধি হােক। সে জানে না কোথায় কতদূরে নদী কীভাবে আছে, কীরকমভাবে দিন কাটছে। তার, কিন্তু আজও সে সমানভাবে অনুভব করতে পারে নদীকে। তাই উজানের জীবনে নদীর অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও সে আছে, ছাদের পাইপ বেয়ে ভলকে ভলকে নিচে নেমে আসা উদ্দাম জলস্রোতে সে আছে, বাঁধানাে নালা উপচে দু-কূল ছাপানাে জনমানবহীন ধু ধু সাদা রাস্তার জলপ্লাবনে সে আছে। উজান লক্ষ্য করে দক্ষিণের খােলা জানলা দিয়ে নদী তাকে সম্পূর্ণ ভিজিয়ে দিয়েছে।
(সমাপ্ত)